অরুপা, করোনা এবং রাজ্জাক ভাই মমতাজ রহমান চম্পা
অরুপা আমাদের ঈদ পার্টির নাম। কয়েক বছর ধরে আমরা পারিবারিক ভাবে একটা ঈদ পার্টি করি অরুপা নামে। রুনু আপার দেয়া নাম, আমাদের নামের একটা করে অক্ষর জুড়ে দিয়ে নাম হয়েছে - অরুপা। ঈদ নিয়ে ছোট বেলায় যে উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনা ছিল এখন আর তা পাই না। উইকেন্ডে ঈদ হলে তো বুঝতেই পারিনা ঈদের আমেজ। ছোটবেলায় আনন্দে ঘুমই আসতো না নতুন জামা কাপড় আর বেড়াতে যাওয়ার আনন্দে।
কত জল্পনাকল্পনা ছিল এই ঈদ নিয়ে। কেমন হবে এবারের জামা। অনেক সময় আম্মাই সেলাই করতেন আমাদের ফ্রক, পায়জামা। চিন্তায় থাকতাম ঈদের দিন নতুন কাপড় পরতে পারব তো? কারণ সব কাজের শেষে রাতের বেলা আম্মা সেলাই মেশিন নিয়ে বসতেন। জুতো বা স্যান্ডেল আগেই কেনা হতো তাই সেই জুতোর স্থান হতো বালিশের পাশে। চাঁদ রাতের দিনও কত চিন্তা, ঈদ কবে হবে। বাসার ছাদে উঠে চাঁদ দেখা'র কতো চেষ্টা। আম্মা চাঁদ দেখা গেলে রান্নার আয়োজন করতেন। বেশির ভাগ সময় আকাশে কাল মেঘ থাকত তাই আমাদের মুখও কাল হয়ে যেত!
এখন আর এসব ভাবায় না। ঈদ উইকডে তে হলে আমি ঈদের রান্না উইক এন্ডেই করি। মনে মনে বলি কি আছে আল্লাহর দিন তো সবই সমান! আমার ছেলে ঈদের মানি পেলেই খুশি হয় পোলাও কোরমা না হলেও চলে। তার ঈদের প্রথম পরবী টা সে পেত তার বুপার (রাজ্জাক ফুপা) কাছ থেকে। রাজ্জাক ভাইকে অভিষেক বুপা বলেই ডাকত। অভিষেক এদিকে আয় বল্লেই বুঝে নিত বুপা একটা খাম দেবে! বুপা তো শুধু অভিষেকের ফুপা ছিলেন না উনি ছিলেন ওর দাদা, চাচার মতন। আমার আম্মা ছাড়া ও আর কোন গ্র্যান্ড পারেন্টস কে দেখেনি। ওই স্থানে ছিলেন রাজ্জাক ভাই। স্কুলে প্রথম দিনও উনার হাত ধরে গিয়েছিল। কতো দিন ওর স্কুলের গ্র্যান্ড ফাদারস ডে তে রাজ্জাক ভাই গিয়ে ব্রেকফাস্ট খেয়ে এসেছেন। রাজ্জাক ভাই এর প্রথম কবিতাও মনে হয় অভিষেক কে উদ্দেশ্য করে লেখা। ভীষণ আদর করতেন অভিষেকে। একবার অস্ট্রেলিয়াতে কলার কেজি হয়ে ছিলো প্রায় ২০ ডলারের মতন। আমি কেনা বন্ধ করেছিলাম। রাজ্জাক ভাই সেই কথা শুনে একদিন ১ ডজন কলা নিয়ে হাজির হলেন। মনে আছে অভিষেক এক বসায় ৪ টা কলা খেয়েছিল। যখন অভিষেককে প্রথম বাংলাদেশে নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন মনে আছে অভিষেকের টিকিট আর পাসপোর্ট দু’টোই রাজ্জাক ভাই নিজের টাকা দিয়ে করে দিয়েছিলেন। রাজ্জাক ভাই খুব ভালবাসতেন ইফতার খেতে। ঈদের বাজার করা নিয়েও কী তোড়জোড়। কয়েক বছর ধরে পারিবারিক ভাবে আমরা ঈদটা এক সাথেই করি কারণ আমাদের সবারি গেস্টরা কমন। এক সাথে ঈদ করলে আনন্দ যেমন অনেক বেড়ে যায় তেমনই আবার খাটনিও কম হয়। তাই এই অরুপা, অরেলিয়া’র “অ” রুনুর “রু” আর চম্পার “পা”। আমরা যখন আলাপ করি কে কি রান্না করবে রাজ্জাক ভাইও অংশগ্রহণ করতেন।
উনার খুব উৎসাহ ছিল এ ব্যাপারে। ঈদে কি কি রান্না হবে উনি বলে দিতেন। কার হাতের কোন রান্না ভাল সেগুলো দিয়ে অরুপার মেনু ঠিক করতেন। রুনু আপার হাতের বানানো ডাল পুরি আর হাড়ি কাবাব মেনুতে থাকতেই হবে, না হলে যেন ঈদ ই হবে না। তারপর উপহার কেনা। উনি কিনতেন না তবে রুনু আপাকে শপিং-মলে নিয়ে যেতেন। শপিং এর ব্যাপারে রাজ্জাক ভায়ের ছিল অসীম ধৈর্য, রবার্ট ব্রুসের মতন। একেবারেই বিরক্ত হতেন না। উপহার দিতেও যেমন পছন্দ করতেন কেও উনাকে দিলেও খুব খুশী হতেন। সাথে সাথেই পরে আসতেন। বাসায় ছোট বাচ্চারা আসবে তাই উনি নিজেই চকলেট কিনে বেশ বড় এক বাক্সে রেখে দিতেন। বাচ্চারাও জানত কোথায় থাকে ওই বাক্স।
এক সময়ে কত মানুষই না দেখেছি উনার বাসায়। অনেক সময় মজা করে বলতাম এ যেন সিডনি তে বাংলাদেশের গণভবন! সবাই সারা দিন ঘুরে রাতে আড্ডা দিতে আসতেন। আর তা চলতো রাত ২ টা ৩ টা পর্যন্ত। বাংলাদেশ এবং সিডনির কত নামি দামি মানুষকেই না দেখেছি উনার বাসায়। মনে পড়ে ব্যারিস্টার তুরীণ আফরোজ কে একবার ঈদে দেখেছিলাম উনার বাড়িতে। তখন অবশ্য তুরীণ এত বিখ্যাত ছিলেন না। আস্তে আস্তে জন সমাগম কমে গেল। সেটা অবশ্য উনি বাংলাদেশে চাকরি নিয়ে চলে যাবার কারণেই খানিকটা।
একবার ঈদের সময় আমার চিকেন পক্স হয়েছিল। রাজ্জাক ভাই ঠিকই ঈদের নামাজ পড়ে উনার বড় ছেলেকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছিলেন। এই ঈদে সেই বুপা থাকবেন না আর কোন ঈদেই আদর করে অভিষেককে ডাকবে না কাছে। রাজ্জাক ভাই যে এই ঈদ পর্যন্ত যে থাকবেন না সেটা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন। উনি যখন হাসপাতালে থাকতেন আমি প্রায়ই অফিসের পরে হাসপাতালে চলে যেতাম উনাকে দেখতে। আমাকে দেখলেই উনি আমার পিছনে যেন কাওকে খুঁজতেন মনে হত। খুব আস্তে আস্তে বলতেন অভিষেক কে কোথায় রেখে এলে? একা থাকতে পারবে ত? বলতাম ও এখন কি আর ছোট আছে? ১৭ তে পড়বে? বললাম অভিষেক ওর জীবনের প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছে, শুনে উনার মুখ হাসিতে ভরে উঠেছিল। কথা দিলাম পরের দিন নিশ্চয় নিয়ে আসবো। পরের দিন অভিষেক আসার আগেই উনি রুনু আপা আর সীমা আপাকে একটা খামে কিছু টাকা রাখতে বললেন। অভিষেক দেখা করতে এলে উনি সেই খামটা দিলেন ওর হাতে। দাতা এবং গ্রহীতা দুজনই জানত এই শেষ। বাড়ি ফেরার সময় গাড়িতে লক্ষ্য করলাম অভিষেক এর চোখ ভেজা। কত কথাই না ভিড় করে আসছে। অনেকেই অনেক ভাবে চেনেন রাজ্জাক ভাইকে। তবে আমার দেখা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। উনি কখনও বা বাবার মতন কখনো বা ভাই কখনো বা বন্ধুর মতন মাথার উপর ছাতা হয়ে ছিলেন। উনার হাত ধরে আমি সিডনি শহরকে চিনেছি।
আগামী রবিবার ঈদ! আমাদের কোন প্রস্তুতি নাই। কি করে “অরুপা” হবে রাজ্জাক ভাইকে ফেলে? রাজ্জাক ভাই এর এত দ্রুত প্রস্থান আর করোনা ভাইরাস আমাদের স্নায়ুকে যেন অবশ করে দিয়েছে। সোশাল ডিস্টেন্সসিং যেন একটা সমাধানও বাতলে দিল - “অরুপা” রা এবছর ঘরেই বসে থাকো!
মমতাজ রহমান চম্পা, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|