আমার “ফাদার্স ডে” মম্তাজ রহমান
আমার “ফাদার্স ডে” কোন দিন করা হয়ে ওঠেনি। মনে হতো উনি ইচ্ছা করে আমাদের একা করে দিয়ে চলে গিয়েছেন। সব সময় বাবার প্রতি আমার একটা প্রচ্ছন্ন অভিমান ছিল। উনাকে সব সময় মন থেকে জোর করে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম।
গত বছর ৭ই সেপ্টেম্বর ছিল “ফাদার্স ডে”, আমার বাবাও ৭ই সেপ্টেম্বর মারা যান। আমি যেখানে কাজ করি সেখান এই বিশেষ দিনটি ভুলে থাকা খুব কঠিন। যেদিকে তাকাই বড় বড় পোস্টার, ৭ই সেপ্টেম্বর ফাদার্স ডে। আমার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। নতুন নতুন গিফটে ভরতি দোকান পাট। দেখলেই কিনতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু কার জন্য কিনব?
আমার যখন ১১ মাস বয়স তখন আমার বাবার দুইটি কিডনি অচল হয়ে যায়। অনেক দিন হাসপাতালে ভুগে চলে যান তিনি - না ফেরার দেশে। তখন কিডনি সংযোজন করার ব্যবস্থা ছিল কিনা জানি না। থাকলেও আম্মা সেই ব্যয়ভার বহন করতে পারতেন কিনা সন্দেহ! এসব ভাই বোনদের মুখে শোনা। জ্ঞান হবার পর থেকে যাকে চিনি তিনি আমার মা। সাদা শাড়িতে ঢাকা সদা তটস্থ, দুশ্চিন্তায় কুঁজো একজন মা। যিনি সকাল থেকে মাঝরাত অব্দি মেশিন এর মত খেটে চলেন বিরতি হীন। ৯য় জন ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে চোখে সরষে ফুল দেখেন। কাওকে দোষ দেবার নেই! উনার বয়স তখন ৩৬ বছর আর বাবার ৪১। আমার কিছু মনে নাই সে জন্য আমি অবশ্য মনে মনে সর্ব-শক্তিমান কে ধন্যবাদ দি আমাকে এই দৃশ্য দেখতে না দেবার জন্য। বাবা চলে গেলেন তার সাথে আরও অনেক কিছুই চলে গেল, গাড়ি, সচ্ছলতা, বোনদের গান শেখা। বড় দুই ছেলে স্বাধীনতা পেয়ে উচ্ছন্নে গেল। আম্মা নিরুপায়। বাবার কাছে যাবার জন্য বায়না ধরলে বড়রা বলত বাবা ঢাকায় গিয়েছে ফোন এ কথা বলবি? বলে রিসিভার কানে লাগিয়ে দিত। আমি কেন যেন খুব লজ্জা পেতাম। কিছুই শুনতে পেতাম না! শুনব কি করে? আম্মার সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছে ফোনের বিল দেবে কোথা থেকে? লাইন থাকলেই বা কি ও পাশে ত কেও নেই আমার সাথে কথা বলার জন্য! যখন আরেকটু বড় হলাম তখন আকাশের তারা দেখিয়ে বোনরা বলত বাবা ঐ তারাদের সাথে মিশে আছে। তখন একটু একটু গানও শুনতে শিখেছি। রেডিও তে যখন গান হত “ও তোতা পাখিরে শিকল খুলে উড়িয়ে দিবো আমার মা কে যদি এনে দাও” আমি গানের কথা পরিবর্তন করে মনে মনে গাইতাম আমার বাবাকে যদি এনে দাও; আর বালিশে মুখ গুজে কত কেঁদেছি যাতে কেও দেখে না ফেলে।
আস্তে আস্তে আমার স্কুল এ যাবার সময় হল, আমাকে নিজের নাম, বাবার নাম মুখস্থ করান হল। স্কুল এ প্রথম দিন ক্লাস টিচার আপা জানতে চাইলেন সবার নাম, বাবার নাম, বাবা কি করেন? আমার পালা যখন আসলো আমার আর মুখ দিয়ে শব্দ বের হয় না। আমি কেন যেন লজ্জায় মুখ খুলতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে বাবার নাম বললাম। কি করেন জানতে চাইলে বললাম বাবা নেই, মারা গিয়েছেন। ক্লাস এর সবাই আমার দিকে করুণার চোখে তাকাতে লাগলো। ক্লাসে প্রায় সবাই বাবা মার প্রথম বা দ্বিতীয় সন্তান তাই বাবা মারা গিয়েছেন ব্যাপার টা তাদের কাছে একটা বিস্ময়কর ঘটনা। ক্লাস এর মেয়েরা স্কুলে আসত কেউ বাবার সাথে, কেউ মায়ের সাথে কেউ বা বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে। আমি একা একা বিষণ্ণ মনে হেঁটে হেঁটে স্কুলে আসতাম কেউ ছিল না আমাকে নিয়ে আসার। আমি তাকিয়ে থাকতাম। কেউ কেউ সুন্দর সোয়েটার গায়ে দিয়ে এসে বলত আমার বাবা লন্ডন থেকে এনেছে। কেউবা বলত ঢাকা থেকে আনা। আমি পুরাণ রংচটা কাপড় পরে ক্লাসের শেষ বেঞ্চে কুঁজো হয়ে বসে থাকতাম। সেই যে কুঁজো হলাম আজ অব্দি পিঠ সোজা করে দাঁড়াতে পারলাম না। একটা মানুষের জন্য আমাদের নয় ভাই বোনের মেরুদণ্ড চির দিনের জন্য বাঁকা হয়ে গেল!
আমাদের জীবনটা অসম্পূর্ণ থেকে গেল। বাবা থাকলে হয়ত অন্য রকম হতো। আমার সব কিছুই একটু আলাদা ছিল অন্যদের থেকে। যেমন, স্কুল এ যাব কিন্তু আমার ভাল নাম ঠিক করা হয়নি। বাবা মা আকিকা দিয়ে ছেলে মেয়ের নাম রাখে। আমার আকিকা আম্মা দিতেই পারেনি অভাবের কারণে। তাই স্কুলে ভর্তির আগে আম্মা খুব চিন্তায় পড়লেন। সব ভাই বোনের নাম বাবা রেখেছেন আমার টা রাখার সময় পাননি। আমি আম্মা কে উদ্ধার করলাম, বললাম আমার বোনের এক বান্ধবীর নামটা আমার পছন্দ। আম্মা রাজি হয়ে গেলেন। আর আমার আকিকার যে কথা বলছিলাম তাও বেশ মজার। আম্মা বাড়িতে গরু, ছাগল, মুরগি পালতেন যাতে আমরা দুধ ডিম খেতে পারি। আম্মার ইচ্ছা বাড়ির ছাগল বড় করে আমার আকিকা দেবেন। যখন সেই সময় হোল আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমাকেই পাঠানো হয়েছিল প্রতিবেশীদের বাসায় নিজের আকিকার মাংস দিয়ে আসার জন্য। প্রতিবেশী এক চাচা জানতে চাইলেন মাংস কেন? কারণটা শোনার পর উনি যে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন আমি আজো তা শুনতে পাই!
এক বার মনে আছে আমি পাড়ার ফেরীওলার কাছে আইসক্রিম কিনতে গিয়েছি। তখন ১০ পয়সাতে গোলাপি, কমলা, সাদা আইসক্রিম পাওয়া যেত, আইসক্রিম-ওয়ালা বলল ৫০ পয়সার টা নাও বাদাম দেয়া, খুব ভাল, আমি বললাম ৫০ পয়সা যে আমার কাছে নেই; সে তখন বলল বাপ কে খেয়েছ আইসক্রিম র খাবে কি? সে আমার বাবাকে চিনতো। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে আসলাম। আমার এক বোন বলল আবার ঐ আইসক্রিম-ওয়ালা আসলে দেখাবি, আচ্ছা করে বকে দেব। আমি আর কোনদিন ঐ আইসক্রিম-ওয়ালার ধারে কাছে যাইনি!
বাবার মৃত্যুর পর নানা ধরনের মানুষ নানা ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আসতো। কেউ বোনদের বিয়ের জন্য অদ্ভুত সব পাত্র এনে হাজির করতো। আম্মা রাজি না হলে তারা বলতেন মেয়েদের কি ঘরের খুঁটী করে রাখবেন? কেও আবার বলত একটা ছেলে আমাকে দিয়ে দেন আপনার তো আরও দুইটা আছে। আমাদের সাথে থাকবে খাবে, বাড়ির বাজার হাট করবে। আমাদের উপকার হয় আপনার ও একটা খাওয়ার পেট কমে। কেউ আসে আসবাব কিনতে, বলে আপনি সোফা দিয়ে কি করবেন। সে কথাও ঠিক, বাবা যখন ছিলেন দরকারে অদরকারে বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের ভিড় লেগেই থাকতো। বাবাও নাই তাই আমরাও যেন অশুচি হয়ে গেলাম! ভুল করেও কেও আসতো না। কেও যদি আসতো আমারা যে কি খুশী হতাম তা বলার না। আমি এখনও ভেবে পাইনা আম্মা এসব সামাল দিতেন কি ভাবে! আম্মার তেমন পড়াশোনা ছিল না। তেমন কেউ কোথাও ছিলও না পাশে দাঁড়াবার!
সন্ধ্যা বেলাতে রান্না করতে করতে হ্যারিকেন এর আলোতে মা আমাদের পড়াতেন। উনি বিদ্যুৎ এর বিল কমানোর জন্য কখনও হ্যারিকেন কখনও কুপি ব্যবহার করতেন। মনে আছে শসা বানান ভুল করার জন্য জোরে একটা চড় খেয়েছিলাম। মনে হয় এইত সেই দিন! আর কোনোদিন ভুল করিনি শসা লিখতে! আমাদের বাসায় কারও কখনও জন্মদিন পালন হতো না। তবে বাবার মৃত্যু দিনে আম্মা আমার ভাইদের কে আগরবাতি, মোমবাতি দিয়ে কবরস্থানে পাঠাতেন। একবার আমার ভাই গোরস্থান থেকে ফিরে এসে আম্মাকে জানালো বাবার কবর বাঁধানো হয়নি বলে ওখানে আরেকজন কে কবর দেয়া হয়েছ। বাসায় আরেক দফা শোকের ছায়া নামলো। আম্মা খুব কাঁদলেন। আমাদের খুব কষ্ট হল। এখন ভাবি এত মানুষের দেশে সবাই যদি নিজের কবর বাঁধাই করে রাখে কদিন পরে তো অন্যদের জায়গাই থাকবে না। আমার কখনো বাবার কবর জিয়ারত করতে যাওয়া হয়নি। যে কোন গোরস্থান এর পাশ দিয়ে গেলে আমি সবার জন্যই দোয়া পড়ি। জানি কোন না কোন খানে আমার বাবা আছেন। তিনি শনিবারে মারা গিয়েছিলেন; আমরা কোন শনিবার নতুন কাপড় পরিনি!
এইভাবেই আমি বড় হতে লাগলাম। নিজেই নিজের গার্জিয়ান হলাম। বড় ভাই বোনরাও তো তেমন বড় না। তারাও তাদের জীবন যুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর সংসারে অভাব থাকলে কেমন যেন দূরত্ব বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হতো কি দরকার ছিল আমার এ পৃথিবীতে আসার। বাবা মার তো ছেলে মেয়ে সবই ছিল! আমার বাবা সখ করে আমার ডাক নাম রেখেছিলেন “আশা”। আম্মা বলতেন তোর বাবা বলত দেখো “আশা” তোমার খুব ভাল মেয়ে হবে তোমার সব কাজ করে দেবে! আমি সেটা শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে চতুর্থ শ্রেণী তে পড়ার সময় থেকে বাড়ির যাবতীয় কাজ কর্ম করতে শুরু করি যদি আম্মাকে একটু সাহায্য করতে পারি। বাজার করা, রেশন উঠানো, লাইট এর বিল দেয়া, কাঠের গোলা থেকে রান্নার জন্য কাঠ কিনে আনা, তেলের মিলে গিয়ে সরষে ভাঙ্গিয়ে আনা, আটার মিলে গিয়ে গম ভাঙিয়ে আনা। যাকে বলে - জুতা সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ। এ সব করতে আমার ভালই লাগত নিজেকে খুব বড় বড় লাগত। তবে বাবার বন্ধুরা অনেকেই বলতেন তোমার ভাইদের কে বলবে এসব কাজ করতে। আমি জানতাম ভাইরা এত অল্প টাকা নিয়ে বাজার যেতে লজ্জা পায় তখন আমি রাস্তা পরিবর্তন করতাম যাতে ঐ চাচারা না দেখতে পায়। ঐ ছোট বেলার শিক্ষা অস্ট্রেলিয়াতে এসে কাজে লেগেছে ভালোই!
অনেকে আমাকে দেখে বলেছে তুমি অমুকের মেয়ে না? তোমার চেহারা একদম তোমার বাবার মতন। খুব ভাল মানুষ ছিলেন তোমার বাবা। বাবার মত চেহারার মেয়েরা খুব ভাগ্যবান হয়! তবে সে ধরেনের কোন লক্ষণ এখনও মিললো না! কেমন ছিলেন আমার বাবা? বেঁচে থাকলে আমার জীবন কেমন হতো? কে জানে? বাবার স্মৃতি বলতে কিছু পুড়নো কাপড় যা আমরা খুব যত্ন করে বছরে একবার রোদ্রে দিতাম, তারপর ন্যাপথালিন দিয়ে ভাঁজ করে আলমারি তে উঠিয়ে রাখতাম। আর ছিল বুক সেলফ ভরা মোটা মোটা বই আর আমাকে কিনে দেয়া তার একমাত্র খেলনা। একটা চাবি দেয়া হাস। আমি এখনও রেখে দিয়েছি। অবাক ব্যাপার, সেদিন চালিয়ে দেখলাম এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে!
আমি বাবার শূন্যতা কিছুটা হলেও পূরণ করতে চেষ্টা করেছি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গান আর কবিতার ভিতর দিয়ে। আমার বাবা খুব গান ভালবাসতেন। দেখতে দেখতে আরেকটা “ফাদার্স ডে” চলে এলো। ফেস বুক ভরে যাবে বাবাদের ছবিতে। বাবার সাথে তোলা আমার কোন ছবি নেই তাই উনাকে স্মরণ করে আমার এই লেখা। আমার না দেখা বাবার জন্য ভালবাসা, আর আমার মা কেও ফাদার্স ডে তে ভালবাসা জানাই, উনি আমার জীবনে মা এবং বাবা দুজনের ভূমিকা পালন করেছেন সমান ভাবে। তিনি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দমে যাননি, উনি ভেঙ্গেছেন কিন্তু মচকানি! পৃথিবীর সব বাবাদের জন্য আমার শুভেচ্ছা!
মম্তাজ রহমান, সিডনি
|