অদিতি মুন্সি ও তাঁর মুন্সিয়ানা মমতাজ রহমান চম্পা
২৭ অক্টোবর ২০১৮, সিডনির স্যার জন ক্লেন্সি অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হলো উপমহাদেশের কীর্তন গাইয়ে অদিতি মুন্সির একক সঙ্গীত অনুষ্ঠান। অতি অল্প বয়সে এই শিল্পী খ্যাতির চুড়ায় পৌঁছিয়েছেন কীর্তনের মুন্সিয়ানা দিয়ে। অনুষ্ঠানের আয়োজক “বাংলাদেশ সোসাইটি ফর পূজা এন্ড কালচার” (BSPC)। সংগঠনটি সিডনিতে নিয়মিত দুর্গা পূজা, শ্যামা পূজা, জন্মাষ্টমী সহ নানা ধরনের অনুষ্ঠান করে থাকে। BSPC ২০০১ সালে পদ্মভূষণ মান্না দে কে নিয়ে দুইটি সফল অনুষ্ঠান ছাড়াও মিতালী ও ভূপেন্দার সিং কে নিয়েও একটা বড় অনুষ্ঠান করে। এই বারের অনুষ্ঠানটি ছিল তারই ধারাবাহিকতা। অদিতি মুন্সির অনেক নাম শুনেছি, এবার দেখার সুযোগ হলো, তাই সময় মত অডিটোরিয়ামে পৌঁছে যাই। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা থাকলেও সন্ধ্যা ৭.০০ টায় হলে ঢোকার অনুমতি পাওয়া গেল। আমরা হলে ঢুকে নিজ নিজ আসনে বসে পড়ি। আমার খুব পছন্দের এই অডিটোরিয়াম।
অদিতি মুন্সি ওপার বাংলার শিল্পী, তাই ওপার বাংলার অনেককে চোখে পড়লো। তাদের উশখুশ করতে দেখলাম দেরী হতে দেখে। ৭.২৫ মিনিটে সঞ্চালক শুভজিৎ মঞ্চে আসেন। তিনি দর্শকদের আশ্বস্ত করেন যে আর ৫ মিনিটের মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু হবে। আমরা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঘড়ির কাঁটা যখন ৮ টা ছুঁই ছুঁই তখন আবার মঞ্চে আসেন শুভজিৎ সাথে শুভমিতা। তারা কীর্তনের ইতিহাস এবং এর সাথে অদিতির যোগসূত্রের কথা বললেন। মায়ের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কীর্তন শিখেছেন তিনি, মা ছিলেন তাঁর প্রথম গুরু। স্কলারশিপ নিয়ে রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কীর্তনের ওপর লেখাপড়া করেছেন। অত্যন্ত মেধাবী এই শিল্পী পরে পশ্চিম বাংলা সরকারের বৃত্তি নিয়ে পদাবলী কীর্তনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ২০১৫ সালে কোলকাতার একটি গানের রিয়ালিটি টিভি শো সা-রে-গা-মা-পা তে বিজয়ী হয়ে তিনি রাতারাতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যান। অনেকেই বলে থাকেন তিনি কীর্তনকে পুনর্জন্ম দিয়েছেন।
স্থানীয় শিল্পীদের নাচ “মধুর ধ্বনি বাজে” দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান, এরপর ছিল গীতাঞ্জলী ডান্স এবং পারফরমিং আর্টস স্কুলের আরেকটি নাচ। এরপর সবার প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে মঞ্চে আসেন অদিতি মুন্সি, সাথে কোলকাতা থেকে আগত দুজন যন্ত্রী, ঢোলক ও তবলায় অনুপম চক্রবর্তী, হারমোনিয়ামে অরুণাভ গুপ্ত, কীবোর্ডে স্থানীয় উদীয়মান কিশোর শিল্পী নীলাদ্রী চক্রবর্তী। দর্শকরা করতালি দিয়ে তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। শিল্পীও বেশ কিছুক্ষণ শুধু বাদ্য যন্ত্রের মূর্ছনায় একটা আবহ তৈরি করলেন! এরপর তিনি গাইতে থাকেন তার অসাধারণ সব কীর্তন, প্রথমটি ছিল - বৃন্দাবনে রাই আমাদের বিলাসিনী।
এর পর একে একে গাইতে থাকেন - হরে কৃষ্ণ নাম দিল প্রিয় বলরাম, ছেড়ে দিলে সোনার গৌড় আর পাবেনা। কীর্তনে যেমন হয়, কিছু গান কিছু কথা আবার সেই কথাকে সুর দিয়ে গাওয়া। এভাবেই কথা আর গান চলতে থাকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত। তারপর রাতের খাবারের বিরতি। জমজমাট অনুষ্ঠানের পর বিরতির সময় সবার মুখেই হাসি আর উচ্ছ্বাস লক্ষ করেছি। শিল্পী সত্যি এক অপূর্ব কথা ও সুরের সমন্বয় সৃষ্টি করেছিলেন মঞ্চে! বিরতির সময় আয়োজকদের সাথে কথা বলে জানা গেল সকল আসন পূর্ণ না হওয়ার কারণ। ঐ দিন ছিল একটি বাংলা মেলা সহ আরো করেকটি অনুষ্ঠান। তারপরও ৭০ শতাংশ টিকিট বিক্রী করতে সক্ষম হয়েছেন আয়োজকরা। তবে এটাও শুনেছি অনেক টিকিট করেও আসতে পারেননি।
বিরতির পর BSPC এর সভাপতি উৎপল সাহা তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে ধন্যবাদ জানান স্পন্সর ও স্বেচ্ছা সেবকদের এবং ফুলের তোড়া ও ক্রেস্ট উপহার দেন শিল্পীদের। ২য় পর্বে শিল্পী কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের একটি ভাঙ্গা গান দিয়ে শুরু করেন এবং শ্রোতাদেরও গাইতে বলেন তার সাথে - যদি তোর ডাক শুনে কেও না আসে / একলা নিতাই। এরপরে আরো কিছু গান: তোমার কুঞ্জ সাজাও, এসো মা লক্ষ্মী বসো মা ঘরে, সুখ বলে আমার কৃষ্ণ, খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায় ইত্যাদি। আদিতি মুন্সি তার কথা ও সুরের মুন্সিয়ানা দিয়ে শ্রোতাদের বিমোহিত করে রেখেছিলেন পুরোটা সময় ধরে! তার গানের রেশ সিডনির দর্শকদের অন্তরে গেঁথে থাকবে অনেক দিন।
স্থানীয় কিশোরী নৃত্য শিল্পীদের সাথে অদিতি মুন্সি
মমতাজ রহমান চম্পা, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
ছবিঃ BSPC
|