৭১ এর ঝাপসা স্মৃতি! মম্তাজ রহমান
আগের অংশ
আমাদের বাড়িটা ছিল একটা সম্ভ্রান্ত হিন্দু পাড়ায়। সবারি ছিল মোটামুটি বড় বড় বাড়ী। একে একে সব বাড়ীগুলি খালি হয়ে যেতে লাগল। কোনমতে তালা লাগিয়ে কে যে কোথায় গেল! আমরা ক্রমশ: একা হয়ে যেতে লাগলাম। মাঝে মাঝে ভাইরা যখন বাড়ী আসতো তখন আম্মাকে বলতো কোন হিন্দুর বাড়িতে কে তালা লাগিয়ে দিল, সোজা কথায় দখল করলো। যেন মগের মুলুক! এই নিম্নস্তরের বিহারিদের ঔদ্ধত্য বেড়েই চলল দিনকে দিন। যারা আমাদের সাহায্য পুষ্ট ছিল তাঁরাই মাথায় উঠে বসলো। আমাদের বাড়িতে সেলাই মেশিন ছিল বলে তারা বিভিন্ন দোকান থেকে থানের পর থান লুট করা কাপড় আমাদের বাসায় নিয়ে আসতো সেলাই করে দেবার জন্য। আম্মা ভয়ে কিছুই বলতে পারত না। আমার বোনেরা সারা দিন-রাত ওদের কাপড় সেলাই করত। মাঝে মাঝে ওরা বিদ্রোহ করে আম্মাকে বলত ঐ লুটের কাপড়ে হাত দিতে পারব না। আম্মার ছিল উভয় শঙ্কট। মেয়েদের কি করে বোঝাবে ওদের কথা না শুনলে আমাদের কত বড় মূল্য দিতে হবে! যখনি শুনি মিলিটারি আসছে আমারা এ বাড়ী থেকে ও বাড়ী পালিয়ে বেড়াই। ব্যাগ গুছানোই থাকতো। আম্মা বলতেন আমর যা হয় হবে তোমরা বাসায় থাকবে না পিছনের দরজা দিয়ে পালাবে। বড় বাড়ী থাকার অনেক সুবিধা!
একদিন ভয় পেয়ে আম্মা আমাদের পালিয়ে পাশের বাড়িতে যেয়ে আশ্রয় নিতে বললেন। আমাদের পাশের বাসায় তখন রাজশাহী ইউনিভার্সিটির অবসর প্রাপ্ত কোষাধ্যক্ষ থাকতেন। উনি আমার দাদার বন্ধু ছিলেন। উনাকে আমরা দাদা ডাকতাম। অনেক ডাকাডাকির পর দাদা আমাদের ছাদ থেকে দেখে কাউকে দরজা খুলতে বললেন। উনার নাতনি খুবই বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে বলল আপনাদের জন্য যদি আমাদের বাড়িতে মিলিটারি আসে তখন কি হবে? খুবই সত্যি কথা! আমার বোনরা কোন জবাব দিতে পারেনি! আমরা ওখানে বেশী ক্ষণ থাকিওনি।
বাড়িতে দেখতাম সবাই কি যেন শোনে আমি বুঝতেও পারতাম না শোনার চেষ্টাও করিনি। ওদের দেখতাম রেডিওর সেই ডায়লগ ওরা আউরে খুব মজা পাচ্ছে। পড়ে জেনেছি ওরা বিখ্যাত সেই চরম পত্র শুনত। আরও অনেকেই লুকিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার শুনত। সেটা শোনার জন্য আমাদের দুই বাড়ী পরের এক বাড়িতে যা ঘটেছিলো তা মনে করলে এখনও এত কষ্ট হয় তা বলার না। ওরা মনে হয় সিগন্যাল পাচ্ছিলো না তাই বাড়ীর ছাঁদে গিয়ে রেডিও শুনছিল। কেউ মিলিটারি কে খবর দিতে পারে বা ওরা হয়ত খোঁজ পেয়েছিল ঐ বাসায় বড় ছেলে আছে। মিলিটারি হটাৎ ওদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। এলোপাথাড়ি গুলী করে বাড়ীর তিন ছেলে আর একজন জামাই কে মা বোনের সামনে মেরে ফেলে। জামাইটা প্রাচীর টপকে পালাতে গিয়েও পারেনি। এই গোলাগুলি আমাদের বাড়িতেও এসে লেগেছিল। দোতালার ঘরের জানালার কাঁচে গুলী লেগে খান খান হয়ে ভেঙ্গে গেল। পরে নতুন কাঁচ লাগান হলেও কাঠের গায়ে গুলির দাগ এখনও আছে। যা বলছিলাম - বেলা বাড়তে লাগলো ঐ বাড়ীর মা বোন রা কি করছিলো বলতে পারব না। উঠানে রৌদ্রে লাশগুলো পড়েছিল, মাছি বসছিলো। কেউ এগিয়ে আসেনি। সবাই নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। আম্মা অস্থির হয়ে আমাদের বাড়ীর সেই কাজের লোক রশিদকে প্রায় হাতে পায়ে ধরে কয়েক জন লোক জোগাড় করে ঐ বাড়িরই উঠানের একপাশে ওঁদের কবর দেয়ালেন। রুটি বানিয়ে বাড়ির মেয়েদের জন্য পাঠিয়েছিলেন। উনারা খেতে পেরেছিল কি? জানিনা! ওরা ঐ বাড়ী ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। দেশ স্বাধীন হবার পর ওরা ফিরে এসেছিলো। ঐ মাকে কত দিন যে চীৎকার করে কাঁদতে দেখেছি! তখন তো আমি একটু বড়, বেশ মনে আছে।
এর পর শুরু হোল আকাশ থেকে হামলা। একদিন দেখলাম ঘন ঘন প্লেন আসছে আর কান ফাটানো শব্দ হচ্ছে। আকাশে আলো ঝলসে ঝলসে উঠছে। এবারও কারও পরামর্শে আমাদের বাড়িতে দুইটা ট্রেঞ্চ খোঁড়া হোল একটা "v" শেপের আরেক টা ছিল " I" এর মতো। উপরে ঢেউ টিন দিয়ে ঢেকে তার ওপরে খড় রাখা হয়ে ছিল। বোমারু বিমানের আগে আগে হেলিকপ্টার আসত। হেলিকপ্টার দেখলে বিহারী রশিদ খুব খুশী হতো। ঐ রশিদ হেলিকপ্টারকে বলতো, উপার পাঙ্খা-ওয়ালা, আর বোমারু বিমান কে বলত "খাতরনাক"। ও জানত উপার পাঙ্খা-ওয়ালা মানেই পিছে পিছে খতরনাক এসে সব গুড়িয়ে দিয়ে যাবে।
আমার ৪ বছরের বড় বোন যা করত আমিও তাই করতাম। একদিন ও ঐ ট্রেঞ্চ খোরার নরম মাটি দিয়ে কতগুলো পুতুল বানাচ্ছিল আর পেনের লাল খাপ মাথায় ক্যাপ এর মতো বসিয়ে একটার নাম রাখল টিক্কা খান, আরেকটা নিয়াজি। তারপর জুতা দিয়ে খুব পিটিয়েছিল। এই নতুন খেলায় আমিও খুব মজা পেয়েছিলাম। আম্মা দেখে খুব বকেছিলো। যদি কেউ দেখে ফেলত তাহলে কি হতো! আমার ছোট ভাই, ওর বয়েস তখন ৯ কি ১০ বছর। ও ডাইরি লিখত। যা স্বাধীনতার পরে আবিষ্কৃত হয়। বড়রা অনেক হাসাহাসি করেছিলো তা নিয়ে। ওর একটা কবিতার লাইন আমার এখনও মনে আছে। সবার সাথে একটু শেয়ার করতে ইচ্ছা করছে - ওর ছোট মনে যে তোলপাড় হয়েছিল বেচারি তাই কবিতায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিল। "তারা কি জানে না আমরা বাঙ্গালী করিতেও জানি যুদ্ধ / কি করিয়া তারা মোদের নেতাকে করিল কারারুদ্ধ"। আমার কিন্তু খুবই খারাপ লাগত সবাই যখন ওকে নিয়ে হাসাহাসি করতো।
মাঝে মাঝে কোন নতুন ফকির বা ফেরিওয়ালা এসে খাবার চাইলে আম্মা তাড়াতাড়ি ঘরে যা থাকতো তাই দিয়ে খেতে দিতো। আম্মার ধারনা ছিল ওরা মুক্তিবাহিনীর লোক। মনে মনে সাহস হতো আর ভয় নাই! ওরা আমাদের রক্ষা করবে। একদিন সত্যি ওরা দেশ স্বাধীন করলো। আমি তখন স্বাধীনতা মানে কি বুঝে ছিলাম জানিনা, এটুকু বুঝে ছিলাম - কেও আর আমাদের মারতে আসবে না; আর মানুষের বাড়িতে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে না; আমার প্রিয় ছাদে উঠতে পারবো; বাইরে মাঠে খেলতে পারবো; জোরে কথা বলতে পারবো - এটাই ছিল আমার স্বাধীনতা। সেদিন সব কিছু ম্যাজিক এর মতো লাগছিল। রাস্তায় কোথা থেকে মানুষ এসে ভরে গেল। ট্রাক ভরে ভরে মুক্তিযোদ্ধারা যাচ্ছিল। মানুষ জন চীৎকার করে জয় বাংলা বলছিল। মাইকে জোরে জোরে গান আর মাঝে মাঝে বক্তৃতা বাজানো হচ্ছিল পড়ে জেনেছি ওটা ছিল ৭ই মার্চ এর ঐতিহাসিক ভাষণ।
সম্ভবত: ১৭ বা ১৮ই ডিসেম্বর আমাদের বাড়িতে সকাল থেকে ভাইদের বন্ধুদের আনা গোনা শুরু হলো। ওরা অনেক ফুল দিয়ে মালা, তোড় কত কি বানিয়ে রাজশাহী stadium নিয়ে গেল - মুক্তিযোদ্ধা দের সম্বর্ধনা দেবার জন্য। আমরা দূরে দাড়িয়ে দেখলাম। যেতে না পারার জন্য মন একটু খারাপ হয়েছিলো। আমার পিঠাপিঠি বোনটা বললো, চল ওরা যে ফুলগুলো ফেলে গিয়েছে ওগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে পাপড়ি গুলো এক যায়গায় করি। ওর অনেক বুদ্ধি ছিল। রাস্তায় দাড়িয়ে থেকে যখনি কোন মুক্তিবাহিনীর ট্রাক যাচ্ছিলো আমরা ঐ পাপড়ি গুলো ছুঁড়ছিলাম। কি যে আনন্দ পেয়েছিলাম!
আমার বোন কোন নিউজ পেপার থেকে বঙ্গবন্ধুর একটা ছবি কেটে ছাদের উপর কতগুলো ইট দিয়ে উঁচু করে ছবিটা রেখেছিলো। তার উপর ফুলেরে মালা ফুলের পাপড়ি দিয়ে কি সুন্দর একটা বেদি বানিয়েছিলো। আমিও ওর সাথে এসব করতাম। আমাদের পাড়া প্রতিবেশীর ছেলে-মেয়েরাও আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলো। পাকিস্তানি পতাকা পুড়াল ভাইরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা কিনে ছাদে লাগাল। সবুজের মধ্যে লাল আর লালের ভিতর হলুদ বাংলাদেশের ম্যাপ।
যখন স্কুলে ভর্তি হলাম ঈদের থেকেও বেশী আনন্দ লাগত ১৬ই ডিসেম্বর দিনটা এলে। রাতে ঘুম হতো না কখন সবার আগে উঠে পতাকা উঠাবো সেটা ভেবে। দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে বিভিন্ন স্কুলের বিজয় মিছিল দেখতাম। সন্ধ্যায় পতাকা নামানোর সময় ২৬শে মার্চ এর জন্য অপেক্ষা করতাম। জানিনা আজও স্কুলের বাচ্চা রা তেমন আনন্দ পায় কিনা? এখানে অপ্রাসঙ্গিক একটা বিষয়ে উল্লেখ না করে পারছি না - ২০১৪ এর ডিসেম্বর দেশে গিয়ে আমি আবারও সেই ৭১এর মৃত্যুভয় পেলাম। আমার প্রতিটি যাত্রা ছিল অনিশ্চিত। যখন-তখন ট্রেন বাসে আগুন। পেট্রোল বোমা আমাকে ৭১এর ভয়ংকর স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছিলো। এখন তো দেশে কোন পাকিস্তানি নেই তবু কেন আমাকে আমার ১০ বছরের ছেলে নিয়ে বাংলাদেশে অনিশ্চিত সময় কাটাতে হবে। মনের মধ্যে একটা লাইন বারবার উঁকি দিয়েছে - "হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোন খানে"। অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে মনে হোল স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেম। কিন্তু যাদের ঐ মৃত্যু পুরীতে রেখে এলাম তাদের জন্য মন খারাপ হয়।
- শেষ -
মম্তাজ রহমান, সিডনি
|