শান্তিনিকেতন মলি আহমেদ
সাথে করে নিয়ে এসেছি মৃত্যুহীন প্রাণ। আর সেই প্রাণের কলধ্বনিতে, বসন্তের পঞ্চম রাগে প্রাণের প্লাবনে উচ্ছলিত হয়ে উঠে ক’জন নবীন কিশলয় - লিনু, রোজী, রিনা আপা, জিয়া,আমি। আমরা বন্ধু চিরকাল, অর্ধ শতাব্দী পার করেছি একসাথে। জীবন আর জীবিকার তাগিদে আমি এখন সিডনিতে আর রোজী আমেরিকায়। যখন ঢাকায় যাই লিনু, রিনা আপা আর আমি কারণে, অকারণে এক সাথে হই। কখনো বই মেলা, কখনো পূর্বাচলের রাস্তা ধরে দু’পাশের সবুজ বনানী আর জনপদ পার হওয়া, কখনো “মাটির ঘর” এ গিয়ে পিঠা খাওয়া।
রোজীর সাথে আমার ঢাকায় যাওয়ার সময়টা ঠিক মেলেনা। ২০২০শে দেখা গেল, আমি যে সময় যাব তখন রোজী ঢাকায় থাকবে। লিনুর সাথে ঠিক করলাম রোজী যখন আছে তখন সবাই মিলে একটি বেড়ানোর প্ল্যান করি। ঠিক করা হল কলকাতা হয়ে শান্তিনিকেতন যাব। আর শান্তিনিকেতন থেকে শুধু রোজী ফিরে যাবে ঢাকা। ওর কাজ আছে ঢাকায়। আমরা বাকি ক’জন চেন্নাই আর পন্ডিচেরী যাব।
শান্তিনিকেতনে জিয়া আর আমি আগেও গিয়েছি। যদিও সেটা বেশ কয়েক বছর আগে। কিন্তু এ এমন এক জায়গা বারবার প্রাণের টানে ফিরে যেতে মন চায়। শাল বনের মাঝ দিয়ে লাল মাটির রাস্তা খোয়াইয়ের সোনাঝুরি গ্রাম পেরিয়ে চলে গিয়েছে কোন অজানা উদ্দেশ্যে। তাল তমাল, শাল আর ঘন আকাশমণির বুনো জঙ্গলের দীর্ঘ ছায়া খেলা করে কোপাইয়ের গভীর জলে। প্রকৃতি আর জীবন এইখানেই যেন প্রাণ পেয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুরের ভুবনডাঙায় এসেছিলেন। একটা ছাতিম গাছের তলায় বসে বিশ্রাম নেবার সময় ভুবনডাঙার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এবং এই জায়গার অসাধারণ নীরবতার মাঝে তাঁর আত্মা প্রশান্তিতে ভরে উঠে। ঈশ্বরের আরাধনার উপযুক্ত যায়গা।
ছাতিম গাছ ১৮৬৩ সালে তিনি এখানে ২০ বিঘা জমি কিনে নেন এবং একটি বাড়ী তৈরি করে নাম দিয়েছিলেন ‘শান্তিনিকেতন গৃহ’ যার দেয়ালে খোদাই করা আছে- ‘সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং’ (সর্বদা নিজ প্রাণে মনে আনন্দ)। পরে ভুবনডাঙার নাম পরিবর্তন হয়ে শান্তিনিকেতন হয়।
এই শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন কালের মুনি ঋষিদের তপোবনের আদলে তৈরি করেছিলেন বিশ্বভারতী। লাল মাটি, নীল আকাশ, সবুজে মোড়া আম্রকুঞ্জ, শালবীথি, গোয়ালপাড়া, সেই সাঁওতাল পল্লী, খোয়াই ও কোপাইয়ের মাঝে এসে দাঁড়ালে মনে হয় এ যেন বিশ্ব প্রকৃতির অপরূপ একখানি রূপকথার রাজ্য। সেই বাগান, সেই রামকিঙ্কর বেইজের তৈরি ভাস্কর্য, নন্দলাল বসুর সুচারু শিল্প, কালো বাড়ি, সেই কাঁচের তৈরি উপাসনা গৃহ, গাছতলায় পড়াশুনা, সেই দেয়ালে বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়ের নিজের গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে করা অপূর্ব মিউরাল, সোমনাথ হোরের আঁকা ছবি, অসাধারণ চারুকলা গৃহ, টেক্সটাইল বিভাগ, কলা ভবন, শিল্পীদের করা মনোহরণ বিচিত্র সব অপূর্ব চিত্রে চিত্রিত ভবনের দেয়াল, ছাতিম তলায় বসে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপলব্ধি....... “প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি” এই সব কিছুর মাঝে মনে হয় সমগ্র বিশ্ব এই খানে ছুটে এসেছে , লুটিয়ে পড়েছে এই মাটির ধরাতলে। মনের কোনে আলোড়িত হয় ‘দিকে দিগন্তে যত আনন্দ লভিয়াছে এক গভীর গন্ধ...’।
সারা বিশ্ব থেকে মানুষজন আসে এই রবিতীর্থ পরিদর্শনে।
রোজী, আমি, লিনু আর রিনা আপা শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণ চত্বরে পাঁচটা বাড়ী। কাছাকাছি, পাশাপাশি। উদয়ন, কোনার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ, উদীচী। এই পাঁচটা বাড়ীতেই রবীন্দ্রনাথ কমবেশি সময় বসবাস করেছেন। রবিঠাকুরের মন এক পরিবেশে, এক ঘরের দেওয়ালের মধ্যে বেশি দিন আবদ্ধ হয়ে থাকতে চায় না। নতুন লেখার জন্য সব সময় খুঁজেছেন নতুন পরিবেশ। বিভিন্ন সময়ে এই সব গৃহে রবীন্দ্রনাথ বাস করেছেন এবং এইখানে বসে তিনি করে গিয়েছেন অসাধারণ সব রচনা।
পাঁচটা বাড়ীর মাঝে আমাকে শ্যামলী বাড়ীটা খুব টানে। কি যেন এক আশ্চর্য বিস্ময় আছে বাড়ীটিকে ঘিরে। বাড়ীটি মাটির এমন কি তার ছাদটিও মাটির। দরিদ্র পল্লী এলাকায় শনের তৈরি বাড়ী গুলি প্রায় আগুন লেগে পুড়ে যেত। রবীন্দ্রনাথ সেই কথা ভেবে একটা মাটির বাড়ী বানাবার পরিকল্পনা করেন যার ছাদটাও মাটির হবে যাতে আগুনের হাত থেকে রক্ষা পায়, আর এই বাড়ীটা যেন অন্য সবাইকে আগ্রহী আর অনুপ্রাণিত করে এমন বাড়ী তৈরির জন্য। এই অভূতপূর্ব ও অভিনব পরিকল্পনাটি রূপায়নের দায়িত্ব পড়েছিল শিল্পী সুরেন্দ্রনাথ করের ওপর।
“শ্যামলী” শ্যামলী বাড়ীর দুই পুরু দেয়ালের মাঝে বড় বড় খালি কলস ভরে দেয়া হয়েছে যেন ঘরটা ঠাণ্ডা থাকে। বাড়ী তৈরির পর নন্দলাল বসু ও তাঁর কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা বাড়ীর বাইরে মাটির দেওয়ালে নানা মূর্তি ও শান্তিনিকেতনের জীবনযাত্রার নানা ছবি এঁকে তাকে অপরূপ করে তোলেন। বাড়িটির গায়ে শিল্পী রামকিঙ্কর ফুটিয়ে তোলেন কয়েক জন সাঁওতাল রমণীর চেহারা— অপূর্ব সেই শিল্পকর্মটি। মন কেড়ে নেয়া সৌন্দর্য। পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ এই বাড়ীটিতে অনেকটা সময়ই থেকেছেন। পঁচাত্তর-তম জন্মদিনের পর শ্যামলীতে বসবাস করতে আরম্ভ করেন রবীন্দ্রনাথ।
আমি আর জিয়া ১৯৯৭ সালে গিয়েছিলাম তখন সব বাড়ী গুলি ভিতর ঢুকে ঘুরে দেখেছিলাম। এবার গিয়ে জানলাম ভিতরে যাওয়া নিষেধ।
১৯৯৭ সালে শ্যামলী বাড়ীর ভিতর এই শ্যামলী বাড়ীতেই রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা গান্ধী’কে আপ্যায়ন করেছিলেন। গান্ধীজী এবং কস্তূরী দেবী অতিথি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের। আমার মনে আছে যে ঘরটিতে দুজনে বসে কথা বলেছিলেন সে ঘরটি তেমনি আছে। যে দুটি চেয়ারে তাঁরা বসেছিলেন সে চেয়ার দুটিও তেমন আছে। মুহূর্তে সমস্ত শরীরে মনে প্রাণে কেমন যেন একটা অদ্ভুত একটা শিহরণ বয়ে গিয়েছিল। এই সেই ঘর!!! আমি ওখানে দাঁড়িয়ে কি অনুভব করছি আর আমার কি রকম অনুভূতি হয়েছিল সেটা প্রকাশের ক্ষমতা আমার নেই। শুধু অকারণে মনটা ভারী হয়ে উঠছিল আর চোখে জল আসছিল। সে এক অভূতপূর্ব আর অসম্ভব অভিজ্ঞতা।
মহাত্মা গান্ধী রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরেও এসে শ্যামলী বাড়ীতেই থেকেছেন ।
রবীন্দ্রনাথ এই বাড়ীতেই বসে লিখেছেন ‘শ্যামলী’ কাব্য সমগ্র। যা এই বাড়ীটাকে দিয়েছে অমরত্ব অতি সহজে। ১৯৩৬ সালে শ্যামলী কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর শেষ জীবনে এমন একটা ঘর বানিয়েছেন যার নাম দিয়েছেন শ্যামলী। আজীবন মাটি রবীন্দ্রনাথ কে টেনেছে চির মুক্তির প্রত্যাশায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ বয়সে এই মাটির বাড়ির ভিত গেঁথেছেন যার সাথে সাথে জীবনের যত হতাশা, ক্ষতি আর ক্ষত যত, যতই বিচ্ছেদের ব্যথা, এর মাঝেই হবে সব বেদনার বিস্মৃতি। সব কলঙ্কের মার্জনা তার সবই বিলীন হবে।যা কিছু বিকার যত সব বিদ্রূপ তার সবটুকুই ঢেকে যাবে নব দূর্বাদলের স্নিগ্ধ সৌজন্যে ধুলো মাটির সাথে সাথে। মৃত্যুর পর মানুষ বিলীন হয়ে যায় এই ধরণীর ধূলিতে। তাই ধুলোমাটি দিয়েই তৈরি এই একতলা বাড়ী যার নাম ‘শ্যামলী’।
“আমার শেষবেলাকার ঘরখানি বানিয়ে রেখে যাব মাটিতে, তার নাম দেব শ্যামলী। ও যখন পড়বে ভেঙে সে হবে ঘুমিয়ে পড়ার মতো, মাটির কোলে মিশবে মাটি...........”
শান্তিনিকেতনের প্রতিটা জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখেছি আর অনুভব করেছি... এই খানে এমন একজন বাস করে গিয়েছেন যে দিয়ে গেছেন এক মনোরম পরিবেশ, আধ্যাত্মিক মনন আর সমগ্র জীবন যাত্রার এক আশ্চর্য পথ। কি আছে পথের শেষে!!? পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে! কে জানে কে বলে দেবে!!?
বিশ্বভারতীর উন্মুক্ত ক্লাসরুম একটা অসম্ভব সুন্দর সময় কাটিয়ে আমরা ফিরে এসেছি। রোজী চলে গেল আমেরিকায়, আমি চলে এসেছি সিডনি। রিনা আপা ব্যস্ত তার অসংখ্য কাজে কর্মে। লিনু প্রস্তুতি নিচ্ছে ঈশিতার কাছে ইংল্যান্ড যাবার। জিয়া সিডনির টাউন প্ল্যানিং নিয়ে কাজে ব্যস্ত। জানি না কার মনে কি হচ্ছে! কিন্তু “দূরে কোথায় দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে...।” আমি ফিরে এসেছি সেই কবে শান্তিনিকেতন থেকে কিন্তু আমার মন এখনো হেঁটে বেড়াচ্ছে শ্যামলী বাড়ীর সবুজ চত্বরে, মাটির দেয়ালের কোল ঘেঁসে, অনিন্দ্যসুন্দর সেই সব বিমূর্ত ভাস্কর্য ঘিরে। এ জীবনে সেই পরিক্রমা আমার ফুরবে না।
নন্দলাল বসু ও রামকিঙ্কর বেইজের উদ্যোগে মাটি দিয়ে তৈরি কালো বাড়ী – এক সময় কলাভবনের ছাত্রদের আবাসস্থল ছিল
‘কাঁচঘর’ উপাসনালয়
মলি আহমেদ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|