প্রয়াগরাজ মলি আহমেদ
“এবার আমায় ডাকলে দূরে সাগর-পারের গোপন পুরে॥”
কোথায় যাওয়া যায়?! এটা আমাদের একটি প্রিয় আলোচনার বিষয়। যাই বা না যাই, তবু ভাবনার সংগে রং লাগিয়ে কল্পনার জগতটাকে কিছুটা সময়ের জন্য রঙিন করতে কখনই পিছু হটি না। একটা ট্রিপ থেকে ফিরে আসবার পর মন বসে না ঘরে। কিছুদিন যেতে না যেতেই ভাবতে থাকি আবার কোথায় যাওয়া যায়। যাযাবর জীবন যেন। ঘুরে বেড়াবার এক অদম্য পিপাসা সব সময় মনকে টানে।
সিডনি থেকে ঢাকা গেলে চেষ্টা করি আশেপাশের কোন একটা দেশে যাবার। এই করে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, নেপাল, সিকিম সহ বেশ কয়েক বার ইন্ডিয়াতেও যাওয়া হয়েছে। ২০১৭তে ঢাকা যাবার আগে শম্পা আর আশীষ'দার সাথে একটা ইন্ডিয়া ট্রিপের প্ল্যান করলাম। ওরা সিডনি থেকে ইন্ডিয়া যাচ্ছে। জিয়া আর আমি ঢাকা হয়ে ওদের সাথে কোলকাতায় একসাথে হব। মজার একটা ট্রিপ করেছিলাম সেবার। শুধু আমাদের দু’জনের ঘোরাঘুরি আর বন্ধু’র সাথে ঘোরা একদম দুই জিনিষ। আনন্দটা দ্বিগুণ হয়ে উঠে বন্ধুরা সাথে থাকলে।
আমরা বেনারাস, এলাহাবাদ, লক্ষ্ণৌ আর কোলকাতা ঘুরেছিলাম এক সাথে। কোলকাতা ঘুরবার মধ্যে আমার কাছে একটা আলাদা মজা আছে। কোলকাতায় গেলে বই পাড়া, বিশেষ করে কলেজ স্ট্রিটে মিত্র এন্ড ঘোষে গিয়ে শ্রদ্ধেয় ভানু’দার সাথে সময় কাটানো, নতুন বই কেনা, কফি হাউসে ঢু দেয়া, নন্দনে নাটক দেখা, মাটির খুরিতে চা খাওয়া এই সব কিছুর মধ্যে কেমন যেন একটা আমার প্রাণের পরশ খুঁজে পাই।
কোলকাতার পর বেনারাসে সুন্দর সময় কাটিয়ে লক্ষ্ণৌ যাবার পথে এলাহাবাদ এসে পৌঁছালাম। এখানে আমরা একটা ‘বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট’ এ ছিলাম। বাড়িটা বেশ পুরনো। প্রচুর গাছ পালা চারিদিকে। বাড়ির মালিক দোতলায় থাকেন। হাসিখুশি একজন হোস্ট। আমাদের থাকার দিনগুলো তাঁর যত্নে ভাল কেটেছিল।
এলাহাবাদ পুরানো ও সুন্দর পরিচ্ছন্ন শহর। ভাল ভাল কিছু দর্শনীয় জায়গা আছে। হাতে আছে দুইদিন এর ভিতর যা দেখার তা দেখতে হবে। ১৬ শতকের শেষের দিকে ভারতে মোঘল শাসনামলে এ জায়গার প্রাচীন নাম ‘প্রয়াগরাজ’ পাল্টে এলাহাবাদ রাখা হয়েছিলো। সংস্কৃত শব্দ ‘প্রয়াগ’এর অর্থ হলো উৎসর্গ বা নৈবেদ্য। প্রাচীন শাস্ত্রে আছে গঙ্গা ও যমুনা নদীর মোহনায় সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মা প্রথম নৈবেদ্য নিবেদন করেছিলেন। ২০১৮তে এলাহাবাদ শহরের নাম পরিবর্তন করে আবার প্রয়াগরাজ রাখা হয়।
এখানে একটি সুন্দর মিউজিয়াম আছে কিন্তু সেদিন বন্ধ থাকায় আমরা মতিলাল নেহেরুর বাড়ি “স্বরাজ ভবন” বা “আনন্দ ভবন” দেখতে গেলাম। এই বাড়িতেই মতিলাল নেহেরুর পুত্র জহরলাল নেহেরু এবং পৌত্রী ইন্দিরা গান্ধী জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। বাড়িটির প্রাঙ্গণে ঢোকার পর পরেই ইন্দিরা গান্ধীর ছবি সহ একটি নাম ফলক আছে যা’তে বাড়িটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখা আছে। ১৯৭০ সালে ইন্দিরা গান্ধী বাড়িটা ভারত সরকারকে দান করেন। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা, উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস সূচনার সাক্ষী হয়ে আছে এই বাড়ি। মহাত্মা গান্ধী এ বাড়িতে অতিথি হয়েছেন বহুবার। এখানে রয়েছে প্রচুর ছবি, মূল্যবান দলিলপত্র, ঐতিহাসিক স্মারকলিপি, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যার অপরিসীম ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। উপমহাদেশের ইতিহাসের বিশেষ এক সময়ের কথা এ বাড়ির প্রতি দেয়ালে দেয়ালে প্রথিত এবং মুদ্রিত আছে। অনেকটা সময় আমরা কাটিয়েছিলাম আনন্দ ভবনে।
প্রয়াগ বা এলাহাবাদ বিশেষ ভাবে পরিচিত ত্রিবেণী-সঙ্গমের কারণে। ত্রিবেণী-সঙ্গম গঙ্গা, যমুনা এবং সরস্বতী এই তিনটি নদীর মিলনস্থল। বৈদিক যুগ থেকে সরস্বতী নদীর কথা নানা জায়গাতে লেখা থাকলেও বর্তমান যুগে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। প্রাচীন শাস্ত্র থেকে জানা যায় এই ত্রিবেণী-সঙ্গমে সরস্বতী নদী অন্তঃসলিলা অর্থাৎ অদৃশ্য অবস্থায় যমুনার নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। নদী গবেষকদের মতে যমুনা এককালে ‘ঘাগড়’ নদীর উপনদী ছিল। প্রাচীনযুগে এই ঘাগড় নদীটি সরস্বতী নদী নামে পরিচিত ছিল। সরস্বতী, গঙ্গা, যমুনা, সিন্ধু, কাবেরী, গোদাভারী ও নর্মদাকে বলা হত ‘সপ্তসিন্ধু’।
মধ্য হিমালয় থেকে যমুনা নদী নীচে নেমে এসেছে। ভূতাত্ত্বিকদের মতে প্রায় ৬০০০ বছর আগে যমুনা তার গতি পরিবর্তন করে গঙ্গার উপনদীতে পরিণত হয়। মনে করা হয়, এ সময়েই সরস্বতী নদীটি মিলিয়ে যায়। কিন্তু তবুও এলাহাবাদের ত্রিবেনী-সঙ্গমে গঙ্গা ও যমুনার জলধারার সংগে মিলিত তৃতীয় জলধারাকে অন্তঃসলিলা সরস্বতীর জলধারা রূপে কল্পনা করা হয়।
সরস্বতী ও গঙ্গা’র মত যমুনাকেও পবিত্র নদী বলে ধরা হয়। সংস্কৃত ভাষায় যমুনা শব্দের অর্থ যমজ। প্রাচীন শাস্ত্রে আছে সূর্য ও তার পত্নী সমজ্ঞার কন্যা যমুনা এবং পুত্র যম। মানুষ বিশ্বাস করে যমুনার জল মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে। এই যমুনার জলে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম লীলার অনেক গল্প কাহিনী আমরা জানি। কৃষ্ণের সহস্র প্রেমিকার মাঝে যমুনাও তার প্রেমিক কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হতে এবং জগতের পাপ-স্খলন করতে মর্ত্যে অবতরণ করেছিল। ত্রিবেণী-সঙ্গম জায়গাটি একটা তীর্থ স্থান হিসাবে পরিচিত। পুণ্য অর্জনের জন্য ভক্ত প্রাণ মানুষ এই ত্রিবেণী-সঙ্গমে স্নান করে। মহাত্মা গান্ধী সহ বহু ভারতীয় রাজনীতিবিদের দেহভষ্ম এখানেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই নদী তীরেই বারো বছর পর পর হয় কুম্ভ মেলা। নানা ধরনের পসরা সাজিয়ে কেনা বেচার এক জমজমাট আয়োজনে জমে উঠে এ মেলা। নদী পাড়ে জমায়েত হয় হাজার হাজার মানুষ। ছোট বড়, ধনী নির্ধন ভেদ নেই এখানে। সাধুসন্ন্যাসী, বৈষ্ণব, বৈরাগী, নাগা, আউল, বাউল, পরমহংস, অবধূত, বৌদ্ধ, জৈন, এ ছাড়াও এখানে আসে সাধারণ গৃহী মানুষেরা। আর আসে পুণ্য লোভী মানুষেরা যারা সূর্য প্রণাম করে, স্নান করে শুদ্ধ হবার প্রত্যাশা করে।
সমস্ত সমুদ্র মন্থন করে অমৃত সংগ্রহ করেছিলেন অসুর এবং দেবতারা মিলে। অসুরদেরকে অমৃত থেকে বঞ্চিত করবার জন্য দেবতা ইন্দ্র তার পুত্র জয়ন্তকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ঐ অমৃত ভরা কুম্ভ (কলস) নিয়ে পালিয়ে যেতে। ইন্দ্রপুত্র জয়ন্ত অমৃত ভরা কুম্ভ নিয়ে অসুরদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিলেন এবং হরিদ্বার, প্রয়াগ, নাসিক আর উজ্জয়িনীতে সেই কুম্ভ নামিয়ে রেখে বিশ্রাম করেছিলেন। তাই এই চার জায়গাতে হয় কুম্ভ মেলা। এর মধ্যে প্রয়াগ আর হরিদ্বারে সেই কুম্ভ থেকে পরে গিয়েছিল কয়েক ফোঁটা অমৃত। তাই ওই দুটো জায়গাতেই কেবল হয় পূর্ণ কুম্ভ মেলা। কুম্ভ মেলা অন্য জায়গা গুলিতে হলেও এলাহাবাদ বা প্রয়াগরাজ এর কুম্ভমেলাটিই সবচেয়ে বড়।
অনেক উৎসাহ নিয়ে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। বিশাল ধুধু মাঠ যেখানে হয় কুম্ভের মেলা। দুই একজন সন্ন্যাসী দেখা গেল ত্রিশূল হাতে মাঠে ঘুরা ঘুরি করতে। এমন একটা ঐতিহ্যময় জায়গা, বহমান গঙ্গা-যমুনা, অবারিত প্রান্তর, নদীর পাড়, ত্রিবেণী সঙ্গম সব মিলে বেশ একটা মনোহরণ পরিবেশ।
শম্পা বলল “এখানেই দাঁড়িয়ে ত্রিবেণী সঙ্গম দেখ।” আমি বললাম “সে কি করে হবে!! কাছ থেকে না দেখলে হয় নাকি?” আশীষ'দা বলল “নৌকা করে যেখানে জলটা মিলেছে ওখানে যেতে হবে।” জিয়া বলল “হুঁ,” শম্পা বলল “না, যেতে হবে না, সব ভুলভাল কাজ তোমাদের।” তিন নদী মিলে একটা বিশাল নদী, এ পাড় ও পাড় দেখা যাচ্ছিল না। শম্পার উৎকণ্ঠা খুবই স্বাভাবিক।
নদীর পাড়ে বালুর উপর দাঁড়িয়ে নদী দেখছি। সবে বিকেল তখন। জলের উপর দিয়ে অজস্র সি-গাল উড়ে বেড়াচ্ছে। অনেকই সপরিবারে নৌকা করে যাচ্ছে সঙ্গম স্থলের দিকে। আমরা তখনও ভাবছি যাব কি যাবনা। জিয়া বলল “দেখ কত শান্ত নদী, কোন ঢেউ নেই। চল যাই, কোন ভুল ভাল কাজ হবেনা।”
বেশ কয়েকজন নৌকার মাঝি আমাদের দোটানা দেখে সাহস দিতে শুরু করলো। নৌকাগুলো বেশ প্রশস্ত। চারজন অনায়াসে ভাল ভাবে বসা যায়। একটা অল্প বয়সী শুকনো পটকা ছেলে মজার মজার কথা বলছিল, সাহসও দিচ্ছিল। বলছিল, “বিদেশীরা, এতদূর এসে পুণ্যি না নিয়েই চলে যাবে? ভয় পেন, আমার গায়ে জোর আছে। আমি ভাল নৌকো চালাই, তোমাদের নিয়ে যাবো আবার নিয়েও আসবো। জীবনটাকে বৃথা করোনা।”
অবশেষে তার নৌকাটি ভাড়া করা হল। তখন নভেম্বর মাস, চমৎকার আবহাওয়া। মৃদু মন্দ বাতাসে নৌকার পালে লাগল হাওয়া। নৌকা তিরতির করে ছুটতে লাগল। শান্ত নদীর জল। অসীম আকাশ।
আমরা পৌঁছুলাম গঙ্গা যমুনার সঙ্গমস্থলে। নৌকাটি অনেক গুলো নৌকা যেখানে বাঁধা সেখানে ভিড়ল। দুই নদীর মিলন স্থলে একটির জল একটু গাঢ় এবং আর একটির রং হাল্কা। অবাক লাগল দেখে যে বিশাল দুই নদীর মিলনস্থলে জল গভীর নয়। এখানে জেগে উঠেছে চর। চরের ওপর হাঁটু জল। প্রচুর মানুষ জলে নেমে প্রণাম করছে আর পূজা দিচ্ছে।
আমি ভাবলাম হুঁ এখানে তো হাঁটু জল তাহলে নামা যায়। আশীষ’দাকে বললাম “চলেন জলে নামি।” আশীষ’দা বলল “কোন নামানামি নাই, নৌকাতেই থাকেন।”
কোন কিছু বুঝতে পারার আগেই হঠাৎ দেখি আমাদের নৌকার উপর দুজন লোক...
পরের অংশ
|