চিরায়মানা - তুমি / মলি আহমেদ
আগের অংশ
বয়স তখন তোমার কত হবে!!?? তুমি তখন সবে তরুণী। তোমার ছিল দীঘল কালো চুল। গভীর দু’চোখ আর অপরিসীম শান্ত ব্যক্তিত্ব। আমি চিন্তা করে পাই না এখন থেকে ৬০/৬২ বছর আগে সে কোন এক মহীয়সী নারী এমন মনোরম সুন্দর ভাবনা কি ভাবে ভেবেছিল। শুধু শাড়ির পাড় দিয়ে তৈরি করবে একটা কাঁথা গায়ে দেবার জন্য!! স্নেহের সাথে শাড়ি’র পাড় দিয়েছিল তোমার আপন জন। তোমার স্নেহময়ী মা, আর নিজের তো ছিলই। আজ জানতে ইচ্ছে করে কোন শাড়ির পাড়টা কার ছিল। “জানি তবু জানি প্রেম, শিশু, গৃহ এটাই সবখানি নয়। স্নেহ ছিল ভালবাসা ছিল, তবু বুকের ভিতর এক বিপন্ন বিস্ময় খেলা করে”। যা জানি না তাই জানবার জন্য মন আকুল হয়।
ছিলতো আইমনের মা, সুন্দরী টসী, ধুল্লা বুবু, বন্ধু কসিরণ, পাশের বাড়ির কোরবানের বৌ, এরাইতো ছিল। রোজ দুপুরে রান্না খাওয়ার পাট চুকে গেলে, ছেলে ঘুমালে, মেয়ে পড়তে বসলে তাড়াতাড়ি চলে আসত। কত শত হাসি আর গল্পে গল্পে পাট পাট করে বিছিয়ে দিত পুরাণ কাপড়। কেউ একজন নরম শাড়ির থেকে সুতা খুলে খুলে বের করত আর আঙ্গুলে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ছোট ছোট রিংয়ের মতন করে জমা করত। এই সুতা দিয়েই সেলাই হবে কাঁথা। সবাই সূচ আর সুতা নিয়ে সেলাইয়ে মনোযোগ দিত। খালি হাতে কিন্তু কাঁথার ফোড় গুলি প্রতিটা সমান!! যেন কেউ স্কেল বসিয়ে মাপ দিয়েছে। সব কিছু নিখুঁত করে করবার একটা দুর্দান্ত মানসিকতা ছিল তোমার। দৃঢ় সচেতন মন সব কিছুতেই প্রখর সজাগ দৃষ্টি রাখত।
সেই সময় মুগা সুতার চমৎকার নকশা করা শাড়ির পাড়ের প্রচলন ছিল। একটু সিল্কি ভাব ছিল কাপড়ে। উজ্জ্বল আর বর্ণাঢ্য রংয়ের সমারোহ ছিল শাড়িতে। শাড়ির পাড়গুলি পাট পাট করে একটার পর একটা বসিয়ে তৈরি হয়েছে কাঁথা। কোন রংয়ের পর কোন রংটা যাবে সযত্নে বিবেচনা করে বসান হয়েছে। রংয়ের বিন্যাসটা এতই চমৎকার যে চমৎকৃত হতে হয়। কোণাকোনি পাড়ের জোড়াটা একদম নিপাট, নিখুঁত। কাঁথার চারটা কোণাই একই রকম নিপাট, নিখুঁত ভাবে জোড়া দেয়া। এই কাঁথাটা যে তৈরি করেছে সে সুনিপুণা নির্ভরযোগ্য এক ব্যক্তিসত্তা, যার সিদ্ধান্ত অনুপম, অনন্য। যার ভাবনা একক এবং নিজস্ব। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যে অনেক দৃঢ়তার সাথে কাজ করে। সুরুচি আর সুচারিতা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। একটা সংবেদনশীল মন যে সবার কথা ভাবে। তার ক্ষুদ্র পরিসরে সাধ্যের মধ্যে সঙ্কুলান করে বাকি সবার জন্য অনুকূল স্বাচ্ছন্দ্য। সে তুমি! আমার মা’।
জ্ঞান হবার পর থেকে আমি এই কাঁথার সাথে পরিচিত। তোমার আরো অনেকগুলি কাঁথা আছে সেগুলোও খুবই সুন্দর, দর্শনীয়, নরম এবং মনোরম। তবুও সবারই নজর ছিল এর দিকে। এটা ছিল সবার চেয়ে আলাদা, স্বতন্ত্র। তোমার কাঁথার মতন একটা কাঁথা তৈরি করবার চিন্তা আমার অনেক দিন থেকেই মনে মনে জমা বাঁধছিল। রতি আপাকে বললাম সে কথা। রতি আপা বলল তো ভালইতো। তোর পাড় গুলি নিয়ে আয়। বাকি যেটা থাকবে সেটা তোকে দেয়া যাবে। জলি আর রতি আপা কয়েকটা পাড় দিল। কিন্তু সমস্যা হল কাঁথটা সেলাই করবে কে??? এখন মানুষ জন পাওয়া মুস্কিল যারা কাঁথা সেলাই করতে পারে। লিনু বলল চিন্তা করো না আমার ড্রাইভারের বৌ পারবে। লিনু নিয়ে গিয়ে ড্রাইভারের বৌকে দিয়ে কাঁথটা সেলাই করিয়েছে। জানি ওটা তোমার কাঁথাটার মতন অত সুন্দর হয়নি। তোমার কাঁথাটা আজও আছে। সযত্নে তুলে রেখেছি আলমারিতে। দেরাজের ভারী পাল্লাটা অতি সন্তর্পণে খুলি। ঝাপসা চোখে সাবধানে ভিতরে দৃষ্টি মেলি। কি আছে এখানে!!! ফেলে যাওয়া কিছু আধুলি, সিকি। বিবর্ণ খয়রি মলাটের তোমার হিসাবের খাতা। সেই কবে আব্বা ক্যানাডা থেকে নিয়ে এসেছিল Earcap. কত যত্ন করে তুলে রেখেছিলে। অশান্ত মনটাকে একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে সংবরণ করি। বের করে আনি কাঁথাটা। আস্তে আস্তে কাঁথার ভাঁজটা খুলি। অনেক যত্নে, ধীরে, বহু ধীরে, অনেক আদর দিয়ে হাত বুলাই কাঁথার উপর। অনেক দিনের সেই সব কথা ফিরে আসে আমার কাছে। ফিসফিস করে জানতে চাই, কোথায় তুমি?!তুমি কোথায়!!!!? “তুমি ঘুরে,ঘুরে,ঘুরে বেড়াও কোন বাতাসে - যে ফুল গেছে সকল ফেলে গন্ধ তাহার কোথায় পেলে, যার আশা আজ শূন্য হল কী সুর জাগাও তাহার আশে॥” সকল গৃহ হারিয়ে চোখের জলে সিক্ত করে শূন্য করে চলে গিয়েছ। তবু মন মানে না। সব ভুলে দুর আকাশের স্বপ্ন দেখি। তোমাকে যুগে যুগে বারে বারে ফিরে পাবার প্রত্যাশা করি। আজ যখন দেখি তোমার নাতির ঘরের পুতি’রা কাঁথাটা আরাম করে গায়ে জড়ায়। মনে হয় তোমার পরম স্নেহের উষ্ণতা আর উত্তাপ আজও আছে। তখন গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলেও ভাল লাগে তুমি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বেঁচে আছ, থাকবে।
মা’র নাতির ঘরের পুতিদের গায়ে মা’র কাঁথা
তাই আমার কাঁথাটাও থাকলো কেউ হয়তো ৬০/৬২ বছর পরে আরাম করে গা’য়ে জড়িয়ে তাদের পূর্বসূরিদের কথা স্মরণ করবে।
জুলাই ২০২০ সিডনি
আগের অংশ
মলি আহমেদ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|