চিরায়মানা - তুমি মলি আহমেদ
মনে মনে যত কথা তোমার সাথে বলি কি জানি সে কথা কি তুমি শুনতে পাও?!! বুঝতে পার!!!??? জানি না শত চেষ্টা করেও আমিতো কোথাও তোমার কণাটুকুনেরও সন্ধান পাই না। কোন অজানা, অনন্তলোকে তোমার বাস। সে ঠিকানা তো আমি শত চেষ্টা করেও খুঁজে পাইনা। তোমার কথা, তোমার ভাবনা, তোমার কাজ আজও মনকে বিষণ্ণ করে, প্রফুল্ল করে, অনুপ্রাণিত করে। তুমি নেই সে যেমন সত্য, তুমি আছ সেটাও অনিবার্য। মনের মধ্যে তোমার প্রকাশ আমাকে শান্ত, সমাহিত করে। তুমি আমার কথা শুনতে পাও আর না পাও, মনে মনে তোমার সাথে আমার এ কথা বলা কখনো ফুরাবে না। জানি তুমি ছিলে, তুমি আছ, তুমি থাকবে। পুকুরের ঠিক ধার ঘেঁসে যে হিজল গাছটা, তার ঘন সবুজ পাতার মাঝখান দিয়ে লাল ফুলগুলির ঝুরি নামে। ছোট ছোট অনেক ফুলের সমষ্টি নিয়ে হিজল ফুলের ঝুরি। সবুজ আর লালে মিলে দেখতে যে কি সুন্দর। ফুলগুলি নিজ সুগন্ধে মাতোয়ারা। সন্ধ্যার ফুলগুলি ভোর না হতেই মাটিতে লুটিয়ে পরে। যেন মনে হয় কে আসবে বলে মাটির ধরাতলে তার রক্তিম আঁচল বিছিয়ে রেখেছে।
এই পুকুরটাতে বেলা একটু বাড়লেই কোথা থেকে যেন কারা স্নানের জন্য এসে ভিড় জমায়। মহিলারা সব দল বেঁধে আসে। পুকুরটা ভিতর বাড়ির আঙিনায়, তাই মহিলারাই এখানে আসে। তবে কিছু ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে তাদের ঠেকানো যায় না। হিজল গাছের ডগায় উঠে উদাম শরীরে ঝাপ দেয় জলে, কি অনাবিল আনন্দ। আবার কেউ কেউ হিজলের ফল পাথরে ঘসে তা থেকে বুদবুদ বানায়!!!!
বর্ষায় কোথা থেকে এত জল এসে পুকুরটা ভরে দেয়। পুকুরের জল উপচে পড়ে। আর যখন বর্ষা চলে যায়, পুকুরে জল শুকিয়ে আসে। স্নানের জন্য বৌ, ঝি’রা ভিড় জমায় না। তখন পুকুরে মাছ ধরার ফাঁদ পাতা হয় পুরানো নৌকা ডুবিয়ে আর বড় বড় গাছের ডাল পুতে। কেউ কেউ আবার বাঁশের শলার তৈরি বিভিন্ন ধরনের চাঁই তৈরি করে। এতে বিভিন্ন আকৃতির খোপ। মাছ ঢুকতে পারে কিন্তু বের হতে পারে না। সেটা পুকুরে চুবিয়ে রেখে অপেক্ষা করে সেই দিনের জন্য। তারপর একদিন কাদা, মাটি, জল উপেক্ষা করে সবাই মাছ ধরার উৎসবে মেতে উঠে। কেউ পলো, কেউ কোঁচ, কেউ কেউ শুধু পিঠে মাছ রাখার খলোই নিয়ে খালি হাতে পুকুরে নেমে পড়ে। আর হিজল গাছটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে মাছ ধরা দেখে। সীমানার পিছন দিকটায় বাড়ির রান্না ঘর। তার পাশেই ঢেঁকির ঘর। ঢেঁকির ঘরের পিছনে দুটো কাঁঠাল গাছ। সে গাছ দুটোতে একদম নীচে থেকে কাঁঠাল ধরা শুরু হত। রান্না ঘরের সাথেই যে ঘরটা সেখানে এক দিকে খাবারের জায়গা, আর সে ঘরের অপর প্রান্তে বিশাল এক জোড়া খাট পাতা। মনে হয় ছোট বেলায় আমরা কম করে হলেও দশ জন ঘুমাতে পারতাম ঐ এক খাটে। সত্যি সত্যি তেঁতুল পাতায় ৯জন।
বাড়ির সীমানা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই শুরু হয়েছে একটা জংগল। নানী বলতো পিছন বাড়ির জংগল। বাবলা গাছে যে কাঁটা হয়, বেতফল দেখতে যে এত সুন্দর তা কে জানত!! বড় জাম গাছটাতে অজানা পরাশ্রয়ী গাছ ডাল ডালে আশ্রয় নেয় আর ছোট ছোট সাদা ফুলে ভরে থাকে - সে এক অপার সৌন্দর্য। ভাট ফুল আর আকন্দের গাছ বাতাসে দোলে, দণ্ডকলসের গাছগুলিতে ছোট সাদা ফুল ফুটে, সেই ফুলে থাকে মধু। মুখে নিয়ে টান দিলেই মিষ্টি স্বাদ পাওয়া যায়। বিপুল এ জংগলের বিলাসবেশ যেন... “পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!” কাঠ ঠোকরা পাখিরা সারা জংগলটাকে সচকিত করে তীব্র চিৎকার করে এক গাছ থেকে উড়ে গিয়ে অন্য গাছে বসে। শালিক গুলি কিচির মিচির শব্দ করে আর মাঝে মাঝে হলুদ রংয়ের বৌ কথা কও পাখিদের ডাক শুনা যায়। দোয়েল পাখিটা সজনে গাছে বসে বসে দোলে আর তখনই মনে হয় বুকের ভিতর যেন এক সমগ্র বাংলাদেশ দোল দিয়ে গেল।
হাতের বাঁ পাশে ক্ষুদি জামের গাছ, তার থেকে আর একটু দক্ষিণে এগুলেই উইয়ের ঢিপি। ঢিপির নরম মাটি পার হয়ে যেখানে ধুনচি গাছ গুলি নুইয়ে পড়েছে, দুই একটা মরা ডাল আর সেই সাথে গাছ থেকে মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে সোনাল ফুল সেখানেই পায়ে হাঁটা সুন্দর মাটির পথটির শুরু। পথটা গিয়ে মিশে গেছে ওসিম খাঁ’র ভিটাতে। এখানে গরুর গোয়াল, বেগুনের পালান, শশার মাচা, লাউয়ের পাতা, মরিচের সতেজ সবুজ গাছ চেয়ে থাকার মতন। বড় লেবু গাছটাতে এত লেবু ধরে যে ডালগুলি ভারে নুয়ে পড়ে গরুর খাবারের জন্য খড় বিচালি ভরা বিরাট বিরাট চাঁড়ি গুলির উপর। ওসিম খাঁর ভিটা থেকে দৃষ্টিটাকে একটু প্রসারিত করলে দেখা যায় সর্ষে ক্ষেত। চোখ ধাঁধানো হলুদ ফুল মাঠ জুড়ে ফুটে আছে। মৃদুমন্দ বাতাসে সর্ষে ক্ষেতটা উতলা হয়। মাঠের ঢালু দিকটার দিকে হেঁটে গিয়ে ওখানে বসতেই সর্ষে গাছের ফুলগুলি উঁচু হয়ে ঢেকে দেয়। মনে হয় হারিয়ে গেছি পৃথিবী থেকে, উধাও হয়ে গেছি। কেউ খুঁজে পাবে না আর। বাড়ির বাইরের কাচারি ঘর, মসজিদ আর ভিতর বাড়ির সীমানা যেখানে শুরু, তার মাঝখানে একটা বিশাল উঠান। বাহির বাড়ির উঠান। ঋতু বদলের প্রতিটা মৌসুমে নানা ধরনের ফসলে ভরে উঠে সে উঠান। কখনো ধান, কখনো কাউন, কখনো পাট, যব, রাইসরিষা, তিল। কত সব নানা ফসলের সম্ভার আর সমারোহ।
তোমাদের বাড়ির মসজিদটা অনেক পুরানো। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় দৌলত খাঁ নামের একজন সুদর্শন, দৃঢ় এবং ধর্মপ্রাণ পাঠান যুবক যিনি তোমার দাদার, দাদার, বাবা ছিলেন তিনি পাবনার চাটমোহর জেলায় প্রায় চার পুরুষের ভিটা মাটি ছেড়ে এসে এই গ্রামে নতুন করে খাঁ বংশের গোড়াপত্তন করেন এবং ১৭৬২ সনে এই মসজিদ তৈরি করেন। প্রায় ২৫০ বছর আগের এই মসজিদটা এ গ্রামের ঐতিহ্য ও প্রাচীনত্ত্বের এক সমৃদ্ধ ইতিহাস।
মসজিদের সামনে একটা চমৎকার বাগান। মসজিদের উঁচু ভিটার উপর দাঁড়ালে যত দুর চোখ যায় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা প্রকৃতির চারণভূমি।
“পল্লবঘন আম্র কানন রাখালের খেলাগেহ স্তব্ধ অতল, দীঘি কালোজল, নিশীথশীতল স্নেহ|”
দু’পাশের ফসলের ক্ষেত পেরিয়ে মেঠো পথ চলে গেছে খোলা প্রান্তরের পানে। সেখানে প্রকাণ্ড বিশাল এক বট গাছ, শাখা প্রশাখা বিস্তার করে প্রায় বিঘা খানেক জায়গা জুড়ে তার আধিপত্য সদর্পে ঘোষণা দিয়েছে। আর তার পিছনেই রয়েছে গ্রামের স্কুলটি। সেই কবে তৈরি করেছেন তোমার পূর্বপুরুষ, যেটা এখনো এ গ্রামের গর্ব আর ঐতিহ্যকে গৌরবে বহন করছে।
পৃথিবীর সব রূপ, রস আর গন্ধ নিয়ে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ফুলজোর নদী। আর তুমি এই নয়নাভিরাম সুন্দর, সবুজ গ্রামে বেড়ে উঠেছ, গ্রামের ঐ ঐতিহ্যময় স্কুলটাতে পড়েছ। আর সংসারের নিয়মে বিয়ের পর পাড়ি দিয়েছো সব কিছু ছেড়ে নতুন আর এক জীবনের দিকে। কিন্তু যেখানে বড় হয়েছো, শৈশবের আজন্ম লালিত স্নেহধন্য স্থান কোন দিন বিস্মৃত হওনি। বার বার ফিরে গিয়েছো তোমার গ্রামে, একান্ত আপন জায়গায়, আপন পরিবেশে আর ফিরে এসেছো মাটির টানে আপন মানুষের সান্নিধ্যে।
“আমের বনে দোলা লাগে, মুকুল প’ড়ে ঝ’রে– চিরকালের চেনা গন্ধ হাওয়ায় ওঠে ভ’রে– ” কচি সবুজ দুই পাতার মাঝখান থেকে কাঁঠালের এঁচোড় উঁকি দেয়। বকুল ফুল সুগন্ধ ছড়িয়ে মাটিতে ঝরে পড়ে। ধান ক্ষেত সোনালি শীষে ভরে উঠে। পুবের বাতাসে হঠাৎ খেলিয়ে যায় ঢেউ। ‘বর্ষা আসে বসন্ত’!! তুমি পথ চেয়ে বসে থাকো সেই তোমার আনন্দ। আর যখন - “রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের পরে নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে” হারানো অতীত ভিড় করে আসে নয়নের মাঝখানে। নব তৃণ দলে বাদলের ধারা এসে প্লাবিত করে। দুর্গা যেমন প্রতি বছর তার সন্তান সন্ততি নিয়ে কৈলাস পাহাড় থেকে নেমে আসে বাপের বাড়ির যাবার জন্য। ঠিক তেমনি তুমিও তোমার সন্তান সন্ততি নিয়ে বাবা’র বাড়ি আসতে। আর দেবী দুর্গা মতনই দশ হাতে সংসারের হাল ধরতে আর সামলাতে। ছোট ভাই, বোন, বাবা, মা সবাইকে যত্নে, আনন্দে ভরে দিতে তোমার ছুটির কয়েকটা দিন। কার কি লাগবে, কোনটা দরকার, কোনটা অদরকারি তার সব দিকে তুমি সর্বদা নজর রাখতে। পরম মমতায় দু’হাতে উজাড় করে দিতে তোমার ভালবাসা। কি করে করতে এত সব!!! পারতে কেমন করে!!!?
'নানা’ সব সময় তোমার নাম করেই নানী’কে ডাকতেন। তবু মনে হয় ‘নানা’ তোমার গ্রামে থাকাকালীন সেই সময়টাতে নানী’কে কারণে অকারণে একটু বেশিই ডাকাডাকি করতেন... ‘ও রেণুর’মা, ও রেণু’র পোয়াতি’ কোথায় গেলে....। আমি যেন এখনো সেই ডাক বুকের ভিতর শুনতে পাই। এত বিপুল স্নেহ, জীবন উজাড় করা ভালবাসা। সারা জীবন চলার পথে এক পরম পাথেয়। তোমার সকল কাজে যে নিপুণতা ছিল সেটা আমাকে খুব আনন্দ দিত। কারণ আমিতো তোমার উল্টো। নিপুণতার প্রশ্রয় আমার নাই। কিন্তু তুমি সেরকম নও। তুমি সব কিছুকেই সুন্দর করে প্রকাশ করতে। এটা একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল তোমার কাছে। সেটা তোমার স্বভাব আর কর্মে মিশে ছিল। সংসারে যে দু’টো বস্তুর দরকার তা তোমার মধ্যে অধিক পরিমাণে বিদ্যমান ছিল। এক ধৈর্য আর এক সহিষ্ণুতা। আর সহিষ্ণুতার মতন এত বড় গুন সংসারে আর কিইবা আছে । তোমার এ দুটা ছিল বলেই তোমার জীবনের এত বাঁধা বিঘ্নকে বার বার অতিক্রম করতে পেরেছ, দীর্ঘ একাকী জীবন পাড়ি দিয়েছ অসীম সাহসিকতায়। সেখানেই তুমি বিজয়ী, সেখানেই তুমি সার্থক, সেখানেই তোমার ব্যাপ্তি। সব সময় দেখেছি তুমি নরম কিন্তু দৃঢ়তা তোমার সহজাত। সহজেই যে কোন সিদ্ধান্ত কঠিন ভাবে নিতে পারতে। কত সহজে মানুষ তোমার কাছে আসত প্রকাশিত হত অথচ তুমি নিজেকে কত অন্তরালে রাখতে। সবাইকে সমান ভাবে যত্ন করতে। সব মানুষকে সমান করে দেখার বিষয়টা আমি তোমার কাছ থেকে শিখেছি। তোমার কাছে ছোট, বড় বিভেদ ছিল না। আমি কখনো দেখিনি। মনে হয় তুমি বোধ হয় বিশ্বাস করতে - “সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।” তোমার কথা বলে শেষ করতে পারব না জানি। কিন্তু তোমার অনেক কাজের মাঝে তোমার ছোট্ট একটা কাজ আমাকে অনেক অনেক মুগ্ধ করত, আশ্চর্য হতাম। আর তোমার জন্য প্রচুর শ্রদ্ধা এসে বুকের ভিতর তোলপাড় করে দিত। সেটা খুবই সাধারণ, কিন্তু অসাধারণ হয়েছে নৈপুণ্যে আর নন্দনে। তোমার হাতে সেলাই করা একটা কাঁথা। অল্প ঠাণ্ডায় আরাম করে গায়ে জড়িয়ে নেবার জন্য শ্রেষ্ঠ বস্তু...
পরের অংশ
|