bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













লক্ষ্ণৌ...
মলি আহমেদ



এক সময় লক্ষ্ণৌ শহরে ঘুঙুরের আওয়াজ পাওয়া যেত দিনের শেষের শেষ প্রান্তে। কোঠা-বাড়িতে বাইজীদের অসাধারণ নাচে আর গীতে এ শহরে রাতের শাহী-উষ্ণীষ উষ্ণতায় বিচলিত হত অবিরত। শাহী দরবারে সঙ্গীত পিপাসু সমঝদাররা খেয়াল, গজল আর ঠুমরীর আমেজে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ত রাতভোর। বেগম আক্তার লক্ষ্ণৌর আকাশে বাতাসে ছড়িয়েছিল তাঁর সুমধুর কণ্ঠে গাওয়া “আ্যায়ি মোহাব্বত তেরি আনজাম পে রোনা আ্যাঁয়” অথবা “জ্যোৎস্না করেছে আড়ি”।

মোগলদের হাত থেকে ইংরেজরা দিল্লির সিংহাসন দখল করে নেবার পরেই ভারতবর্ষের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ভুবনে নেমে এসেছিল এক অন্ধকার অধ্যায়। ১৩০০ শতাব্দীতে আলাউদ্দিন খিলজির আমলে যে রাগসঙ্গীত ওস্তাদ আমীর খসরু শুরু করেছিলেন এবং যত্ন করে গড়েছিলেন, অনেক যুগের পরে ইংরেজের হাতে তার ধংসের শুরু হয়। সেই সময় অনেক সঙ্গীত শিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞরা নওয়াবদের দরবারে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু ইংরেজদের অত্যাচারে অনেক নওয়াবকেও তাদের রাজ্য থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। তেমনই এক হতভাগ্য ছিলেন নওয়াব ওয়াজেদ আলী শাহ। তিনি ছিলেন অযোধ্যার শেষ নওয়াব। লক্ষ্ণৌ তখন অযোধ্যা নামে পরিচিত ছিল।

১৮৪৭ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত ছিল নওয়াব ওয়াজেদ আলী শাহের রাজত্বকাল। ১৮৫৬ সালে ইংরেজরা অযোধ্যা অধিকার করে নেয়। সেই সময় তিনি বিদায়ের বেদনা প্রকাশ করে লিখেছিলেন “বাবুল মোরা” ঠুমরীটি। ঠুমরীতে তার হৃদয়ের আর্তি ফুটে উঠেছিল অত্যন্ত গভীরভাবে।

“বাবুল মোরা নৈহার ছুটহী যায়
অঙ্গনা তো পর্বত ভয়ো”
(আমার প্রাণের দুলালী পিত্রালয় ছেড়ে চলে যাচ্ছে
এই প্রাঙ্গণ পাথর-সম)

২০১৭তে আশীষ’দা, শম্পা, জিয়া আর আমি এক সাথে বেনারাস, এলাহাবাদ আর লক্ষ্ণৌ ঘুরতে গিয়েছিলাম। বেনারাস আর এলাহাবাদের পর আমাদের ছিল লক্ষ্ণৌ যাবার পালা। এলাহাবাদ থেকে লক্ষ্ণৌ ২০২ কিলোমিটার। আমরা সকাল সকাল বের হয়ে পরলেও লক্ষ্ণৌ পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যাই হয়ে গেল। পুরাতন আর নতুন লক্ষ্ণৌ শহরকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে গোমতী নদী। গোমতী গঙ্গার একটি শাখা নদী। এ নদীর বাঁকে বাঁকে গড়ে উঠেছে ঐতিহাসিক লক্ষ্ণৌ শহর। নতুন লক্ষ্ণৌ আর পুরাতন লক্ষ্ণৌ গোমতীর উপরের সেতু দিয়ে সংযুক্ত।

‘রেনেসাঁস হোটেল’। চমৎকার ঝকঝকে পরিপাটি এক পরিবেশ। সম্ভাষণ আর স্বাগতমের বাহার থেকে বুঝতে পারলাম- ঠিক ঠিক নবাবদের শহরে পদার্পণ করেছি। হোটেলের ভিতরে একটা আধুনিক নবাবী আমেজ খেলা করছিল। দশ তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিশাল শহরটির অনেকাংশ দেখা গেল। ‘তাজ হোটেল’টি ঠিক আমাদের হোটেলের পাশেই। দুরে দেখা যাচ্ছিল আম্বানী পার্ক। পুরা যায়গা জুড়ে আলোর মেলা।



নহবত এবং সহবত এ শহরের সামাজিক সহাবস্থান। কথিত আছে একবার দুই নবাব ট্রেনে উঠবার জন্য দাঁড়িয়েছিল। ট্রেন এসে গেছে । একজন বলে ‘পেহ্লে আপ’ ওপর জন বলে ‘পেহ্লে আপ’ এই করতে করতে ট্রেন তো স্টেশন ছেড়ে চলে গেল। এমনই তাদের সৌজন্যের বাহার। মানুষজন খাস নবাবী ঢংয়ে চোস্ত উর্দুতে কথা বলে এ শহরে।

লক্ষ্ণৌ’র শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ্ সাহিত্য, শিল্প, কবিতা, সঙ্গীত এবং নৃত্যে ছিল তাঁর অপরিসীম আগ্রহ এবং অনুগ্রহ। তাঁরই প্রচেষ্টায় লক্ষ্ণৌ ঘরানার কথক নৃত্যের প্রসার আর সমৃদ্ধি ঘটে। ওয়াজিদ আলির দরবারেই ঠুমরী জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছায়। নবাব নিজেও অনেক গান রচনা করেন। এর মধ্যে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে যখন লক্ষ্ণৌ ছেড়ে কলকাতা চলে যেতে হয়েছিল তখন আপন মনের দুঃখ কষ্ট নিংড়ে লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত গান …
‘যব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী/ কহো হালে আদম পর কেয়া গুজারি।। আদম গুজারি, সদম গুজারি/ যব হাম গুজারি দুনিয়া গুজারি।।’

এই শহরেই বাস করেছেন আর এক বাঙালি লেখক এবং গায়ক অতুলপ্রসাদ সেন। সঙ্গীতের একজন গুনা-গ্রাহী ব্যক্তিত্ব। একজন প্রবাসী বাঙ্গালী বাংলাকে ঋণে আবদ্ধ করে রেখে গিয়েছেন তার রচিত অসামান্য উচ্চাঙ্গ রাগ সঙ্গীত আর কালজয়ী গান দিয়ে যা অতুলপ্রসাদী নামে পরিচিত।

লক্ষ্ণৌ ঐতিহাসিক শহর। এ শহর জুড়ে রয়েছে সুন্দর পার্ক, বাগান, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্য আর ঐতিহাসিক স্তম্ভ। আরো আছে ঐতিহ্যবাহী লক্ষ্ণৌ চিকান। হাতে কাজ করা অসামান্য এমব্রয়ডারি। কাপড় জুড়ে নিপুণ সুতার কারুকাজ।

নবাব আসফ উদ দৌলা ১৭৮৪ সালে রুমি দরওয়াজা বা রুমি গেইট লক্ষ্ণৌ’র প্রবেশ দ্বার হিসাবে নির্মাণ করান। ৬০ ফুট উঁচু এই গেইট নবাব আমলে স্থাপত্যের একটি অসামান্য ঐতিহ্য। অপূর্ব দক্ষতার সাথে এর গায়ে চিত্রিত করা হয়েছে ফুল, ফুলের কুঁড়ি, পদ্মফুল আর খোদাই করা হয়েছে আলপনার মত অপরূপ নকশা। গেইটের একদম উপর দিকে আছে একটি ডোম আকৃতি ছাউনি। ছাউনিতে পৌঁছাবার জন্য ভিতর দিয়ে একটি সিঁড়ি আছে। কিন্তু এখন আর ওখানে যাওয়া যায় না। ওটার সামনে না দাঁড়ালে এর বিশালত্বটা ঠিক বোঝা যায় না।


রুমি দরওয়াজা

রুমি দরওয়াজা দিয়ে ঢুকে সোজা বরাবর চলে গেলে সামনে পরবে সুদৃশ্য একখানা বাগান। বাগানের ঠিক মাঝখান দিয়ে ইটের রাস্তা সোজা চলে গেছে বড় ইমামবাড়া বিল্ডিংয়ের দিকে। কিছুটা মোঘল, কিছুটা রাজপুত আর কিছুটা গথিক আর্কিটেকচারের সংমিশ্রণে তৈরি ইমামবাড়া। বলতে গেলে একটা বিশাল হল রুম। ভিতরে রয়েছে অপরূপ কারুকাজ করা ছাদ ও দেয়াল। ভিতরের নির্মাণ শৈলীর এতই কারিশমা যে এক প্রান্তে একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালালে অপর প্রান্ত থেকে তার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। তখনকার দিনে এক কোটি টাকার উপর খরচ করে এই ইমামবাড়া তৈরি করা হয়। এখানে রয়েছে নবাব আসফ উদ দৌলা’র সমাধি।


বড়া ইমামবাড়া


বড়া ইমামবাড়ার ভেতরে

বড়া ইমামবাড়ার পাশেই ছোট ইমামবাড়া। লক্ষ্ণৌর আর একটি আকর্ষণীয় জায়গা। ১৮৩৮ সালে তৃতীয় নবাব মহম্মদ আলি শা ইমারতটি তৈরি করেছিলেন। মহররমের সময় কয়েক হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ এখানে জড়ো হয়। ওই সময় ছোটা ইমামবাড়া ইমারতটি সুন্দর সাজে সাজান হয়। আর রাতে জ্বেলে দেয়া হয় হাজার মোমবাতি।


ছোট ইমামবাড়া

বড়া ইমামবাড়ার ভিতরটা দেখার পরে আশীষ দা আর জিয়ার ভুলভুলিয়াতে ঢুকিবার সাধ জাগিল। একজন গাইড ছাড়া ভুলভুলিয়াতে ঢোকা নিষেধ। এই বিল্ডিংয়ের ভিতর ২০ফুট পুরু দেয়ালের গাঁথুনির মাঝে লুকিয়ে আছে বিশাল বিশাল করিডোর যা কিনা একটা বিরাট গোলক ধাঁধা। ভিতরে প্রায় ১০০০এর উপরে আছে সর্পিল পথ। যা এক এক দিকে নিয়ে গেছে । এবং কোন কোনটা পথ শেষ হয়ে গেছে যেখান থেকে বের হবার রাস্তা নেই। একটা কানাগলি। আবার ফিরে যেতে হবে। আবার কিছু হঠাৎ খাড়া নদুরুহ এই অন্ধকার গোলকধাঁধা। শুধু মাত্র দু’টি পথ খোলা ছাদে গিয়ে শেষ হয়েছে। এখান থেকে বের হবার জন্য তাই চাই একজন অভিজ্ঞ গাইড। একমাত্র শক্ত ও সাহসী মনের মানুষরাই এটার ভিতর ঢুকতে পারে। তো আমি তো সেই প্রথমেই বাদ পরি। শম্পা হয়তো পারতো কিন্তু বাধ সেধেছিল পায়ের ব্যথা। আমরা গত ৭/৮ দিন অনবরত শুধু হাঁটছি। পায়ের আর দোষ কি। ছোট ছোট গ্রুপে ভুলভুলিয়াতে ঢুকার ব্যবস্থা। আমি আর শম্পা বাইরেই রইলাম।

এখানে আর একটা সুন্দর জিনিস সেটা হল ‘বাউলি’। অর্থ কুয়া। এই স্বচ্ছ জলের কুয়াকে ঘিরে তিন তলা বিশিষ্ট সুদর্শন ইমারত। কোন আগন্তুক এলে গভীর জলে তার ছায়া এসে পড়তো। তাতে করে জানতে পারতো কে বা কারা প্রবেশ করছে মহলে!! আধুনিক সিসি ক্যামেরার মতন। গোমতী নদীর সাথে এই বাউলিটি সংযুক্ত ছিল। ৫ তলা বিশিষ্ট বাউলিটির শুধু প্রথম দুই তলা মাটির উপর আর বাকি তিন তলা মাটির নীচে।


বাউলি

হঠাৎ দেখি জিয়া দিকভ্রান্তের মতন এক দিকে থেকে আরেক দিকে ছুটাছুটি করছে। দুঃখী চেহারা!!!? কি ব্যাপার !! আমার ক্যামেরার লেন্সের coverটা পাচ্ছি না ...। জিয়া সব সময় তার electronicsয়ের ব্যাপারে খুবই sensitive এবং sentimental! মনে হয় ভুলে ওটা ভুলভুলিয়াতে রেখে এসেছ। আরে না, এখানেই কোথায় যেন পড়ে গেল। আমরা সবাই মিলে খোঁজাখুঁজি করলাম কিন্তু লেন্স কাভারটা পাওয়া গেল না। যতটা না অসুবিধা হল তার চেয়ে অনেক বেশি জিয়ার মন মেজাজ খারাপ হল। কি আর করা।

সন্ধ্যায় বের হলাম শাহী খাবারের খোঁজে। লক্ষ্ণৌ এসেছি আর এর পৃথিবী বিখ্যাত জনপ্রিয় কাবাব আর...


...নবাবী খাবার চেখে দেখতে হবে না!!! লক্ষ্ণৌ’র বিখ্যাত টুন্ডে কাবাব বা গিলৌটি কাবাব। হিন্দিতে টুন্ডে শব্দের অর্থ হচ্ছে মসৃণ। মুরাদ আলি, যে এই কাবাবের জন্ম দিয়েছিল, সে হঠাৎ পড়ে গিয়ে হাত ভেঙ্গে ফেলে। কিন্তু তাকে কেউ থামাতে পারেনি এই অসাধারণ কাবাব বানানো থেকে। সে ভাঙ্গা হাতেই সৃষ্টি করে গেছে এই অভূতপূর্ব আশ্চর্য স্বাদের কাবাব।

বুড়ো নবাব আসফ উদ দৌলা নড়বড় দাঁতের অক্ষমতায় মাংস খেতেই পারছিলেন না কিন্তু নবাবের মাংস ছাড়া আর কিছুতে রুচি নেই। তিনি তাঁর বাবুর্চিদের ডেকে বলেছিলেন এমন কাবাব বানাও যা চিবুতে হবে না, এমনই মসৃণ আর নরম হবে যে মুখে দিলেই মিলিয়ে যাবে। মুরাদ আলি শাহ গিলৌটি কাবাবের রেসিপির প্রবর্তন করে যা ১২০ রকমের মসলা মিশিয়ে প্রস্তুত করা হয়!!! নবাবী আর কাকে বলে!! আর সত্যি সেই কাবাব মুখে দেবা মাত্র মুখে মিলিয়ে যায়। সেই থেকে গিলৌটি কাবাব আজ পর্যন্ত মহা সমারোহে আর মহা সমাদরে লক্ষ্ণৌর ঐতিহ্য হয়ে বিদ্যমান।

আমিনাবাদ চক লক্ষ্ণৌর পুরানো শহর।এই সব পুরানো শহরের দিকেই আদি ও খাঁটি কাবাব তৈরি হয়। এখানে ছোট ছোট গলির ভিতর ছোট ছোট কাবাব ঘর!! আমরা চারজন হাঁটছি। নজরে পরবার মতন কোন কাবাব ঘর দেখতে পাচ্ছিলাম না যেখানে বসে আয়েস করে কাবাব খাওয়া যেতে পারে। খোলা ড্রেন, ঝাড়ুদারের ঝেটিয়ে ময়লা পরিষ্কারের বহর দেখে শম্পা একটু দ্বিধান্বিত হল। জিয়া তো বিরাট না, না ওর সর্ব শরীরী ভাষায় ব্যক্ত করল। বুঝলাম পুরানো লক্ষ্ণৌর কাবাবের স্বাদ নেবার মত হিম্মত আমাদের নেই।

কি আর করা পথ ঘুরে বের হয়ে পরলাম নতুন শহরের দিকে। তখন সবে সন্ধ্যা। রাস্তায় বাতি জ্বলেছে। মানুষ জন ইতস্ততঃ এদিকে সেদিকে ঘুরাঘুরি করছে। শহরটা খুব পরিচ্ছন্ন না হলেও কেমন যেন একটা চমৎকার আমেজ আছে। আবহাওয়াটাও বেশ ভাল। ঠাণ্ডা আর গরমের মাঝামাঝি একটা আরামদায়ক তাপমাত্রা। যেকোনো শহরই যাই না কেন পায়ে হেঁটে না ঘুরলে শহরটিকে ঠিক উপলব্ধি করা যায় না, মানে আমার অনুভূতিতে তাকে ঠিক অনুভব করতে পারি না। হাঁটতে বেশ ভালই লাগছিল। কিন্তু যতই কাবাবের কথা মনে হচ্ছিল ততই ক্ষুধা বেড়ে যাচ্ছিল। কয়েকটা রাস্তা পাড় হয়ে বাঁদিকে মোড় নিতেই চোখে পরল একটা সুন্দর রেস্টুরেন্ট। ভিতরের সাজানোর রকম দেখে বেশ ভালই মনে হল। আর ছাদ থেকে ঝুলান মনোরম ঝাড় বাতির দিকে তাকিয়ে মনে হল নবাব আমলের কোন দরবার মহল বোধ হয়। আমারা ঢুকে পরলাম। কোনার দিকের টেবিলটার দখল নিলাম। আসে পাশের টেবিলে বসে বেশ কিছু মানুষ জন খাওয়া-দাওয়া করছে।

অর্ডার করবার সময় বেশ মুক্ত মনেই করা হল। শুধু টুন্ডে কাবাব নয়। সাথে মোঘলাই পরোটা, নবাবী বিরানি। সত্যিই তো নবাবী মেজাজ বলে একটা ব্যাপার আছে না!! সেই আমেজে আমরা বোধ হয় মজেছি! অকারণে সাধারণ টেবিল-ক্লথের জায়গায় মনে হল যেন মখমলের জরির ঝালর দেয়া সুদৃশ্য চাদরে টেবিল ঢাকা। চেয়ার গুলি যেন হঠাৎ রাজকীয় হয়ে উঠল। সোনালি রংয়ের হাতল আর নরম গদিতে মোড়া, রূপার পায়ার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে নবাবী চেয়ার। পিছনে একটা হাল্কা মিউজিক বাজছিল। শম্পা সেই সুরে সুর মিলাতে শুরু করল। ভাষা জানার আনন্দটা অনুধাবন করতে পারলাম। আমার কানে মনে হল বোধ হয় নবাব ওয়াজেদ আলি শা’র সেই বিখ্যাত গান ‘যব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী’ তারই সুর বাজছে। শম্পা গল্প করছিল ও যখন বেশ ছোট তখন মাসি’মা আর মেসো’র সাথে লক্ষ্ণৌ বেড়াতে এসেছিল কিন্তু জ্বর আর এত শরীর খারাপ ছিল বিছানা থেকে মাথাই তুলতে পারেনি। সুতরাং কোন বেড়ানই হয়নি। যাক ভালই হয়েছে আবার এসেছ। আগামী কাল আমরা লক্ষ্ণৌ চিকান দেখতে আর কিনতে বের হব। কি বল? অবশ্যই।

সুদৃশ্য পাত্রে কাবাব পরিবেশন করে গেল বেয়ারা। কাবাব আমাদের দেশি কাবাবের মতনই দেখতে। এর স্বাদ আস্বাদন করে বুঝতে হবে। কাবাবের সাথে অনেক পেঁয়াজ আর সালাদ দিয়ে গিয়েছে। কাবাব প্লেটে নেবার আগেই জিয়া সতর্ক করল সালাদ আর পেঁয়াজ খাবে না। কি জলে তাদেরকে বিধৌত করেছে কে জানে। আচ্ছা খাব না। একটু পর আশীষ’দা কাবাবের সাথে একটু পেঁয়াজ নিল। শম্পাও নিল। একটু উসখুস করে আমিও নিলাম। আরে পেঁয়াজ ছাড়া কাবাবের স্বাদ অর্ধেক। সুতরাং আমাদের ১ প্লেট পেঁয়াজে কুলালো না আরো প্লেট আনতে হল!! আর সত্যি অসাধারণ গিলৌটি কাবাব। যেমন নরম, মসৃণ, সুঘ্রাণ তেমনি সুস্বাদু। কাবাব তো খাচ্ছি মজাও লাগছে। কিন্তু আমাদের অন্য খাবারগুলোও খেতে হবে। অতঃপর কাবাব, বিরানি, নান, মাংস সহযোগে একটা বিরাট ভোজন শেষ করে আমরা প্রশান্ত চিত্তে উঠে পরলাম।


গিলৌটি কাবাব


নবাবী বিরানি

যত দেশেই যাই সেখানে গিয়ে স্থানীয় বা বিখ্যাত খাবার চেখে দেখা আমার একটা প্রিয় বিষয়। জাপানের ওসাকাতে গিয়ে Takoyaki, প্যারিসে গিয়ে Croissants, French cheese, সুইজারল্যান্ডে গিয়ে Cheese fondue, মেক্সিকোতে Tacos al pastor, জার্মানির Black Forest এলাকাতে গিয়ে Black Forest কেক খাওয়া.....নানা দেশ,জায়গা আর সে সব দেশ, জায়গার বিচিত্র স্বাদে ভরা বিশেষ এবং বৈশিষ্ট্যময় খাবারের স্বাদ নেয়াটা ভ্রমণ পিয়াসি আত্মার বিলাসী অভিজ্ঞতা।

পরদিন লক্ষ্ণৌর আরো কয়েকটা দর্শনীয় জায়গা ঘুরতে যাব। সারা দিনের ক্লান্তি আর অতিরিক্ত খাওয়ার পর আজ রাতে আর আড্ডা দেয়া হল না। ওটা আগামী কালের জন্য তুলে রাখলাম। ক্লান্ত থাকাতে রাতে ঘুম খারাপ হল না। সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই কেমন যেন পেটের ভিতর একটা তাড়া বোধ হল। হুঁ, নবাবী খাবার জানান দিল তার দাপুটে উপস্থিতি। কি করি? আমাদের বেড়ান এখনো শেষ হয়নি! আর জিয়াকে পায় কে বলা শুরু করে দিল খাও পেঁয়াজ খাও, মজা করে খাও আর এখন মজা বোঝ। আরে এটা কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে। দেখ ঠিক হয় কিনা? আমরা রেডি হয়ে আশীষদা’দের রুমে নক করলাম। আশীষ’দা বেশ নার্ভাস আর করুণ, শম্পা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কি ব্যাপার? শম্পার শরীর খারাপ লাগছে? অবস্থা ভাল না রাত থাকতে শুরু হয়েছে - আশীষ’দা ক্ষীণ কণ্ঠে জানাল। আপনি ঠিক আছেন? আমি এত খারাপ না। আমিও একটু খারাপ তবে মনে হয় এখন ঠিক আছি। হায়রে টুন্ডে কাবাব!! নবাবী আমেজ সহ্য করা সাধারণ মানুষদের জন্য বিরাট ধাক্কা। হুঁ, এরপর স্যালাইন, ওষুধ, শুয়ে থাকা, টয়লেট, শরীর খারাপ, চিন্তা, পায়চারি, উৎকণ্ঠা, প্রচুর জল খাওয়া। অবশেষে একটু ভাল লাগার শুরু।

একটু সময় নিয়ে দুপুরের পরে আমরা বের হলাম শহরটা আর একটু ঘুরে দেখার জন্য....। শম্পার ছোট বেলার লক্ষ্ণৌ দেখার অভিজ্ঞতার সাথে এবারের অভিজ্ঞতার তেমন পার্থক্য না থাকলেও লক্ষ্ণৌ শহর পরিদর্শনে আমরা কোন ছাড় দেইনি। আর লক্ষ্ণৌ চিকান কিনতেও কোন কার্পণ্য করিনি।



লক্ষ্ণৌ’র ঐতিহ্য, নবাবদের গল্প-কাহিনী, পুরানো আমলের নাচের ঝঙ্কারে যে মুক্তির আকুলতা ঘুঙ্গুরের তালে তালে অনুচ্চারিত থাকত সেই সব ইতিহাসকে পিছে ফেলে নতুন লক্ষ্ণৌ পৃথিবীর আর দশটা শহরের মতনই উন্নত হয়ে উঠছে। অনেক আনন্দ আর অভিজ্ঞতায় স্মৃতির ঝোলা পূর্ণ করে ফিরে চললাম আবার সেই দৈনন্দিনের জীবনের বেড়া জালে।

আমার স্মৃতিতে লক্ষ্ণৌ একটা বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। ভুবনের হাটে হাটে আমরা ঘুরে বেড়াই, এক ঘাটের বোঝা অন্য হাটে শূন্য করে দেই। মহাবিশ্বে মহাকাশে এই যে আমাদের বসবাস তা এত ক্ষণস্থায়ী তার মাঝে এই যে আমি এত অকিঞ্চিৎকর তা ভুলে যাই। আমাদের এই আসা যাওয়ার পথের মাঝে প্রতিনিয়ত অজানা ফুল ফুটে। আর তারই সুরভিত স্নিগ্ধতায় জীবনকে বরণ করি অবিরাম। তাই বারে বারে ছুটে বেড়াই এখানে, ওখানে, সেখানে। আমার এ ছুটে বেড়ান এ জীবনে ফুরবে না।




মলি আহমেদ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া


Share on Facebook               Home Page             Published on: 7-Jan-2022

Coming Events:
বৃষ্টির সম্ভাবনার কারণে মেলার তারিখ ১ দিন পিছিয়ে ২১ এপ্রিল ২০২৪ (রবিবার) করা হয়েছে......




A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far