আশা-নিরাশার অরণ্যে মাসুদ পারভেজ
২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদ রয়েছে মাত্র ৬২ জন মানুষের হাতে। আতঙ্কিত হওয়ার মতো সংবাদ। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৮৮ জন। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জানুয়ারি ২০১৬ সালে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য এসেছে।
পৃথিবীতে এখন প্রায় সাড়ে-সাত বিলিয়ন মানুষের বাস। মানুষ তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দেয় অর্থ উপার্জনে কিংবা অর্থ উপার্জনের পথ খুঁজতে। জীবনের মৌলিক চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে লেখাপড়া শেষে চাকরী কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত হয়ে ভাগ্যবান মানুষেরা সম্পদের অধিকারী হয়। উত্তরাধিকার সূত্রেও সম্পদের অধিকারী হওয়ার সুযোগ পায় অনেকে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী না নিয়েও পরিশ্রম, অধ্যবসায় কিংবা ভাগ্যক্রমে অনেকেই অনেক সম্পদের অধিকারী হয়েছেন। আর সেজন্যে হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের গল্প পড়া অনেকেরই প্রিয় বিষয়। বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট, ল্যারি এলিসন, ওয়ালটন পরিবার, মার্ক জাকারবার্গের মতো ধনী ব্যক্তিদের আয়, ব্যয়, সঞ্চয়, জীবনযাত্রা, সামাজিক কর্মকাণ্ড, ইত্যাদি নিয়ে অনেকেরই আগ্রহের শেষ নেই।
প্রায় বিশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত গেটস ফাউন্ডেশন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যারিটেবল প্রতিষ্ঠান। চিকিৎসা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ১০০টি দেশে ২০১৫সাল পর্যন্ত গেটস ফাউন্ডেশনের মোট আর্থিক দানের পরিমাণ প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার। ডিসেম্বর ২০১৫ তে মার্ক জাকারবার্গ তাঁর আয়ের ৯৯% যার পরিমাণ ৪৫ বিলিয়ন ডলার দাতব্য কাজের জন্যে দান করার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রথম সন্তানের জন্মদিনে মার্কের এই ঘোষণা পৃথিবীর মানুষের কাছে ব্যতিক্রমধর্মী এক অনন্য উপহার বলে অনেকেই মনে করেন। বিল কিংবা মার্কের তুলনায় বৃহত্তর বাংলার হাজী মুহাম্মদ মহসিন বিত্তশালী ছিলেন কিনা জানা নেই তবে দানবীর ব্যক্তি হিসাবে তাঁর নাম সবারই জানা। প্রায় ৭৫ বছর আগে মহাত্মা গান্ধীর উক্তি – "the world has enough for everyone’s need but not enough for everyone’s greed"-কে সামনে রেখেই হয়তো এই মহীয়সী মানবগণ তাঁদের অর্জিত উপার্জন মানব কল্যাণে মহতী কার্যক্রমের মাধ্যমে দান করেছেন।
জনসংখ্যার তুলনায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ধনী মানুষের বাস সুইজারল্যান্ডে হলেও বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষদের অধিকাংশই থাকেন আমেরিকায়। এশিয়ায় এই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি জাপানে। আর আমাদের বাংলাদেশে? বাংলাদেশের ধনীরা কতটুকু ধনী? ২০১৫সালে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ বাংলাদেশের মানুষের গড় আয় ১৪০০ ডলারের নিচে হলেও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বিশ্ব অর্থনীতির জিডিপি-র রাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ৫৫ তম ধনী দেশ। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং রপ্তানি-মুখী শিল্প থেকে আয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ বেড়ে এখন ২৭বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে - এর আগে কখনোই ফরেন রিজার্ভ এতো উচ্চতায় পৌঁছায়নি। বাংলাদেশের বর্তমান ৬% বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার আগামী তিন বছরে ৭% হবে। পত্রিকায় দেখলাম - ঢাকায় নবনিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আগামী ২০২১সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নিম্ন-মধ্যম থেকে মধ্যম আয়ের দেশে ওঠার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার কথা জানিয়েছেন। এসব সংবাদে প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেকের মতো আনন্দিত হওয়ার পাশাপাশি ডিসেম্বর ২০১৫ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি-র রিপোর্ট পড়ে মর্মাহত হয়েছি। এই রিপোর্টে এসেছে - ২০১৩ সালে শুধুমাত্র এক বছরে ৯.৬ বিলিয়ন ডলার যার পরিমাণ ৭৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে যা পূর্ববর্তী বছরে পাচার হওয়া টাকার তুলনায় প্রায় ৩৫% বেশি। বিক্ষিপ্তভাবে ভাবছিলাম – টাকা কি এখন রপ্তানি পণ্য, কতগুলি ১০০০ টাকার নোটে ৭৫হাজার কোটি টাকা হয়? পাচার-কৃত অর্থ যদি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে থাকতো তাহলে এই বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়ে দেশে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্প-কারখানা, টিভি-চ্যানেল, ইত্যাদি তৈরি হতো, চাকরি পেতো বাংলাদেশের মানুষ, কর্ম-সংস্থানের অভাবে গ্লানিময় বেকার জীবনের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতো শিক্ষিত যুবকরা।
এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশী মানুষ এখন প্রবাসে থাকেন। প্রবাসে দুই দশকেরও বেশি থাকার এই দীর্ঘ সময়ে পরিচিত প্রায় সব বাংলাদেশীরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা সম্মিলিতভাবে দেশে ও বিদেশে আর্থিক দান এবং সাহায্য করেন। বাংলাদেশে পরিচিত এবং অপরিচিত অনেকেই নিজ অর্থে প্রতিষ্ঠিত জনহিতকর, সেবামূলক, দাতব্য সংস্থা প্রাতিষ্ঠানিক আকারে সুনামের সাথে দীর্ঘ দিন কাজ করে চলেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের এই ৪৫ বছরে আমরা পেয়েছি - নোবেল বিজয়ী, খাদ্যে স্বয়ং-সম্পূর্ণতা, শিক্ষা ও নারীর অগ্রগতিতে অভূতপূর্ব সাফল্য, জাতিসংঘের শান্তি-রক্ষা মিশনে আন্তর্জাতিক খ্যাতি, নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা, এছাড়াও আরো অনেক কিছু…তবে এখনো পাইনি অন্তত: আরেকজন আন্তর্জাতিক মানের দানশীলের নাম।
কর ফাঁকি দিয়ে বৈধ আয়ের সাথে সামঞ্জস্য-বিহীন সম্পদের কিংবা ক্ষমতার অধিকারী মানুষের নৈতিকতা সর্বদাই নিম্নমুখী। একদিকে তা’ যেমন কোনো অবস্থায় অনুকরণীয় নয় তেমনি এরকম মানুষের কাছ থেকে দানের দৃষ্টান্ত আশা করা যায় না। জানুয়ারি ২০১৬সালের ট্রান্সপারেনসি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে দেখলাম - ২০১৫ সালে বিশ্বের শীর্ষ দূর্নীতিগ্রস্ত দেশসমূহের মধ্যে ১৩ তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। গত ১৫ বছরে শীর্ষ দূর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১-১৫ এর মধ্যে। উন্নয়নশীল দেশের জন্যে খুবই হতাশাব্যন্জক চিত্র। দুর্নীতি এক বৈশ্বিক সমস্যা - এর গভীরতা এবং ব্যাপকতার ওপর নির্ভর করে মানুষের মানসিকতা। সার্বিক সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ক্রমবর্ধমান অবনতি, মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তি ও পরিবারের মেধা-ভিত্তিক সৃজনশীল কাজের স্থবিরতা, দারিদ্র-সীমার নিচে বসবাসরত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অপারগতা, ইত্যাদির কারণে হয়তো আমাদের দেশে এখনও আন্তর্জাতিক মানের আরেকজন দানশীল মানুষের আবির্ভাব হয়নি।
বিল গেটস তাঁর একক প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন মাইক্রোসফট; পরবর্তীতে গেটস ফাউন্ডেশন যা মানুষকে দিয়েছে পোলিও এবং ম্যালেরিয়া মুক্ত বিশ্বের প্রতিশ্রুতি। চ্যারিটি ওয়াচ ওয়েবসাইটে দেখলাম - ২০১৫সালে প্রতি ১০০ডলার ফান্ড সংগ্রহের জন্যে বড় বড় আন্তর্জাতিক চ্যারিটেবল প্রতিষ্ঠান যেমন - ক্লিনটন ফাউন্ডেশন ও হেলেন কেলার ৩%, রোটারি ফাউন্ডেশন ও সেভ দ্যা চিলড্রেন ৮%, অ্যাকশন এইড ১০%, কেয়ার ১৩%, অক্সফাম ১৭%, ওয়ার্ল্ড ভিশন ১৮%, রেডক্রস ২৫% পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে প্রশাসনিক, বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য খরচে। পৃথিবীতে এখন খাওয়ার অভাবে প্রতিদিন ২১,০০০জন মারা যায়, পর্যাপ্ত খাবারের অভাব রয়েছে প্রতি ৯জনের মধ্যে ১জনের, প্রতিদিন ১.২৫ডলার দিয়ে জীবন চলছে এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষের - এসব তথ্য আমাদের অনেকেরই জানা। কখনো ভাবি…যুদ্ধে মানুষ মারার জন্যে পৃথিবীতে আজ যতো অর্থ ব্যয় হয় তা যদি চিকিৎসা গবেষণায় সদ্ব্যবহার হতো তাহলে হয়তো অনেক রোগ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতো।
আজকের এই লেখার পরিসংখ্যান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে প্রকাশিত। অনেক রিপোর্টের সত্যতা, গ্রহণযোগ্যতা, নিরপেক্ষতা, ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করতে অনেককেই শুনেছি। তবে রিপোর্টে প্রকাশিত সূচকের মানদণ্ডে কোনো ব্যক্তি, দেশ কিংবা সংস্থার অবস্থান যেখানেই হোক না কেন আমরা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সারাদিনে আমাদের নিজ নিজ প্রতিটি কাজের মূল্যায়ন করলে নির্ভুল বিশ্লেষণ পাই। যুগ যুগ ধরে নৈতিক শিক্ষার আলোকে মানুষ নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে প্রকৃতির কল্যাণে। ছোট বেলায় পড়েছিলাম - ত্যাগের আনন্দ তুলনাহীন। মার্টিন লুথার কিং-এর এক স্মরণীয় বাণীতেও শুনেছি – "life’s most persistent and urgent question is – what you are doing for others"।
বিশ্বব্যাপী সম্পদের বৈষম্য এক জটিল বিষয় যা হয়তো দূর করা সম্ভব নয়। সম্পদের সুষম বণ্টন হয়তো আমরা করতে পারবো না। কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতাকে সামনে রেখে আমরা সবাই প্রতিদিন নিজ খরচের কিছু অংশ সঞ্চয় করে কিংবা আর্থিকভাবে সম্ভব না হলেও মেধা ও সময় দিয়ে তা’ যেকোনো কল্যাণকর কাজের মাধ্যমে পৃথিবীতে নিজেদের ফুট-প্রিন্ট রেখে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারি। আশা-নিরাশার অরণ্যে তবুও আশাবাদী হতে চাই।
মাসুদ পারভেজ, সিডনী, mmparvez@yahoo.com
|