বিশ্ব ডাক দিবস মাসুদ পারভেজ
আজ ৯ই অক্টোবর ২০১৪সাল - বিশ্ব ডাক দিবস। ১৪০বছর আগে ১৮৭৪সালে ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পোস্টাল সার্ভিসের ব্যবহার, প্রয়োজনীয়তা, তাৎপর্য এবং গুরুত্ব আরোপের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর ১৯২টি সদস্যভুক্ত দেশে প্রতি বছর এই দিন উদযাপিত হয়।
১৮৪০সালে সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডের Sir Rowland Hill ডাকটিকেট উদ্ভাবন করেন যা' “Penny Post” নামে ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরে একই খরচে যেকোনো দূরত্বে চিঠি পাঠানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। ধীরে ধীরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চিঠি আদান-প্রদানের পাশাপাশি পোস্টাল সার্ভিসের আওতায় টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, পার্সেল, সরকারী স্টক-বন্ড, ব্যাংকিং লেনদেন, ইনস্যুরেন্স, পেনশন, ইত্যাদি ব্যবসা-বাণিজ্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ বসবাস করে গ্রাম এবং প্রত্যন্ত এলাকায়। আনুমানিক ৬৪০,০০০টি পোস্ট-অফিস/শপ/আউট-লেট সারা পৃথিবীর ৭.২বিলিয়ন মানুষের জন্য বিভিন্ন ধরনের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সেবা প্রদান করছে নির্ভরতার সাথে বিভিন্ন দেশে।
আমেরিকাতে ১৮৪৭সালে সর্বপ্রথম মানুষের পোট্রেট হিসাবে বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিনের ছবি ১০সেন্ট মূল্যমানের ডাকটিকেটে স্থান পায়। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম জার্মানি ১৯৪২সালে পোস্ট-কোডের প্রচলন করেছে। ১৯৬৪সালে ইংল্যান্ডের রাজকীয় পরিবারের বাইরের ব্যক্তিত্ব হয়ে উইলিয়াম শেকসপিয়ার ইংল্যান্ডের ডাকটিকেটে স্থান পেয়েছেন। পৃথিবীর একটিমাত্র দেশ - ইংল্যান্ডের ডাকটিকেটে দেশের নাম লেখা হয় না কখনোই। ২০১৪সালে Ebola রোগে এপিডেমিক-ভাবে আক্রান্ত আফ্রিকার দেশ - সিয়েরালিয়ন পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ১৯৬৪সালে আঠাযুক্ত/adhesive স্ট্যাম্প তৈরি করেছে। ১৯৭৩সালে ভুটান গ্রামোফোন রেকর্ডের আকারে এক আশ্চর্যজনক ডাকটিকেট সার্কুলেট করে যা' রেকর্ডারের ওপরে রাখলে ভুটানের জাতীয় সঙ্গীত শোনায়!!!
পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে একটি সাধারণ চিঠি পাঠাতে খরচ হয় কোরিয়াতে ০.৫২ডলার, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা এবং কানাডাতে ০.৭০-০.৭৩ডলার আর ইউরোপে (আইসল্যান্ড, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক) ১.৫৫-১.৮৬ডলার। আধুনিক বিশ্বে ডিজিটাল কমিউনিকেশন/অল্টারনেটিভসের আবিষ্কার এবং নির্ভরযোগ্যতার সাথে তা' দ্রুত বিস্তারের ফলে পোস্টাল সার্ভিসের চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তা আজ অনেকাংশে হুমকির সম্মুখীন। ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, বিভিন্ন ধরনের চিঠি, বিল ইত্যাদি সহ সব ধরনের গ্রাহক সেবা এবং ট্রানসাকশানের জন্য সরকারী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পেপার-লেস অনলাইন সিস্টেমের ফলে সময়, শ্রম এবং খরচের সাশ্রয় হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে (২০০৮-২০১৩সালে) বার্ষিক চিঠি বিতরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে যা' বছর প্রতি গড়ে অস্ট্রেলিয়াতে ৫.৩%, নিউজিল্যান্ডে ৫.৮% এবং ইংল্যান্ডে ৭.৪%। ২০০৯-২০১০সালে গড় প্রতি অস্ট্রেলিয়ান পরিবার চিঠি পাঠানোর জন্য এক বছরে ১৯ডলার ব্যয় করেছে যা' ফোন (১৭৫০ডলার), টেলিভিশন(৬৭০ডলার), ইন্টারনেট (৪০৪ডলার), কম্পিউটার (৩৪৮ডলার), ইত্যাদিতে খরচের তুলনায় অনেক অনেক কম। ডাকবিভাগের প্রধান আয়ের উৎস হলো ডাকটিকেট বিক্রি এবং চিঠি বিতরণের মাধ্যমে। আগামী ২০১৭সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল গভর্নমেন্ট সকল প্রকার গ্রাহক সেবা প্রদানের জন্য e-government পলিসি নির্ধারণ করেছে - যা' হয়তো অস্ট্রেলিয়া পোস্টের আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে…
বিবিসি'র এক রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী - প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, যুদ্ধে নিয়োজিত সৈন্যদেরকে তাদের প্রিয়জন কিংবা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পাঠানো আনুমানিক ১২মিলিয়ন চিঠি প্রতি সপ্তাহে বিলি করা হতো।…প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য প্রিয়জনদের হাতের লেখার এই চিঠির অনুপ্রেরণা নিশ্চয়ই যুদ্ধাস্ত্রের চেয়েও অনেক শক্তিশালী ছিলো। ভালবাসার ভাষায় প্রেয়সীর হাতে লেখার চিঠির আবেগ, গ্রাম ছেড়ে শহরের কলেজ/ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাওয়া ছেলের কাছে মায়ের লেখা চিঠিতে ছুটিতে ছেলের বাড়িতে ফেরার জন্যে ব্যাকুলতার কথা, কিংবা প্রিয়জনের কাছ থেকে চিঠির প্রত্যাশায় ডাকপিয়নের জন্যে অপেক্ষা করার দিন হয়তো আজ ফুরিয়ে গেছে - ফেসটাইম ফোন, skype, টেক্সট-মেসেজ, ই-মেইল ইত্যাদির সুফলতায়…প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সারা পৃথিবীর মানুষের জীবনযাত্রার গতি এবং মানের অনেক অনেক উন্নতি হয়েছে কিন্তু অনেকাংশে তা' কেড়ে নিয়েছে চিঠির আবেগ আর অনুভূতি।
অনলাইন বিজনেসের ফলে আজ বিভিন্ন দেশের পণ্য পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে ডাকবিভাগ কিংবা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। গ্লোবাল অনলাইন সেলস এবছরে ১.৫ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আগামীতে নতুন নতুন সেবা এবং প্রোডাক্ট হয়তো যুক্ত হবে পোস্টাল সার্ভিসের আওতায়..আয়ের উৎস বেড়ে যাবে পোস্টাল সার্ভিসের অস্তিত্ব রক্ষায়…আজ বিশ্ব ডাক দিবসে পোস্টাল সার্ভিসের ক্রমবর্ধমান সাফল্য কামনা করি।
mmparvez@yahoo.com সিডনী ০৯/১০/২০১৪
|