বিশ্ব শান্তি দিবস মাসুদ পারভেজ “যুদ্ধ এবং সহিংসতা মুক্ত” পৃথিবী গঠনে জাতিসংঘের নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারা বিশ্বে প্রতি বছর ২১শে সেপ্টেম্বর পালিত হয় “বিশ্ব শান্তি দিবস”। ২০১৪ সালের এই দিবসের থিম - “Rights of Peoples to Peace”।
টেরোরিস্ট একটিভিটির সংখ্যা, আন্তর্জাতিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ কিংবা অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ এবং সংঘাতে লিপ্ততা, কোনো দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ডিসপ্লেসড মানুষের সংখ্যা, যুদ্ধাস্ত্র তৈরি এবং আমদানি/রপ্তানি,…ইত্যাদির মাপকাঠিতে, ১৬২ দেশের ওপর গবেষণার ভিত্তিতে গ্লোবাল পিস ইনডেক্স ২০১৪তে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশের প্রথম দশটির মধ্যে রয়েছে - আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, কানাডা, জাপান, বেলজিয়াম এবং নরওয়ে। ১৫তম স্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া যার পরের স্থানে ভুটান। ২০২২ সালের ওয়ার্ল্ড-কাপের হোস্টকান্ট্রি কাতারের স্থান ২২শে, যা' আরব দেশসমূহের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকারী। ইউরোপীয় অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশ শান্তিপূর্ণ হলেও, আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বিশেষভাবে আফগানিস্তানের যুদ্ধে অংশগ্রহণ, শক্তিশালী মিলিটারি গঠনে আর্থিক বিনিয়োগ,…ইত্যাদির কারণে অভ্যন্তরীণ কনফ্লিক্ট না থাকা স্বত্বেও ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের অবস্থান তালিকার ৪৭ এবং ৪৮তম স্থানে। বাংলাদেশের অবস্থান (৯৮) আমেরিকা, ইন্ডিয়া, ইসরাইল, উত্তর কোরিয়া এবং পাকিস্তানের ওপরে। পৃথিবীর সবচেয়ে কম শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকার শীর্ষে রয়েছে - আফগানিস্তান (১৬১) এবং সিরিয়া (১৬২)। আন্তর্জাতিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ কিংবা অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং সংঘাত থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত সুইজারল্যান্ডের অবস্থান প্রথম না হয়ে পঞ্চম হওয়ার পেছনে রয়েছে - প্রতি ১০০,০০০জন মানুষের বিপরীতে বিপুল পরিমাণের যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করা এবং তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রপ্তানি করা। সাম্প্রতিক কালের আন্তর্জাতিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও, দেশের চলমান কোন্দল, সমস্যা, এক নায়ক-তন্ত্রের সামরিক শাসনের কারণে উত্তর কোরিয়ার অবস্থান তালিকার শেষ দশের মধ্যে।
একসময়ের নিউক্লিয়ার শক্তির পক্ষে জোরালো কণ্ঠের লিডার এবং ২০১০-২০১১সালের ক্ষমতাসীন জাপানের প্রধানমন্ত্রী Naoto Kan জাপানে পারমানবিক শক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করেন। ২০১১সালের জাপানের ফুকুশিমা শহরে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সুনামিতে নিউক্লিয়ার বিপর্যয়ের পরে, Naoto Kan বর্তমানে পারমানবিক শক্তির ঘোর বিরোধী এবং রিনিউএবল এনার্জির একজন অ্যাডভোকেট। আগস্ট ২০১৪তে তিনি সপ্তাহব্যাপী অস্ট্রেলিয়া সফরে এসে অস্ট্রেলিয়া থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইউরেনিয়াম রপ্তানি বন্ধের আহবান জানান। গত ৩৪ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার নরদার্ন টেরিটোরিতে অবস্থিত Ranger Uranium Mining Firm থেকে আমেরিকা, জাপান, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, সুইডেন, ইন্ডিয়া, চায়না এবং দক্ষিণ কোরিয়াতে নিয়মিতভাবে ইউরেনিয়াম রপ্তানি হচ্ছে।
১৯৪৫সালে পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহার করে জাপানের বেসামরিক নিরীহ জনগণকে হত্যা করার প্রথম ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে এটম বোমার আঘাত থেকে বেঁচে যাওয়া বর্তমানে জীবিত জাপানী নাগরিকদের গড় বয়স প্রায় ৮০বছর। যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া, যুদ্ধের পরে নিউক্লিয়ার রেডিয়েশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সংগ্রামের মধ্যে বড় হওয়া, শারীরিক অসুস্থতার কথা, অসহায়ত্বের কথা, যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা, যুদ্ধের স্মৃতির কথা,…ইত্যাদি সযত্নে, অকপটে, নিরলস-ভাবে শুনিয়ে যাচ্ছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এখনো বেঁচে আছেন এরকম অনেক হিরোশিমা-নাগাসাকির নাগরিক। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে হয়তো আগামী এক-দুই দশকের মধ্যে দীর্ঘায়ু এই জাপানীরা পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন। আগামী প্রজন্মের জন্যে তখন থেকে যাবে শুধুমাত্র ধারণকৃত তথ্যচিত্র আর সংরক্ষিত নমুনা। নির্মম, ভয়াবহ, বিভীষিকাময় হিরোশিমা-নাগাসাকির ঘটনা-বার্তা প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে শোনার সুযোগ প্রাকৃতিক নিয়মে হারিয়ে যাবে তাই তা' রক্ষা করার জন্যে সৃজনশীল জাপানীরা একটি দীর্ঘ-মেয়াদী প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে প্রায় ৮০বছর বয়সী যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া জাপানী নাগরিকদের কাছ থেকে তাঁদের বর্ণিত কাহিনী তাঁদের মতো করে বলার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে উৎসাহী তরুণ-তরুণীদের। নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা তৈরি হচ্ছে কালো ইতিহাসের নির্মম তথ্যের বাহক হয়ে…শান্তির বার্তা পৌঁছানোর জন্যে…।
আন্তর্জাতিক, অভ্যন্তরীণ, কমিউনিটি, পারিবারিক কিংবা ব্যক্তিগত পর্যায়ের যেকোনো উন্নয়নের প্রথম শর্ত - শান্তি। শান্তির পথ অনেক দীর্ঘ, অনেক ক্ষেত্রে সময় সাপেক্ষ। শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্যে প্রয়োজন হয় ত্যাগ আর ক্ষমা করার মতো উদার মনের। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ-বিরোধী মহানায়ক, জাতিরজনক, প্রথম ব্ল্যাক প্রেসিডেন্ট, নোবেল বিজয়ী নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলনে অবর্ণনীয় নিষ্ঠুর নির্যাতন সহ্য করেছেন দীর্ঘ ২৭বছর কারাবন্দী জীবনে। এই মহানায়ক ক্ষমতায় আসার পরে অত্যাচারী, নিপীড়ক, শ্বেতাঙ্গ শাসকদের ওপর প্রতিশোধ নেননি, বরং ক্ষমা করে দেন। প্রতিষ্ঠা করেন ভ্রাতৃত্ব, মানবাধিকার ও শান্তি। স্মরণীয় হয়ে রয়েছে ম্যান্ডেলার বাণী…We can forgive but not forgotten…
আজ বিশ্ব শান্তি দিবসে, আসুন আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে শান্তি রক্ষা এবং প্রতিষ্ঠার জন্যে স্মরণীয় কিছু করে রাখি…
mmparvez@yahoo.com সিডনী ২১/০৯/২০১৪
|