ওয়ান ডিশ পার্টি মাসুদ পারভেজ
সিডনির বিভিন্ন সাবার্বে বসবাসরত কয়েকটি পরিবারের আয়োজনে গতবছরে এক ওয়ান ডিশ পার্টিতে অংশগ্রহণ করে বেশ আনন্দ পেয়েছি। সবার ব্যস্ততা ও সময়ের অভাবে সে রকম আয়োজন আর হয়ে ওঠেনি। এ’বছরের শুরুতে আয়োজকদের কয়েকজন ফোন করে আবার ওয়ান ডিশ পার্টির আয়োজন এবং একই সাথে আমাদের বাড়ি ভেন্যু হিসাবে ব্যবহার করা যায় কিনা ভেবে দেখার অনুরোধে আমার সহধর্মিণী ও আমি সাদরে সম্মতি দিয়েছি। ঠিক হলো অস্ট্রেলিয়া ডে-তে আমাদের বাড়িতে ১২টি পরিবারের ক্লাস টু থেকে ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া বাচ্চারাসহ মোট ৪২জন ওয়ান ডিশ পার্টিতে আসবে। প্রতিটি পরিবার সবাই হোস্ট এবং সবার জন্যে একটি করে খাবার নিয়ে আসবে ওয়ান ডিশ পার্টিতে। আমার বাচ্চারা সবসময়ই মেহমান এবং বিশেষভাবে ছোট-বাচ্চাসহ পরিবার বাসায় আসা পছন্দ করে - আর সেজন্যেই আমাদের ভেন্যুতে ওয়ান ডিশ পার্টির আয়োজনের দিনটির জন্যে সানন্দে অপেক্ষা করতে থাকে।
সুন্দর পরিষ্কার নীল আকাশের দুপুরের শুরুতেই সবাই আসতে থাকে। ধীরে ধীরে মুখরোচক, লোভনীয়, সুস্বাদু খাবারে ভরে যায় বাসার ব্যাকইয়ার্ডে পারগোলার আউটডোর টেবিল। বিভিন্ন বাসা থেকে নিয়ে আসা বিভিন্ন খাবারের সুঘ্রাণে শোভা পায় সাজানো পরিবেশ। অনট্রেতে প্যাটিস, তারপরে সাদা ভাত দিয়ে গরু মাংসের রেজালা, কাবাব, তন্দুরি চিকেন, মৃগেল মাছের তরকারি, বেগুন দিয়ে শুঁটকি মাছ, বিভিন্ন পদের ভর্তা, কাঁচা আম দিয়ে ডাল, সালাদ, কোমল পানীয় ইত্যাদির পরিবেশনায় ভূরি ভোজে সবাই তৃপ্তি পায়। ভোজের শেষ-পর্বে থাকে - তরমুজ, রসগোল্লা ও কেক। আমার মেয়ের বানানো ব্রাউনি বাচ্চা ও বড়দের কাছে লোভনীয় হয়।
মধ্যাহ্ন ভোজের শেষে সবাই অপেক্ষা করে দ্বিতীয় পর্বের জন্যে। বেলা চারটার পরে ১৫জন বাচ্চা সুইমিং কস্টিউম পরে একযোগে নেমে পড়ে সুইমিং পুলে - আহা সে কি আনন্দ তাদের!!! আর বড়রা ফোল্ডিং চেয়ার পেতে কিংবা ঘাসের ওপর ম্যাট বিছিয়ে বসে পড়ে গল্পের আয়োজনে। পড়ন্ত বিকেলের চকচকে সোনালী রোদ আর হিমেল বাতাসে, অদূরে বাচ্চাদের আনন্দঘন কোলাহল, পুলের ধার ঘেঁষে কচি বাঁশ-ঝাড়ের পাশে ছায়া ঘেরা বসার জায়গা থেকে বাচ্চাদের আনন্দ মুখর মূহুর্তের ছবি ধারণ করতে অনেক মা বেশ ব্যস্ত সময় উপহার দিয়েছেন। বাড়তি আকর্ষণ ছিল - আমার সহধর্মিণীর বানানো ঝাঁজালো সরিষার তেলে চানাচুর আর মুড়ি দিয়ে ঝাল-মুড়ি। বাচ্চাদের জন্যে ছিল রকমারি ফিঙ্গার ফুড। প্রবাস জীবনে একসাথে এতগুলি নির্ভেজাল হাসিমুখ পাওয়া নিতান্তই ভাগ্যের ব্যাপার।
জানুয়ারি মাসের লম্বা দিনের অস্ট্রেলিয়া ডে-তে একই সাথে বাচ্চাদের স্কুল হলিডের সময়ে কেউই আর পুল থেকে উঠতে চায় না। সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে বড়রা সবাই যখন ধীরে ধীরে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন আমার সহধর্মিণী সবাইকে রাতে খেয়ে যাওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানায়। সবাই এই আমন্ত্রণকে সাদরে গ্রহণ করেন। আমার সহধর্মিণী তন্দুরি চিকেন আর ভাবীদের সহযোগিতায় ডিম-ভূনা ও খিচুড়ি রান্না করে ফেলেন অল্প সময়ে - অনেকটা বনভোজনের মতো। মধ্যাহ্ন ভোজের আমাদের ওয়ান ডিশ পার্টি শেষ হয় মধ্য রাতে। নিজ নিজ বাসায় ফেরার আগে সিদ্ধান্ত হয় প্রতি দুই মাসে আমরা আবার মিলিত হবো আরেক বাসায়। রোটেশনে সবার বাসায় এই ওয়ান ডিশ পার্টির আয়োজন হবে। ইতিমধ্যে, মার্চ মাসে আরেক বাসায় আমাদের দ্বিতীয় পার্টি অনুষ্ঠিত হয়েছে - পরবর্তীটির জন্যে অপেক্ষায় সবাই।
সিডনির বিভিন্ন এলাকায় এখন সমমনা পরিবারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গানের, কবিতার কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমাদের ওয়ান ডিশ পার্টি - একটি পারিবারিক প্যাকেজ। যার মহৎ উদ্দেশ্য হলো - উন্নত মানের সুস্বাদু খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি পরিবারের সবাই একসঙ্গে মনে রাখার মতো কিছু ভালো সময় কাটানো।
চিকিৎসক বন্ধুর কাছে শোনা এক কৌতুক দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্যে ৭০বছর বয়স্ক এক দম্পতি চিকিৎসকের কাছে গিয়েছেন। ডিমেনশিয়া রোগের শুরু হওয়ার লক্ষণ দেখে চিকিৎসক তাদেরকে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে যেকোনো কাজের কথা যেমন - সকালে, দুপুরে কিংবা রাতে কি খাবেন, কখন কি ঔষধ খেতে হবে, কোথায় বেড়াতে যাবেন, ইত্যাদি লিখে রাখার পরামর্শ দেন। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে স্বামী সুপ খেতে চান। স্ত্রী রান্নাঘরে যাওয়ার আগে স্বামী তাকে সুপ বানানোর কথা লিখে নিয়ে যেতে বলেন। নিজের ওপর সব সময়ই আস্থা থাকায় স্ত্রী বলেন - লিখে রাখার প্রয়োজন নেই। স্ত্রী কিছুক্ষণ পরে ডিম-ভাজি নিয়ে এসে স্বামীকে খেতে দেন। ডিম-ভাজি দেখে স্বামী বলেন - আমিতো আম খেতে চেয়েছিলাম !!! প্রবাস জীবনে, আসুন আমরা সবাই এই অবস্থা হওয়ার আগেই যতটুকু পারি আনন্দে সময় কাটানোর চেষ্টা করে যাই।
মাসুদ পারভেজ, সিডনি, mmparvez@yahoo.com
|