Made in Universe মাসুদ পারভেজ ওয়াশিংটন পোস্টে কয়েকদিন আগে পড়েছিলাম "পৃথিবীর চার-ভাগের-তিন-ভাগ হ্যাজেলনাটের উৎপাদনকারী দেশ তুরস্কে এ'বছর খারাপ আবহাওয়ার কারণে হ্যাজেলনাটের উৎপাদন অন্য বছরের তুলনায় ৩০% কম হয়েছে। আর এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় হ্যাজেলনাটের দাম গত বছরের তুলনায় ৬০শতাংশ বেশী। হ্যাজেলনাটের উচ্চ মূল্যের প্রভাবে পৃথিবীর বড় বড় চকলেট উৎপাদনকারী কোম্পানিসহ নাটেলা (Nutella) মেকার - Ferrero গ্রুপ এ'বছর তাদের হ্যাজেলনাট সমৃদ্ধ প্রোডাক্টের মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে"।
Ferro গ্রুপের হেডকোয়ার্টার ইতালিতে হলেও প্রায় সব মহাদেশে তাদের কারখানা রয়েছে - যেখানে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের প্রোডাক্ট যার ইনগ্রেডিয়েন্ট এবং র'মেটেরিয়াল তারা সংগ্রহ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। যেমন ধরা যাক - বাচ্চাদের প্রিয় নাটেলা ব্রান্ডের ৭৫০গ্রামের এক জার তৈরিতে ১০০গ্রাম হ্যাজেলনাটের প্রয়োজনে Ferro গ্রুপ পৃথিবীর উৎপাদনের প্রায় ২৫শতাংশ হ্যাজেলনাট কিনে নেয় তুরস্ক থেকে, আর এই নাটের সাথে মালয়েশিয়ার পাম-অয়েল, নাইজেরিয়ার কোকো,
ইত্যাদি মিশিয়ে
প্যাকেজিং প্রোডাক্ট চায়না থেকে সংগ্রহ করে প্রতি বছর ২৫০,০০০টনেরও বেশি নাটেলা বিভিন্ন দেশের কারখানা থেকে তৈরি করে পৃথিবীর ৭৫টিরও বেশি দেশে বাজারজাত করছে।
১৭০বছর ধরে সুস্বাদু চকলেট তৈরি করে সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত - সুইজারল্যান্ডের লিন্ট (Lint)। রং, স্বাদ এবং গন্ধে পৃথিবীর সেরা ওয়েস্ট আফ্রিকার ঘানার কোকো লিন্ট চকলেটের প্রধান উপকরণ। আর এই কোকো - ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দুধ-চিনি, তুরস্কের হ্যাজেলনাট, আমেরিকার এলমন্ড,...ইত্যাদির সাথে মিশে তৈরি হয়
মাস্টার চকলেটর সিনস ১৮৪৫-এর লিন্ট চকলেট যা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই পাওয়া যায়।
উন্নত তথ্য-প্রযুক্তি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্পায়নে বিনিয়োগ, প্রোডাক্ট স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন, উন্মুক্ত বাজারনীতি, ক্রম-বর্ধিত ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক, সময়োপযোগী রেগুলেটরি সিস্টেম,
ইত্যাদির অত্যাধুনিক ইন্টিগ্রেশনের ফলে বিশ্ব-বাণিজ্যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, এক দেশের র'মেটেরিয়াল কিংবা ফিনিশড প্রোডাক্ট অন্য দেশে পৌঁছে যাচ্ছে। এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের সুফলতায় পণ্যের সহজলভ্যতার মাত্রা বহুগুণে বেড়েছে যা মানুষের চাহিদা, রুচি, ব্যবহার ইত্যাদিতে ব্যাপক পরিবর্তনের পাশাপাশি বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন-নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। একইসাথে বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলি ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য তাদের ফিনিশড প্রোডাক্ট কিংবা সেবার খরচ কমাতে উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে লেবার-মার্কেট তৈরি করছে যার ফলে অনশোর থেকে অফশোরে জব ট্রান্সফার হচ্ছে। গত একবছরে অস্ট্রেলিয়ার বড় বড় কোম্পানি Qantas, Telstra, Optus, Big4 Bank
থেকে কত জব অফশোরে ট্রান্সফার হয়েছে তার সঠিক তথ্য Australian Bureau of Statistics দিতে পারবে।
হঠাৎ মনে হলো
গত বছরে ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েট হওয়া সচ্ছল পরিবারের ডেভিডের গল্প। ১৮তম জন্মদিনে মায়ের কাছ থেকে উপহার পাওয়া এলার্ম ক্লকের (মেড ইন জাপান) আওয়াজে সকাল ৬টায় ডেভিড ঘুম থেকে উঠে, ইলেকট্রিক রেজারে (হংকং) শেভ করে, টুথপেষ্ষ্ট (থাইল্যান্ড) দিয়ে দাঁত মেজে, সাবান (ইন্দোনেশিয়া) দিয়ে গোসল করে, বাথ-টাওয়েলে গা মুছে (পাকিস্তান), টি-শার্ট (বাংলাদেশ) আর ট্রাউজার (ইন্ডিয়া) পরে অস্ট্রেলিয়ার লেবানিস ব্রেড, চীজ, বীফ, সবজি আর সস দিয়ে দুমিনিটে স্যান্ডউইচ-প্রেসে (ভিয়েতনাম) wrap বানানোর মাঝে কফিমেকারে (কোরিয়া) ব্রাজিলের কফি-বীন দিয়ে ব্লাক-কফি বানিয়ে ঝটপট সকালের নাস্তা খেতে খেতে রেডিও (চায়না) অন করে সানরাইজ প্রোগ্রামের সর্বশেষ সংবাদ শুনে নেয়। নাস্তা শেষে প্লেট (আমেরিকা), গ্লাস-কাপ (থাইল্যান্ড), চামচ (চায়না) ধুয়ে, কম্পিউটার (চায়না) অন করে, কিবোর্ড (মালয়েশিয়া) আর মাউস (তাইওয়ান) চেপে ইন্টারনেটে প্রতিদিনের মতো আজও অস্ট্রেলিয়ান জব খুঁজতে শুরু করে ডেভিড। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে নিজের রেসুমির সাথে সিলেকশন ক্রাইটেরিয়ার প্রায় সব মিলে যায় এমন এক জবের এডভারটাইজমেন্ট দেখে পজিসন-ডেসক্রিপশন সম্পর্কে আরো জানার জন্যে বিজ্ঞাপনে দেয়া ওয়ান এইট হানড্রেড টেলিফোন নাম্বারে ফোন করে ডেভিড। ওভারসিস কলসেন্টারের অপর-প্রান্ত থেকে ফিলিপিনো অ্যাকসেন্টের উত্তরে জেনে নেয় কাঙ্ক্ষিত পদের বিষদ বর্ণনা, এভাবে সকালের কয়েক ঘণ্টা জব খুঁজে বেশ ক্লান্ত হয়ে যায় ডেভিড। মনে পড়ে আজ কয়েকটি বিল পরিশোধের লাস্ট-ডেট। ইন্টারনেট ট্রান্সফার করার জন্য ব্যাংকের ওয়েব-পোর্টালে গিয়ে দেখে সিস্টেম ডাউন তাই আর কি করা...বিলের হার্ড-কপি নিয়ে ডেভিড পোস্টঅফিসে যাওয়ার আগে ক্যালকুলেটরে (তাইওয়ান) হিসাব করে নেয় আজ বিল দেয়া আর শপিংয়ের জন্য মোট কত ডলার লাগবে
ঘরের কাপড় চেঞ্জ করে, বিজনেস শার্ট (শ্রীলংকা), জিন্স (সিঙ্গাপুর), হাতঘড়ি(সুইস), জ্যাকেট (মেক্সিকো) আর জুতা (ইতালি) পরে, গ্যারেজ থেকে গাড়ি (জার্মানি) বের করে, গ্যাস-স্টেশনে গিয়ে গাড়িতে তেল (সৌদিআরব) নিয়ে, পোস্টঅফিস আর শপিং-সেন্টারের কাজ সেরে পড়ন্ত বিকেলে বাসায় ফেরে। জব-হান্টিংয়ের ডিসএপয়েন্টমেন্ট অনুভূতি আর সারাদিনের ক্লান্ত দেহে টেলিভিশন (ইন্দোনেশিয়া) ছেড়ে একটু বিশ্রাম করতে করতে ডেভিড ভাবছে
.যেদেশে প্রধানমন্ত্রী born-ইন ওভারসিস, ইউনিভার্সিটিতে প্রতি তিনজনে একজন বিদেশী স্টুডেন্ট, আর চারিদিকে মেড ইন ইউনিভার্সের এতো পণ্যের ছড়াছড়ি - সেদেশে অস্ট্রেলিয়ানরা জব পাবে কিভাবে?
সত্যিই কি তাই? হয়তো কিছুটা সত্যি,..হয়তোবা একেবারেই নয়!!! তবে এটা সত্যি যে - সেপ্টেম্বর ২০১৪তে অস্ট্রেলিয়ার গত ১২বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৬.৪শতাংশ আনএমপ্লয়মেন্ট রেট পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনামে এসেছে। আর সত্যিই বা হবে না কেন? নিত্যদিন আমরা এদেশে যা কিনি কিংবা চারিদিকে যা দেখি তাতো সবই বিদেশের তৈরি। এবোরিজিনালদের বাঁশ-কাঠের কিছু স্যুভেনির ও তাঁদের আর্ট-ওয়ার্ক, লোকাল মার্কেটের কিংবা শপিং-সেন্টারের শাক-সবজি, ফল-মূল, মাছ-মাংস, চীজ-দুধ সহ প্রায় সবধরনের খাদ্যদ্রব্য, আর কেমিস্ট-শপের ফিস-অয়েল সহ বেশির ভাগ ওষুধপত্র ছাড়া অস্ট্রেলিয়ান মেড জিনিসপত্র কোথায়? তবুও পরম শান্তি
বিষাক্ত ফরমালিনযুক্ত খাওয়া খেতে হয় না এদেশে!
ভেবেছিলাম আজ ছোট করে লিখবো, কিন্তু তা আর হলো না। ১৯৯৫ সালে আমার সহধর্মিণী এবং আমি হিরোশিমা পীস মেমোরিয়াল মিউজিয়াম দেখে জাপানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ওসাকাতে বাসায় ফেরার পথে হাতের বাড়তি সময় কাজে লাগনোর জন্য জাপানে আমাদের প্রিয় ডিপার্টমেন্ট স্টোর Daimaru-তে ঢুকে পড়ি
অল্পসময়ে আমার সহধর্মিণী খুঁজে পায় তার জন্য পছন্দনীয় এক সুন্দর সোয়েটার
ঝটপট কিনে উঠে পড়ি বুলেট-স্পিড ট্রেন সিনকানসেনে। হিরোশিমা থেকে ওসাকার ৩০০কিলোমিটারের দূরত্বকে এই ট্রেন ১০০মিনিটে আরামপ্রদ-ভাবে নিরাপদে পৌঁছে দিচ্ছে। ট্রেনে উঠে প্যাকেট খুলে আমার সহধর্মিণী তার সদ্য কেনা সোয়েটার দেথতে থাকে আর ভীষণ আশ্চর্য হয়ে আমাকে দেখায় সোয়েটারের ট্যাগে লেখা মেড ইন বাংলাদেশ...দুজনের মনটা ভরে যায় আনন্দে। টোকিও থেকে ১৯৯৯সালে সিডনিতে প্রথম বেড়াতে এসে ডেভিডজোন্সে গোল্ডেন বর্ডার দেয়া আকর্ষণীয় ডিজাইনের নিখুঁত কাজের ডিনার সেটের পেছনে মুন্নু সিরামিক-মেড ইন বাংলাদেশ লেখা দেখে খুশীতে আত্মহারা হয়েছিলাম। ২০০১সালে নিউইয়র্কে টুইন-টাওয়ার ধ্বংসের আগে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে এক হস্তশিল্প সামগ্রীর বিশাল দোকানে বিদেশী ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের নকশীকাঁথার বিপুল চাহিদা দেখে অভিভূত হয়েছি
সেসময়ে লস এঞ্জেলসের ওয়ালমার্ট থেকে কেনা বাংলাদেশের তৈরি Van Heusen ব্র্যান্ডের শার্টের কোয়ালিটিতে মুগ্ধ হয়েছি। ২০০৫সালে সিউল এয়ারপোর্টের ডিউটি-ফ্রি শপে বাংলাদেশের তৈরি উন্নতমানের দামী লেদার জুতা, ২০০৯সালে সিঙ্গাপুরে মোস্তফা ডিপার্টমেন্ট স্টোরে কাজী পেয়ারাProduct of Bangladesh, ২০১৩সালে বেইজিংয়ের ওয়াংফুজিয়ান ডিপার্টমেন্ট স্টোরে বাংলাদেশের তৈরি লেদার জ্যাকেট বিক্রি হতে দেখে আনন্দে আপ্লুত হয়েছি। বিদেশে যখন যেখানে বাংলাদেশের পণ্য দেখেছি কিংবা কিনেছি, মনের অজান্তেই বলে উঠেছি - "বাংলাদেশের পণ্য কিনে হও ধন্য"।
এক দেশের এক্সপোর্ট অন্য দেশের ইম্পোর্ট
এটাইতো বিশ্ব বাণিজ্য। মাইগ্রেশনের সুফলও এনেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে, রপ্তানি-মুখী শিল্পে, দেশে-বিদেশে নতুন-নতুন কর্মসংস্থানের। আর সেজন্যই তো ১৫বছর আগে আমার দেখা সিডনির লাকেম্বাতে যেখানে একটিমাত্র বাংলাদেশী গ্রোসারী দোকান ছিলো সেখানে আজ অন্তত: ১৫টি বাংলাদেশী দোকান-রেস্টুরেন্ট অনেক মাল্টি-ন্যাশনাল দোকানের সাথে প্রতিযোগিতায় হরেক রকম বাংলাদেশী পণ্য সাজিয়ে মানুষের চাহিদা মেটাচ্ছে।
ডেভিডের গল্প নিতান্তই কাল্পনিক, বাস্তবের সঙ্গে নামের, চরিত্রের কিংবা পণ্যের মিল নিছক কাকতালীয়,
এর সাথে হয়তো বাস্তবের মিলের চেয়ে অমিলই বেশী
তবুও মেড ইন ইউনিভার্সের আন্তর্জাতিক পণ্য আস্থা, নির্ভরতা আর সুনামের সাথে ছড়িয়ে রয়েছে দেশে দেশে
মহাদেশে
mmparvez@yahoo.com সিডনী - ২৯/১০/২০১৪
|