লাইফ ইন লকডাউন মাসুদ পারভেজ
সিডনির আইকনিক স্পট - হারবার ব্রিজ ও অপেরা হাউসের পাশে আমার সরকারি অফিস। প্রতিদিন ট্রেনে চড়ে সার্কুলার-কি স্টেশন ব্যবহার করি কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের জন্যে। সকালে ট্রেন থেকে প্লাটফর্মে নামলেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায় হারবারে প্রতিদিন নতুন-নতুন, বিশাল বড়-বড় প্রমোদ-তরী দেখে। প্লাটফর্ম থেকেই নিত্য নতুন জাহাজের ছবি তুলে পাঠাই পরিবারের সবাইকে আর কয়েকজন বন্ধুদের। এক বন্ধু কয়েক দিন আগে বলে- প্রমোদ-তরীর ছবি পাঠানোর চেয়ে প্রমোদ তরীতে সমুদ্র ভ্রমণের টিকেট পাঠালে ভালো হয়। এই হারবারে দেখেছি কুইন এলিজাবেথ, কুইন মেরি ২, রুবি প্রিন্সেস, সান প্রিন্সেস, সি প্রিন্সেস, ম্যাজেস্টিক প্রিন্সেস, ওভেশন অফ সিজ, এক্সপ্লোরার অফ সিজ, ভয়েজার অফ সিজ, কার্নিভাল স্পিরিট, নূরডাম, ইত্যাদি।
 একেকটি জাহাজের একেক রূপ, মন ভোলানো রং, আকাশ ছোঁয়া উচ্চতা, স্থির ভাবে পানিতে ভেসে থাকার ক্ষমতা দেখে প্রতিনিয়ত অভিভূত হই। অফিসের কাজ শেষে বাসায় ফিরে রাতে খাবার টেবিলে বাসার সবার সাথে প্রতিদিনের দেখা জাহাজের বর্ণনা দেই আর বলি আহা- একদিন যদি কুইন এলিজাবেথ কিংবা কুইন মেরি-২ তে সমুদ্র ভ্রমণে যেতে পারতাম! ছেলে-মেয়ে আমার কথায় আগ্রহ দেখালেও আমার সহধর্মিণী বলে- ডাঙ্গায় এখনো আমার অনেক কিছু দেখার আছে, পানিতে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। তাছাড়া ওটা তো রিটায়ার্ড মানুষের কাজ। আর তুমি তো সাঁতার কাটতে পারো না। বাসার সুইমিং পুলে হাঁটা-হাঁটি করো, প্রমোদ-তরীতে তোমার সমুদ্র ভ্রমণে গিয়ে কাজ নেই। সাঁতারে পারদর্শী স্কুল চ্যাম্পিয়ন আমাদের ছেলে-মেয়ে মুখ চেপে হাসা-হাসি করে বলে- সমুদ্রে পড়ে গেলে অথৈ পানিতে সাঁতার জানলেও কি কোনো লাভ হবে? কোভিড-১৯ এর অদৃশ্য শক্তিশালী আগ্রাসনে কয়েকদিন আগে টেলিভিশনের খবরে দেখলাম সারা পৃথিবীর বিভিন্ন সমুদ্রে ৪০টি প্রমোদ-তরীতে ৩,০০০ অস্ট্রেলিয়ান যাত্রী আরো অনেক দেশের যাত্রীদের সাথে অনিশ্চয়তার মাঝে বন্দী। প্রমোদ-তরীগুলো এখন ফ্লোটিং প্রিজন।
সার্কুলার-কি সিডনির সিটি-রেলের এক ব্যস্ত স্টেশন। লাঞ্চ শেষে কিছু সময়ের জন্যে রক্স এলাকার হারবার ব্রিজ ও অপেরা হাউসের আশেপাশে হাঁটার অভ্যাস আমার প্রতিদিনের। এই এলাকায় প্রতিদিন আসা-যাওয়ার মাঝে দেখা হয় ব্যস্ত অফিস যাত্রী আর সব বয়সের বিভিন্ন দেশের আনন্দ মুখর টুরিস্টদের সাথে। সরকারি নির্দেশনায় বাসা থেকে কাজ করার সুবাদে গত সপ্তাহে মাত্র একদিন অফিসে গিয়েছি জরুরি মিটিংয়ে যোগ দিতে। কখনো ভাবতে পারিনি হ্যারি পর্টার সিনেমায় দেখা শহরের মতো এই এলাকা একদিন হয়ে যাবে একটি মৃত শহর!


অফিসে থেকে ফিরে আসার সময় মনে হলো ট্রেনের বদলে লাইট রেলে/ট্রামে চড়ে আজ বাসায় ফেরার পথে সারা সিডনির সিবিডি/অফিস পাড়া দেখলে কেমন হয়? সার্কুলার-কি থেকে জর্জ স্ট্রিটের ওপর দিয়ে ট্রামের ড্রাইভার এবং একমাত্র যাত্রী আমি বহু বছরের চেনা শহরকে কেমন যেন অচেনা মনে হলো। অচেনা কাল্পনিক শহরের মাঝ দিয়ে ধীরে ধীরে সেন্ট্রাল স্টেশন পৌঁছানোর সময়ে মনে হলো - আমরা কি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি নতুন প্রজন্মের ভাইরাসের অদৃশ্য শক্তিতে? ভাবছিলাম - জাতি, ধর্ম, শক্তি, সংস্কৃতি, প্রতিপত্তি নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতি আজ একই কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে, ওয়েবসাইটে -
worldometers.info/coronavirus
দেখতে পাই কোভিড-১৯এর ভীতিকর আতঙ্কের লাইভ পরিসংখ্যান। আরো ভাবছিলাম - মাত্র তিন মাস আগে অস্ট্রেলিয়ার বুশ-ফায়ারের সময় আমরা সবাই একে অপরকে সাহায্য করেছি, আর এখন এক প্যাকেট টয়লেট পেপারের জন্যে মারামারি করছি। যেখানে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা নেই, সেখানে দোকানের শেল্ফ খালি হয়ে যাচ্ছে চোখের নিমেষেই। কেউ কি একবারও নিজের মনের অজান্তে ভেবেছি- মানুষ মানুষের জন্যে / জীবন জীবনের জন্যে / একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না? মানুষ যদি সে না হয় মানুষ / দানব কখনো হয় না মানুষ / যদি দানব কখনো বা হয় মানুষ / লজ্জা কি তুমি পাবে না? একশ বছর (১৯১৮) আগে মানুষ জয় করেছে স্প্যানিশ Flu- কে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে এবং নতুন প্রজন্মের এই অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে জয়ের লক্ষ্যে লড়াইয়ে এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি আর সরকারের নির্দেশনা মেনে চলা। আমরা সবাই যদি নিজের অবস্থান থেকে নিজের দায়িত্ব পালন করে সরকারকে সহযোগিতা করি তাহলেই পরম করুণাময়ের ইচ্ছায় আমাদের জয় হবে। দ্রুত উদ্বেগের, উৎকণ্ঠার, আতঙ্কের অবসানে প্রশান্তি আসুক সবার জন্যে। আসুক আলোকিত, নিরাপদ, স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ সবার জন্যে - এই কামনায়।
মাসুদ পারভেজ, সিডনি / mmparvez@yahoo.com
|