গল্পলাইফ সাইকেল মাসুদ পারভেজ
শিক্ষিত-সুদর্শন শরীফ আদনান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরীজীবী। ঢাকায় এপার্টমেন্টে ভাড়া থাকেন পরিবার নিয়ে। বেশ সকালে ঘুম থেকে উঠে দৈনিক পত্রিকা “সূর্যোদয়” পড়ার অভ্যাস অনেকদিনের। পত্রিকা পড়া শেষে অফিসে যাওয়ার আগে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার করেন প্রতিদিন। আজকের ব্রেকিং নিউজে - “করোনা মোকাবিলায় জানুয়ারির মধ্যে ভ্যাকসিন আসতে পারে - নিবন্ধন মোবাইল অ্যাপে”। টিকা-গ্রহীতাদের নিবন্ধন করতে হবে ১০০কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি অ্যাপের মাধ্যমে।
ব্রেকিং নিউজের প্রথম লাইন পড়ার পরে শরীফ সাহেব চিন্তা করছেন - কতগুলি ১০০০টাকার নোটে ১০০কোটি টাকা হয়? আগ্রহ হারিয়ে অনেকটা অন্যমনস্ক হয়ে পাতা উল্টিয়ে দেশের “আঞ্চলিক” খবরের পাতায় পেলেন – গজারিয়া উপজেলার শান্তিপুর গ্রামে “করোনা ভাইরাসের আকার ও সাইজ নিয়ে সংঘর্ষ”। খবরে এসেছে - স্থানীয় “করোনা প্রতিরোধ কমিটি” আর “মাস্ক পরিধান-বিরোধী কমিটি” এই দুই গ্রুপের মধ্যে তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, পিপিই ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, আইসোলেশন, ইত্যাদি প্রথম গ্রুপের প্রচারণা হলেও দ্বিতীয় গ্রুপের ভাষ্য - যেকোনো ভাইরাসের আকার ও সাইজ দেশীয় কুল বরই-র মতো যা কোনোভাবেই মানুষের নাকের ভেতর দিয়ে ঢুকতে পারে না। তাই “মাস্ক” নামের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় এমন অস্বস্তিকর মুখোশ পরার প্রয়োজন নেই। তাদের মতে - করোনা বিষয়ক পাগলামি কথাবার্তা যতসব আজগুবি আমদানি। দুই গ্রুপের মধ্যে প্রথমে তর্ক-বিতর্ক, তারপরে ঠেলাঠেলি, হাতাহাতি, যা শেষ হয়েছে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই উভয় পক্ষের মূল্যবান পাঁচটি তরতাজা প্রাণ ঝরে গিয়ে এবং প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তির আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে সংঘর্ষের অবসান হয়েছে।
শরীফ সাহেব পাতা উল্টিয়ে “শিক্ষা বিভাগ” পাতায় দেখেন - দেশের চলমান স্কুলের ছুটিতে “অনলাইন ক্লাসে একদিন” শিরোনামে এসেছে –
শিক্ষক: বদের হাড্ডি কোথাকার! তোকে বলেছি ব্যাকটেরিয়া আঁকতে, কিন্তু তুই সাদা খাতা জমা দিলি কেন?
ছাত্র: স্যার, আপনিই তো বলেছিলেন, ব্যাকটেরিয়া খালি চোখে দেখা যায় না। তাই ভাবলাম, দেখাই যদি না যাবে, তাহলে আর কষ্ট করে আঁকার দরকার কি?
এই কথা শুনে, অনলাইন ক্লাসে ল্যাপটপের স্ক্রিনে ছাত্রকে থাপ্পড় মারতে গিয়ে শিক্ষক ভুলক্রমে তার নিজের ল্যাপটপ ভেঙ্গে ফেলেছেন। নতুন বছরে পত্রিকার সংবাদ পড়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল শরীফ সাহেবের। ঠিক এমন সময় এবছরে ক্লাস টুতে ওঠা ছোট ছেলে শোভন দৌড়ে এসে বলে –
বাবা বলতো দেখি - মুরগি আমাদের ডিম দেয়, মৌমাছি মধু দেয় - তাহলে টিচাররা আমাদের কি দেয়? - তোমাদের নতুন নতুন জিনিস শেখায়। - না বাবা তুমি ঠিক বলনি, টিচাররা আমাদের হোম-ওয়ার্ক দেয়! - শরীফ সাহেব কিছু বলার আগেই ক্লাস ফাইভে ওঠা বড় ছেলে শাওন এসে বলে – বাবা, আমি আমার ফ্রেন্ডকে বলেছি আমি বড় হয়ে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বের করবো। আমার কথা শুনে বন্ধু বলেছে - যে ভাইরাস তোকে রাত জেগে, কষ্ট করে পড়াশুনা না করার সুযোগ দিয়েছে, এমন কি কঠিন বার্ষিক পরীক্ষা দিতে দেয়নি, বরং নতুন বছরে নতুন ক্লাসে অটো-প্রমোশন দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে কাজ করবি তা ঠিক হবে না, এটা বিশ্বাস-ঘাতকতার শামিল, এতোটা সেলফিশ হওয়া যাবে না!
হতবাক, বাকরুদ্ধ হলেও নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে শরীফ সাহেব বাচ্চাদের বলেন - তোমরা মনোযোগ দিয়ে নিয়মিত পড়াশুনা করো তাহলে জীবনে উন্নতি করতে পারবে। এই বলে বাজারের দিকে পা বাড়ালেন।
নতুন বছরে পকেটের অবস্থা বিগত বছরের মতোই, বাজারে গিয়েও সেই একই চিত্র। মাছের, সবজির, মুরগির দাম- কোনো কিছুতেই নতুনত্ব নেই। কোনো রকমে দর দাম করে কিছু সবজি আর একটা মাঝারি সাইজের মৃগেল মাছ কিনে সকালের জন্য ডিম কিনতে দোকানিকে শরীফ সাহেব জিজ্ঞেস করেন –
মুরগির ডিমের হালি কত? পঞ্চাশ টাকা। এতো ছোট ডিম, দেখতে তো কোয়েলের ডিম মনে হচ্ছে, তার এতো দাম কেন? আপনি তো লম্বা মানুষ, অতো উঁচু থেকে দেখলে তো ডিম দেখতে ছোটই লাগবে, বসে দেখেন - ডিমের সাইজ ঠিকই আছে!
বাসায় ফিরে বাজারের ব্যাগটা সহধর্মিণী শাহানাকে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত অফিসের দিকে ছুটলেন শরীফ সাহেব।
অফিসে এসেও নতুনত্বের সন্ধান পেলেন না - সেই পুরাতন ফাইল, সহকর্মীদের জেলাসি, বাঁকা চোখের চাহুনি, বসের দুর্ব্যবহার। অফিসে থেকে বেরিয়ে আবারো সেই ভয়াবহ পুরাতন চিত্র - ফুটপাথ হকারদের দখলে, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, রিক্সা, টেম্পো, গাড়ি নিয়ম না মেনে চলায় যথারীতি, বাসের এলোপাথাড়ি বেপরোয়া চলাচলে সর্বত্রই যানজট। পৃথিবীব্যাপী বহুল আলোচিত একটি শব্দ - করোনা। চা-স্টল, টেলিভিশনের টক-শো, সরকারি মিটিং, কোথায় নেই করোনার আলোচনা? কিন্তু রাস্তায় বের হলে মনে হয় - ঢাকার জনগণের সবারই করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে “হার্ড ইমিউনিটি” হয়ে গিয়েছে!
নতুন বছরে আজ সারাদিনে শরীফ সাহেব নতুন কিছুই দেখতে কিংবা শুনতে পেলেন না। এরকম একঘেয়েমি “লাইফ সাইকেল” আর ভালো লাগে না। মনে হয় ইমিগ্রান্ট হয়ে কোনো দেশে যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু করোনার প্রকোপে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা সহ সারা পৃথিবীর উন্নত সব দেশই আজ বিপর্যস্ত। তবে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো। শরীফ সাহেব ঠিক করেন অস্ট্রেলিয়াতে স্কিলড মাইগ্রেশনের জন্যে এপ্লাই করবেন। কিন্তু এপ্লিকেশন করার জন্যে অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন - যেমন অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে পড়াশুনা করা, সঠিক কাগজপত্র জোগাড় করা, ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে আইইএলটিএস পরীক্ষা দেয়া, এপ্লিকেশন ফর্ম যথাযথভাবে পূরণ করা, ইত্যাদি। তার ওপর বেশ মোটা অংকের এপ্লিকেশন ফি জমা দেয়া। সব মিলিয়ে অনেক সময় আর টাকার ইনভেস্টমেন্ট। হঠাৎ শরীফ সাহেবের মনে হলো এতো ইনভেস্টমেন্টের আগে একজন বিশিষ্ট অকাল্ট সাধক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জ্যোতিষী, হস্তরেখা-বিদ ও বাস্তু বিশেষজ্ঞ-এর সাথে দেখা করে আগত দিনগুলি কেমন যাবে এবং কিভাবে আগাম প্রস্তুতি নেয়া যায় তা জানতে পারলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। ঠেলাঠেলি করে লোকাল বাস থেকে কোনো রকমে শরীফ সাহেব ফার্মগেট বাস স্টপেজে দ্রুত নেমে পড়েন। বাস থেকে নামার সময়ে ভিড়ের মাঝে একটু অতিরিক্ত চাপ অনুভব করলেও শরীফ সাহেব বেশ অনেকটা ফুরফুরে আমেজে ভাবছেন - সময়োপযোগী ইনোভেটিভ আইডিয়াতে বাস থেকে অন্ততঃ ঠিক জায়গায় নামতে পেরেছেন, আর মাত্র দুই মিনিটের হাঁটার পথে বিশিষ্ট অকাল্ট সাধকের চেম্বার।
এপয়ন্টমেন্ট না করে আসার জন্যে ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করে সবার শেষে সাধকের দেখা পেলেন শরীফ সাহেব। ভক্তির সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষে, সাধক বলেন - বছরের শুরুতে ক্রিয়েটিভ আইডিয়া মনের ভেতর উঁকিঝুঁকি দেবে, কখনো কখনো আনমনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই সুযোগে বছরের শুরুতে পকেটমারের শিকার হতে পারেন। বছর জুড়ে অফিসে একটা প্রমোশন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তবে না হওয়া পর্যন্ত নেটওয়ার্কিং এবং লবিং অব্যাহত রাখুন, মনোবল ধরে রাখুন। “স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল”, তাই ডায়েট কন্ট্রোল ও পর্যাপ্ত ঘুমের দিকে মনোযোগ দিন। বিশেষ করে টিকা প্রদানের ওপর বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ডাক্তার দিয়ে করোনা ভ্যাকসিন নেবেন, আর তা না হলে প্রাণহানির আশংকা রয়েছে। পাওনাদারের মুখোমুখি না হওয়ার জন্যে বছর জুড়ে মাস্ক পরতে ভুলবেন না। বছরের মাঝামাঝিতে ইনকাম ট্যাক্স ফাঁকি দিতে গিয়ে বিপদে পড়তে পারেন এবং মোটা অংকের অর্থ-দণ্ডের আশংকা আছে। ফেসবুকের আইডি হ্যাকারদের কবলে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে আর তাই বিড়ম্বনা এড়াতে অবাক না হয়ে ঘন ঘন পাসওয়ার্ড বদল করুন। বছরের শেষ দিকে দেশান্তরী হওয়া কিংবা দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ আসতে পারে। যাত্রা মোটামুটি শুভ। তবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হওয়া, বিভিন্ন গন্তব্যে ফ্লাইটের চলাচল, ভিসা সংক্রান্ত কাগজপত্র ও বর্ডার সিকিউরিটি জটিলতার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখুন। বছর জুড়ে বিনোদন ও রোমান্স শুভ।
বিশিষ্ট অকাল্ট সাধকের পরামর্শ শরীফ সাহেবের বেশ পছন্দ হয়েছে। নিজেকে নিজেই বাহবা দিয়ে রিসিপশন ডেস্কে গিয়ে সাধকের পরামর্শ ফি ৫০০টাকা দেয়ার জন্যে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখেন মানি ব্যাগ উধাও। তন্ন-তন্ন করেও খুঁজেও পাওয়া গেল না মানি ব্যাগ - সম্পূর্ণ লাপাত্তা। শরীফ সাহেবের মনে পড়ে - ঠেলাঠেলি করে বাস থেকে নামার সময় অতিরিক্ত চাপের অনুভূতি আর অকাল্ট সাধকের বাণী “বছরের শুরুতে পকেটমারের শিকার হতে পারেন”!
মিষ্টি কণ্ঠের শব্দে আচমকা শরীফ সাহেব চোখ খুলে দেখেন - শায়লা দাঁড়িয়ে বলছে – “জানালা থেকে দেখো আজকের সূর্যোদয়টা কি সুন্দর, চলো আমরা আমাদের ব্যালকনিতে বসে ব্রাইটন বিচ আর বোটানি বে এর সকালটা উপভোগ করি”।
শরীফ সাহেব ভাবছেন - তাহলে এতক্ষণ যা বলেছি, দেখেছি কিংবা শুনেছি তা কি শুধুই স্বপ্ন ছিল, সত্যিই কি তাই!
২০/০১/২০২১
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা - আজকের গল্প নিতান্তই কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে নামের, চরিত্রের কিংবা ঘটনার মিল নিছক কাকতালীয়।
মাসুদ পারভেজ, সিডনি / mmparvez@yahoo.com
|