ফিরে দেখা মাসুদ পারভেজ
পাঁচ বছর আগে (১১ মার্চ ২০২০) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আন্তর্জাতিক উদ্বেগের জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবেলায় কোভিড-১৯কে মহামারি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল।
মহামারি করোনা ভাইরাসের শুরুতে, পৃথিবীর বহু দেশে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, উপসনালয়, যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদির পাশাপাশি বন্ধ হয়েছে ২০২০সালের অলিম্পিক গেমস, আরো কতো কিছু। বড়-বড় দালান কোঠা, রাজপ্রাসাদ, আইকনিক স্পট জীর্ণশীর্ণ হয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে - বিশ্ব এখন স্তব্ধ। টেলিভিশনে দেখতে পেয়েছি ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত সবার আপাদমস্তক পিপিই-র আবরণে ঢাকা। অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শুধু শ্রবণ-বিদারী নয় হৃদয়-বিদারীও বটে। সৃষ্টির প্রাকৃতিক নিয়মে প্রতিদিনের মতোই সবুজ বৃক্ষরাজি দিনের আলোতে বিশুদ্ধ অক্সিজেন তৈরি করে নিরলস ভাবে তা ছড়িয়ে দিয়েছে বাতাসে কিন্তু এই অক্সিজেনের নিয়মিত গ্রাহক মানুষ বিপদগ্রস্ত। সবাই মাস্ক পরে মুখমণ্ডল ঢেকে রেখেছে। মনে হয়েছে জোরে নিঃশ্বাস নিলেই অদৃশ্য কোভিড-১৯ বুকের ভেতরে ঢুকে যাবে! ভাবতে অবাক লাগে - পৃথিবীর প্রায় ৬বিলিয়ন মানুষ ঘরে বন্দি, উপাসনালয়গুলো খালি পড়ে রয়েছে, ডাক্তার রোগী দেখছে টেলি-হেলথের/টেলি-মেডিসিনের মাধ্যমে, অসুস্থ প্রিয়জনের শয্যা পাশে বা অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় নেই প্রিয়জন। মানুষ ঘরে বন্দি হয়ে নিয়মিত বিশ সেকেন্ডের হাত ধোয়ার প্রশিক্ষণ নিয়েছে। যে ভাইরাসকে দেখতে শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ লাগে সেই ভাইরাস পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীকে গৃহবন্দী করে রেখেছে।
ছোট বেলায় শেখা ধারাপাতের নামতায় আর বড় হয়ে শেখা স্ট্যাটিসটিক্সের ভাষায় পারমুটেশন-কম্বিনেশনে মেলাতে পারিনি কোভিড-১৯এ মানুষ মারা যাওয়ার পরিসংখ্যান। মনে হয়েছে - পৃথিবীকে আইসিইউ-তে পাঠিয়ে দিয়ে, প্রকৃতি তার আগের অবস্থা ফিরে পাওয়ার জন্যে সেলফ আইসোলেশনে একটু জিরিয়ে নিয়ে, ধীরে-ধীরে, নিজের সেবা-শুশ্রূষা নিজেই করে নিয়েছে। আর আমাদেরকে নতুনভাবে ভাবতে সময় দিয়েছে ভবিষ্যতে, কিভাবে প্রকৃতিকে লালন করতে হবে, কিভাবে পারমাণবিক যুদ্ধ না করে ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে হবে, কিভাবে পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে হবে।
গত ৫বছর ধরে সরকারি নির্দেশনায় বাসা থেকে কাজ করার সুবাদে অফিসের কাজের পাশাপাশি নিয়মিতভাবে করোনাকালের বিভিন্ন আর্টিকেল পড়ে কিছু জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করছি। অন্যদের আর্টিকেল পড়ার পাশাপাশি, বাংলা-সিডনি ডট কমে প্রকাশিত আমার নিজের আর্টিকেল লাইফ ইন লকডাউন মাঝে-মাঝে পড়ে, অনেকটা আনমনা হয়ে ভেবেছি সিডনির আইকনিক স্পট - হারবার ব্রিজ ও অপেরা হাউসের পাশে আমার সরকারি অফিসে আবার কবে নিয়মিতভাবে যেতে পারবো? আবার কবে আমার বহু বছরের চেনা শহরে ফিরে আসবে মুখরিত কোলাহল। ছোট বেলায় শুনেছি - যায় দিন ভালো - আশাকরি তা পুরোপুরি সঠিক নয়।
মহামারি আমাদেরকে ধৈর্য, সামাজিক, স্বাস্থ্যগত এবং মানবিক সংহতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার শক্তি দিয়েছে। কোভিড ভ্যাকসিন দ্রুত উদ্ভাবনে বৈজ্ঞানিক সাফল্য, প্রযুক্তির ডিজিটাল রূপান্তরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, অফিস আদালতে রিমোট কাজের সুযোগ, দৈনন্দিন কাজে প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে প্রযুক্তির বর্ধিত ব্যবহার, ইত্যাদিতে সুফল এসেছে। ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম কনসেপ্ট একসময়ে অকল্পনীয় বিষয় ছিল। করোনা কালে এবং পরবর্তী সময়ে তা হয়েছে নিউ নরমাল। বাসা থেকে অফিসের কাজ করার ফলে - কাজ এবং পারিবারিক দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ফ্লেক্সিবিলিটি বৃদ্ধি, কাজের জন্যে বাসা থেকে অফিসে যাতায়াতের সময় সাশ্রয়, জব স্যাটিসফ্যাকশান, কাজের সামগ্রিক প্রোডাক্টিভিটি বৃদ্ধি, ইত্যাদির রেভলিউশনারী পরিবর্তন হয়েছে - যা এক কথায় - বিউটি অফ কোভিড। ইতিহাস থেকে দেখা - অনিশ্চয়তার দৃশ্য চিরস্থায়ী নয়, এই দৃশ্য পরিবর্তিত হয়। আর তাই করোনা ক্রাইসিসের সময়ে স্টে হোম-সেভ লাইফ, দূরে থেকে পাশে থাকুন, আইসোলেটেড নট অ্যালোন - এই কঠিন সময়ে আশা-নিরাশার মাঝে আমরা সবাই আশাবাদী হয়েছি। পুরাতন শব্দ নতুন করে শেখা প্যানিক-বায়িং, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং, ফিজিক্যাল ডিস্ট্যানসিং, লকডাউন-এর অবসানে আমরা সবাই আশা করেছি - আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে। আমাদের দেখা হোক জীবাণু ঘুমালে, আমাদের দেখা হোক সবুজ সকালে। আমাদের দেখা হোক কান্নার ওপারে, আমাদের দেখা হোক সুখের শহরে। আমাদের দেখা হোক হাতের তালুতে, আমাদের দেখা হোক ভোরের আলোতে। আমাদের দেখা হোক বিজ্ঞান জিতলে, আমাদের দেখা হোক মৃত্যু হেরে গেলে। আমাদের দেখা হোক আগের মত করে। আমাদের দেখা হোক সুস্থ শহরে...!!!
বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী - সায়েন্সর এপ্রিল ২০২০সালের সংখ্যায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা নিবন্ধে পড়েছি - মানুষের মধ্যে যদি স্থায়ীভাবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে, তাহলেও এটি বিলুপ্ত হতে সময় লাগবে পাঁচ বছর বা তার কিছু বেশি দিন। একশ বছর (১৯১৮) আগে মানুষ জয় করেছে স্প্যানিশ ফ্লু-কে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে এবং নতুন প্রজন্মের এই অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে জয়ের লক্ষ্যে আমরা সবাই নিজের অবস্থান থেকে নিজ-নিজ দায়িত্ব পালন করে সরকারকে সহযোগিতা করেছি। আর তাই পরম করুণাময়ের ইচ্ছায় বিশ্বব্যাপী কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ৬.৮মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মারা গেলেও উদ্বেগের, উৎকণ্ঠার, আতঙ্কের অবসানে আমাদের জয় হয়েছে। আজকের দিনে আমার অফিসের এক সহকর্মীর কথা মনে পড়ে Don't worry, the Corona Virus won't last long...It is made in China! সহকর্মীর এই উক্তির বিপরীতে আরেক বন্ধুর মন্তব্য শুনেছি ভাগ্যিস এটা জাপান থেকে আসেনি!
সবাই সুস্থ ও নিরাপদে থাকি - এই কামনায়।
১১/০৩/২০২৫
মাসুদ পারভেজ, সিডনি / mmparvez@yahoo.com
|