সিডনির বৈশাখী মেলা ২০১৫ মাসুদ পারভেজ বাংলার ঋতু চক্রের পরিক্রমায় উষ্ণতা বৃদ্ধির আবির্ভাবে আসে - এসো হে বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস বৈশাখকে বরণ করে বাংলাদেশসহ প্রবাসে পালিত হয় বৈশাখী মেলা। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্টেটের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি বাংলাদেশী/বাংলাভাষী নাগরিকদের বাস সিডনিতে। সিডনির টেম্পি পার্ক আর অলিম্পিক অ্যাথলেটিক সেন্টার - এই দুই ভেন্যুতে বেশ অনেক বছর ধরে সফলভাবে আয়োজিত হয় বৈশাখী মেলা। মধ্য এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এখানকার বৈশাখী মেলা সিডনিবাসী ছাড়াও ইন্টারস্টেটের বাংলাদেশী/বাংলাভাষীদের জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করার দিন।
গত ১১ই এপ্রিল বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে সিডনির টেম্পি পার্কে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে টেম্পি পার্ক কানায় কানায় পূর্ণ হলো আগত মেলা প্রেমিক দর্শনার্থীদের সমাগমে। দেশী খাবারের/কাপড়ের/বইয়ের স্টলে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নাচ-গানে, ইত্যাদিতে আনন্দ মুখরিত ছিলো মেলা প্রাঙ্গণের প্রতিটি কর্নার। পার্কের উন্মুক্ত চত্বরে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘোরাফেরা, ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসে অনুষ্ঠান দেখা কিংবা নরম সবুজ ঘাসের ওপর পাটি বিছিয়ে গল্প-গুজব/খাওয়া-দাওয়া, ইত্যাদির মাঝে অনেকের সাথে আনন্দে কেটেছে ব্যস্ত জীবনের মূল্যবান কয়েক ঘণ্টা। টেম্পি পার্কের বৈশাখী মেলায় ফ্রি-এন্ট্রি এবং ফ্রি-পার্কিং-এর সুবিধা মেলার দর্শনার্থীদের কাছে এক বাড়তি আনন্দের। মেলায় সন্ধ্যার পরে আসা অনেকেই পার্কিং সমস্যার কথা বলেছেন। তবুও মেলার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে এসে তৃপ্তির কথা প্রকাশ করেছেন পরিচিত সবাই।
সিডনির সর্ববৃহৎ বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হলো গত ১৮ই এপ্রিল। বেশ অনেক বছর ধরে সিডনি অলিম্পিক অ্যাথলেটিক সেন্টারে এই মেলা অত্যন্ত সফলতার সাথে অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রবাস জীবনে কয়েকটি দেশে আমাদের দেখা বৈশাখী মেলার আয়োজনের তুলনায় ইতিপূর্বে সিডনি অলিম্পিক অ্যাথলেটিক সেন্টারের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বর্ণিল বিশাল আয়োজন সব সময়ই অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য দৃষ্টি-নন্দিত মনে হয়েছে। মেলার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতি বছর দর্শনার্থীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মেলার আয়োজকদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছরের বর্ধিত দর্শনার্থীদের স্থান সংকুলানের জন্যে অ্যাথলেটিক সেন্টারের চেয়ে বৃহৎ পরিসরে টেনিস সেন্টারে এ’বছরের বৈশাখী মেলার আয়োজন। টেনিস সেন্টারের গ্যালারিতে বসে নিজ পরিবার/প্রিয়জন/বন্ধু-বান্ধব/আত্মীয়-স্বজনদের সাথে খাওয়া-দাওয়া আর আলাপচারিতার মধ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করতে ভালোই লেগেছে। প্রতি বছরের মতোই সন্ধ্যার পরে দর্শনার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় মেলা চত্বরে দেশীয় কাপড়ের-জুয়েলারির/খাবারের/বইয়ের, ইত্যাদির স্টলে উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। মেলা প্রেমিক দর্শনার্থীদের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে ঝির-ঝির বৃষ্টি আকস্মিক ভাবে মুষলধারে পরিণত হয়। বাংলা সংস্কৃতির প্রাণের টানে এই মেলায় সিডনির বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও ইন্টারস্টেট থেকে আগত অসংখ্য পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, অপরিচিত বাংলাদেশী/বাংলাভাষীদের সাথে কথা বলার মাঝে প্রায় সবাই নতুন ভেন্যুতে এবারের বৈশাখী মেলায় তাদের বিড়ম্বনার কথা বলেন। অপর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা, প্রবেশ ও পার্কিং টিকেটের বর্ধিত মূল্য, টিকেট বুথের অপ্রতুলতায় মূল্যবান সময়ের অপচয়, পর্যাপ্ত ভলান্টিয়ারের অভাব, ইত্যাদির আলোচনাই ছিল হতাশার সুরে অনেকের মুখে। বৃষ্টির কারণে মেলার অন্যতম আকর্ষণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গানের পর্ব বাতিল হওয়ায় সবার মাঝে মেলার সামগ্রিক আয়োজন এক ডিসএপয়েন্টমেন্টের অনুভূতিতে পরিণত হয়। অনেকেই নতুন ভেন্যুতে এবারের মেলাকে “কনক্রিট জাঙ্গলে” গ্রামীণ সংস্কৃতির ফ্লেভার খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন বলে মন্তব্য করেন।
বাংলা ১৪০০সাল থেকে যাত্রা শুরু হওয়া সিডনির বৈশাখী মেলার ব্যাপ্তি-আকার, মেলায় আগত লোকসংখ্যার পরিমাণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মান, স্টলের সংখ্যা, ইত্যাদির সব কিছুতেই ব্যাপক পজিটিভ পরিবর্তন এসেছে। আর তাই বৈশাখী মেলার জনপ্রিয়তা শুধুমাত্র সিডনি-বাসীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় - সমগ্র অস্ট্রেলিয়াতে। আয়োজকদের আন্তরিক চেষ্টার ফলেই তা’ সম্ভব হয়েছে।
প্রথম/দ্বিতীয়/তৃতীয় জেনারেশানের বাংলাদেশী/বাংলাভাষীদের দেশ - অস্ট্রেলিয়াতে সিডনির বৈশাখী মেলার আয়োজন এখন শুধুই এক মিলন-মেলা নয় বরং এক মহা উৎসব। এদেশে পারিবারিক অনুষ্ঠানে উঠতি বয়সের বাচ্চাদের যেতে আগ্রহ কম থাকলেও বৈশাখী মেলায় হাইস্কুল/ইউনিভার্সিটিতে পড়ে এমন অনেক বাচ্চাদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয় - যা’ মনে আনন্দের দোলা দেয়। প্রবাস জীবনে ব্যস্ততার মাঝে দেশীয় আমেজে একটু প্রশান্তি পাওয়ার জন্যে, বাংলা সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্যে, পরবর্তী জেনারেশানকে নিজ সংস্কৃতির সাথে পরিচয়/যোগাযোগ স্থাপনের জন্যে - আমাদের সবার প্রচেষ্টা প্রতিফলিত হয় প্রতি বছরের বৈশাখী মেলায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। বৈশাখী মেলার আয়োজকদের প্রাণঢালা ধন্যবাদ।
শুনেছি সিডনির প্রথম বৈশাখী মেলায় আগত সবাইকে বিনামূল্যে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিলো!! সময়ের পরিবর্তনে মানসিক আর সামাজিক চাপে এখন আর তা’ সম্ভব নয়। তবে সফল আয়োজকদের আন্তরিকতা আর প্রচেষ্টায় সিডনিতে খোলা বাতাসের পরিবেশে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আমাদের প্রতিটি বৈশাখী মেলা আগামীতে আরো বড় আকারে অনাবিল আনন্দের হবে - এই আমাদের প্রত্যাশা। শুভ নববর্ষ ১৪২২ - সবাইকে।
২২/০8/২০১৫
মাসুদ পারভেজ, সিডনী, email: mmparvez@yahoo.com
|