-কিরে মা। মন খারাপ কেন?
-নো ওয়ান ওয়ান্টস টু প্লে উইথ মি। আমাকে ওরা খেলায় নেয় না।
ঋষিতার সব অভিযোগ বাবার কাছে। বাবা স্কুল থেকে মেয়েকে নিয়ে হাটে আর খোঁজ নেয় – ক্লাসে বন্ধু কয়জন? কি তাদের নাম? কি কি খেলা খেলে?
-ওরা কেউ আমার খেলা খেলতে চায় না।
আমার কাছে এবার হিসাবটি পরিষ্কার হয়। মেয়ে তো আমার সাথে ওর বানানো খেলা খেলে। খেলা ওর, নিয়মও ওর। আর বাবাকে খেলায় হারানো তো নিত্য দিনের খেলা। আমি ঘটনাটি বুঝি।
পরের দিন ঋষিতা অবাক। আমি কাগজের পাখি, কাগজের দোয়াত আর একটি বল নিয়ে ওর সাথে স্কুলে হাজির। স্কুল শুরুর আগে বাবা আর মেয়ে দিব্যি খেলা শুরু করলাম। ওমা, এখন দেখি ঋষিতার বন্ধুগুলো এক, দুই, তিন করে আমাদের সাথে খেলা শুরু করল। আমি দূরে দাড়িয়ে ওদের খেলা দেখি একদিন, দু দিন, তিনদিন। তারপর ঋষিতাই বলে, ‘বাবা, তোমাকে আজকে খেলায় নেব না।‘
যাক, ঋষিতার বন্ধু সমস্যা তাহলে শেষ।
কিসের কি? কয়েক মাস পর ওর আবার সেই একই আবদার।
-বাবা। তুমি আমার সাথে স্কুলে খেলতে আস।
আমি টের পাই ওর কষ্টের কথা। ও দিন দিন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। স্কুল ওর ভাল লাগে না। পড়তে ভাল লাগে না।
আমি বুদ্ধি আঁটি। ছেলেবেলায় দেবল ডি ক্রুজের ম্যাজিক দেখতাম। উনি আমাদের বাড়িতে আসলেই আমাদের আবদার শুধু ম্যাজিক দেখানো নয় ম্যাজিক শিখাতেও হবে। প্রতিবার উনি আমাদের ম্যাজিক দেখাতেন আর কি যে শিখাতেন যে উনি চলে যাবার পরই ওই ম্যাজিক আর করতে পারতাম না।
ম্যাজিকের বই নেই, মানুষ নেই। শিখব কোথায়? পুরানো ঢাকায় ক্যাঁতর আলী নামের একজন ম্যাজিশিয়ান ছিল। কি ভয়ানক একেকটি ম্যাজিক দেখাত রে বাবা। জিহ্বা কেটে জোড়া লাগাত। একগাদা ব্লেড খেয়ে ফেলত তারপর মুখ থেকে লাইন ধরে বের করত। আমি আর আমার ভাই রবিন লক্ষ্মীবাজারের ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে কতদিন দাড়িয়ে ওই লোম খাড়া হওয়া ম্যাজিক দেখেছি। কিন্তু ম্যাজিক শেখানোর মানুষ আর পেলাম না।
আমাদের ‘মা গুগুল’ বাঁচিয়ে দিল। গুগুল ঘেঁটে বেশ কয়েকটি ম্যাজিক ঠিক করলাম। ম্যাজিকের জন্য সরঞ্জাম ও তো দরকার হয়। কিনে নিলাম। এবার ঋষিতাকে ট্রেনিং দেবার পালা। ও তো ম্যাজিক দেখে হা হয়ে গেল।
-বাবা এটা কেমন করে হয়?
আমি তো এই প্রশ্নটি শুনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
-তুমি শিখবে?
-আমি ম্যাজিক দেখাব।
ঋষিতার ম্যাজিক শেখা শুরু হোল। প্রথমে ওর আঙ্কেল-আন্টিদের দেখাল। তারপর স্কুলে ম্যাজিক শো করল আর হ্যামিলনের গল্পের মত ওর সব বন্ধুগুলো ওর পিছনে ঘুরল আর বলল, ‘ক্যান আই বি ইয়োর ফ্রেন্ড? উইল ইউ টিচ মি দি ট্রিক? ’
ও তো এখন ম্যাজিক দেখায় আর টিনের বাক্সে ডলার জমায়। ওর সামনে বাংলাদেশের পত্রিকা খুলি না। খারাপ খবরগুলো আমরা আড়ালে আবডালে বলি। কিন্তু ওকে আমি বাংলাদেশের ম্যাজিক এর কথা বলি। জুয়েল আইচের কথা। ওর বিশ্বাস হয় না। আমি ডেভিড কপারফিল্ডের সাথে মিলিয়ে বলি, ‘ডেভিড তো জুয়েল আইচের বন্ধু’।
ঋষিতার চোখ বড় হয়। আমার সাথে ইউ টিউব এ জুয়েল আইচের ম্যাজিক দেখে। জুয়েল আইচের দুষ্টামি ভরা ম্যাজিক দেখে ও হেসে গড়াগড়ি খায়। আমি ঋষিতাকে একটি গল্প বলি।
আমরা বিষাদ সিন্ধু নাটক করছিলাম। একবার শো’র আগের দিন আমার গলা বসে গেল। কথা বের হয় না। এমন ঘটনা আগে অনেকবারই হয়েছে। আমি সারা রাত প্রতি ঘণ্টায় অ্যালার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠে আদা পানি দিয়ে গারগেল করলাম। পরেরদিন দিন ইউনিভার্সিটি তে গেলাম। একটি শব্দ ও করলাম না। আমার বন্ধুরা ভাবল আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
সন্ধ্যায় মহিলা সমিতি – মানে আমাদের নাটকের হলে গিয়ে হাজির। সবাইকে ইশারা দিয়ে বললাম, ’আমি শো করতে পারব না।‘
কেউ আমার কথা বিশ্বাস করল না। আমাদের স্টেজ ম্যানেজার মিজান ও ভাবল আমি দুষ্টামি করছি। ও ভাবল, সময় মত আমি ঠিকই স্টেজে ঢুকব। আমি উপায় না দেখে কুদ্দুস ভাইয়ের কাছে গেলাম। উনিও বিশ্বাস করল না। বলল, ‘এই শোন দুষ্টামি ছাড়ো। জানো আজকে জুয়েল আইচ আমাদের শো দেখতে এসেছে? ’
আমি কিন্তু আগেই জানতাম জুয়েল আইচ আমাদের নাটক দেখতে আসবেন। কারণ জুয়েল আইচ মোস্তফা ভাইকে চিনে। মোস্তফা ভাই অস্ট্রেলিয়া থেকে তখন বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছে। উনারা সবাই একসাথে আমাদের নাটক দেখবে।
ঋষিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘মোস্তফা আঙ্কেল ওই ম্যাজিশিয়ান কে চিনে? ’
-আগে পুরো গল্পটি শুন।
- তারপর কি হোল?
-আমার গলায় তো আর শব্দ হয় না। তিন ঘণ্টার নাটক। ওখানে আমি গল্প বলি, গান গাই, নাচি। আর সারাক্ষণ আমি স্টেজে থাকি। ফাঁকি দিব কি করে?
- তারপর কি করলে?
আমি মোস্তফা আঙ্কেলকে বললাম, ‘জুয়েল আইচ কে ভিতরে নিয়ে আসেন’। জুয়েল আইচ ভিতরে এলো। আমি তার হাত ধরে বললাম, ‘আপনি তো ম্যাজিশিয়ান। আমার গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরুচ্ছে না। একটা কিছু করেন। নতুবা আমি শো করতে পারব না।‘
-‘ওই ম্যাজিশিয়ান তোমার গলার শব্দ ঠিক করে দিল? ’ ঋষিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
শোন, ওই ম্যাজিশিয়ান বলল, ‘আমার চেয়ে বড় ম্যাজিশিয়ান তো আপনারা। এই যে স্টেজে এখন আপনারা ম্যাজিক দেখাবেন আর আমরা সেই গল্প বিশ্বাস করব। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকব’।
আমি জুয়েল আইচ কে কিছু বলতে পারিনি। আসলেই তো আমরা ম্যাজিশিয়ান। আমরা স্টেজে ম্যাজিক করি।
ঋষিতা আমাকে থামিয়ে দিল। ‘বাবা, তুমি ম্যাজিক জানো না। আমি ম্যাজিশিয়ান।'
- তারপর কি হোল জানো? মোস্তফা আঙ্কেল পরের দিন জুয়েল আইচকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলো।
- হোয়াট? জুয়েল আইচ আমাদের বাড়িতে এসেছিল? আমি তখন কোথায় ছিলাম?
- তুমি তখন মা’র পেটে ঘুমিয়ে ছিলে।
- জুয়েল আইচ তোমাদের ম্যাজিক দেখিয়েছিল?
- আমাদের বাড়িতে একটি সুন্দর বাঁশি ছিল। জুয়েল আইচ ওটা হাতে নিয়ে ফুঁ দিল। আর সারা ঘরে ম্যাজিক হোল।
- কেমন ম্যাজিক?
- ওই বাঁশি দিয়ে যে এত সুন্দর সুর হতে পারে -আমরা জানতামই না।
- ওই বাঁশি টি কোথায় ?
- ওটা সব সময় আমাদের সাথেই ছিল। এই অস্ট্রেলিয়া আসার সময় ও ওটা নিয়ে এসেছিলাম। কারণ ওটা জুয়েল আইচ বাজিয়েছিল যে।
- ওটা কোথায়?
- তুমি যখন ছোট ছিলে, শুধু ওটা দিয়ে খেলতে চাইতে। একদিন ওটা দিয়ে খেলতে গিয়ে তুমি বাঁশিটা ভেঙ্গে ফেলেছ।
ঋষিতার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি ওকে আদর করে বলি, ‘আমরা আরেকটা বাঁশি নিয়ে যাব। তারপর জুয়েল আইচ কে বলব ওটার উপর তোমার নাম লিখে দিতে’।
-বাবা। আই থিংক ওই বাঁশি টা যখন আমি ভেঙ্গেছি, তখন ওটার ম্যাজিক আমার মধ্যে চলে এসেছে। দ্যাট ইজ হয়াই আই এম এ ম্যাজিশিয়ান।
আমি ঋষিতাকে জড়িয়ে ধরলাম। বিস্ময়কর এই মানুষটি কি শুধু আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছে? প্রবাসী আলো বাতাসে বেড়ে উঠা এই মেয়েটিকে এমন স্বপ্ন জুয়েল আইচই দেখাতে পারে। জুয়েল আইচ এখন সিডনিতে। আমি ঋষিতাকে নিয়ে জুয়েল আইচ এর ম্যাজিক দেখতে যাব। ওর কানে কানে বলব, ‘দেখ মা। এই আমাদের বাংলাদেশ। আর ওই মানুষটি হচ্ছে আমাদের জুয়েল।’
জন মার্টিন, সিডনি
|