আগের অংশ
আক্কাস আলীর গলা নরম হয়ে আসে। এই কদিন সে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিল। চারিদিকে লোকজন বলাবলি করছিল যে ভাইরাসের কারণে দেশের অবস্থা আরো খারাপ হবে। লোকজন তো লাইন দিয়ে খাবার কিনে ঘরে জমাচ্ছে। আক্কাস আলীর হাতে জমানো টাকা নেই। মেয়ের কাছে যে চাইবে তারও উপায় নেই। কিছুদিন আগে নাতনীর বিয়ে দিয়েছে। হাত তো একদম খালি। নরম গলায় ছেলেকে বলে, ‘সেইটা না হয় করলাম। কিন্তু বাজান, এত্তগুলা ট্যাকা আমগো দিয়া দিলা। তুমরা চলবা ক্যামনে?’ মফিজ হেসে বলে, ‘আমগো লাইগা চিন্তা কইরেন না। আপনেরা যেমন আমগো ছোটবেলা আগলাই রাখছিলেন, আমগো সরকারও এই দুর্যোগে আমগো আগলাইয়া রাখছে’। আক্কাস আলী তাঁর ছেলের কথা বুঝে না। আবার জিজ্ঞেস করে, ‘তুমগো কে আগলাইয়া রাখছে? কেমনে আগলাইয়া রাখছে?’ -আব্বা। এই দেশ তো তুমগো দ্যাশের মত না। এই ভাইরাস এর লাইগা অনেক মানুষ চাকরি হারাইছে। অনেক ব্যবসায়ীর ইনকাম কইমা গ্যাছে। আর সরকার সব্বাইরে বেতন দিয়া দিছে। যারা ট্যাকা ধার লইছে তাগো সুদ দিতে না করছে। সবাই যেন খাইয়া পইরা বাঁচতে পারে- তাঁর লাইগা ব্যবস্থা করছে। আক্কাস আলী ভাবে মফিজ তাঁকে খুশী করার জন্য বানিয়ে বানিয়ে কথা বলছে। সন্দেহ মনে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘তুমারে যদি ভাইরাস ধরে তাইলে কি হইব? তুমার চিকিৎসার লাইগা তো ট্যাকা লাগব। এই ট্যাকা তুমার চিকিৎসার লাইগা রাইখা দেও?’ মফিজ পুরো জানালা খুলে দেয়। মনের ভিতর কেমন আস্থা অনুভব করে। আব্বাকে বলে, ‘আব্বা, আমগো সব চিকিৎসা ফ্রি। আমগো একটা সবুজ কার্ড আছে। ওইটা ঘসা দিলেই ডাক্তার দেখান যায়। কোন পয়সা লাগে না’। আক্কাস আলীর গলায় আবার সন্দেহ জাগে, ‘তুমার অক্সিজেন লাগলে, হাসপাতালে ভর্তি হওন লাগলে, এম্বুলেন্স লাগলে কি করবা? ট্যাকা পাইবা কই?’ মফিজ ঠাণ্ডা গলায় বলে, ‘আব্বা, কইলাম না সব সব কিছু ফ্রি’। এবারও আক্কাস আলীর বিশ্বাস হয় না। কান্না-ভেজা গলায় অসহায়ের মত জিজ্ঞেস করে, ‘বাজান তুমি ঠিক কইরা কও । আমার কসম লাগে। তুমার মায়ের কসম লাগে। ঠিক কইরা কও। তুমারে কি সরকার খাওয়ার লাইগা, ডাক্তার দেখানোর লাইগা, হাসপাতালে চিকিৎসার লাইগা ঠিকই এমনি এমনি ট্যাকা পয়সা দিব? তুমারে কি ঠিকই আগলাইয়া রাখব? তুমার ট্যাকার দরকার লাগলে আমি জমি জমা সব বিক্রি কইরা দিমু। আমারে হাঁচা কতা কও’। আব্বার জন্য মফিজের মায়া লাগে। বাবারা বুঝি এমনি হয়। প্লেনে মফিজ যে ভাবে তাঁর বাচ্চা দুজনকে আগলে রেখেছিল, ঠিক একি ভাবে এই বৃদ্ধ বাবা সব কিছুর বিনিময়ে মফিজকে আগলে রাখতে চায়। মফিজ আদর নিয়ে বলে, ‘আপনার আর আম্মার কসম খাইয়া বলতাছি। এই দেশের সরকার আমগো সব দায়িত্ব লইছে। এই ভাইরাসের সময় সরকার আমগো বাঁচায় রাখব আব্বা’। আক্কাস আলী ফোনটি তাঁর স্ত্রীর হাতে দিয়ে দু হাত তুলে মোনাজাত করে, ‘ইয়া আল্লাহ। যে দেশ আমার সোনার টুকরা পোলার সংসার আগলাইয়া রাখছে – হেগো তুমি আরো বড় কর। আরও দৌলত দেও। যেন তারা আরও মানুষরে এই বিপদের দিনে বুকে আগলাইয়া রাখে’। মফিজ হাজার মাইল দূরে বসে আব্বার মোনাজাত শুনে। তারপর বলে, ‘আব্বা, খালি আমরাই ভাল থাকুম এইটা কেমনে হইব? আমি লাখ খানিক ট্যাকা পাঠাইতাছি। আপনেরা ও ভাল থাকবেন। ট্যাকাগুলি হিসাব কইরা খরচ করবেন কিন্তু’। মফিজের আম্মা কান্না থামিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, ‘বাজান তুমারে একটা কথা জিগাই। তুমগো সরকার এত ট্যাকা কই পায়’? মফিজ বিজ্ঞের মত উত্তর দেয়, ‘এই ট্যাকা আসলে সরকারের না। এই ট্যাকা হইলো জনগনের। ঐ যে প্রত্যেক বছর এই দেশের মানুষ ট্যাক্স দেয়। সরকার তো সেই ট্যাকাই অহন এই দুর্যোগের সময়ে জনগণরে আবার ফেরত দিতাছে’। হঠাৎ আক্কাস আলীর মনে প্রশ্ন জাগে। স্ত্রীর হাত থেকে ফোন নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘বাজান। তুমি যে হোটেলে কাম কইরা টাকা জমাইলা। সেই ট্যাকায় কি ট্যাক্স দিছ’? মফিজ এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। একটু থেমে গিয়ে বলে, ‘আব্বা। নগদ ইনকাম এর কথা তো সরকার জানতে পারব না। তাই নগদ ট্যাকায় কাম করলে ট্যাক্স দেয়া লাগে না’। আক্কাস আলীর গলা শক্ত হয়ে উঠে, ‘যে দ্যাশটা এই বিপদে তুমারে আর তুমার পরিবাররে আগলাইয়া রাখছে, তোমার ভরন পোষণ করতাছে, চাকরি নাই তারপরও বেতন দিতাছে, চিকিৎসা ফ্রি দিতাছে- সেই দ্যাশটারে তুমি ঠকাইতা ছ? তুমি না কইলা – তুমগো দেশের সরকার জনগনের ট্যাক্সের ট্যাকা এই বিপদে জনগণরে দিতাছে। তাইলে বাজান তুমি ক্যান ট্যাক্স দিবা না?’ মফিজের কথা আঁটকে যায়। কিছু বলতে পারে না। মফিজের ভীষণ গরম লাগে। জানালার কাঁচ আরেকটু বেশী করে খুলে দেয়। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে। সেই বাতাসে মনে পড়ে গ্রামের কথা। আব্বা আর আম্মার কথা। তাঁদের বাড়ী ঠিক করতে হবে, দুটা গরু কিনতে হবে, আম্মাকে ডাক্তার দেখাতে হবে। কয়েক লাখ টাকার হিসাব কষে মনে মনে। আক্কাস আলী শক্ত গলায় বলে, ‘তুমার ঐ নগদ ট্যাকার আমার দরকার নাই বাজান। যে গরুটা আছে আমি অইটা বিক্রি কইরা দিমু। ওইটা দিয়া কয়েক মাস চইলা যাইব। তুমার আম্মারে বাজারের ডাক্তার দেখামু। আমগো নিয়া চিন্তা কইর না। মনে আছে? ছোটবেলা তুমগো শিখাইছি, যে থালায় ভাত খাইবা সেই থালায় ময়লা ফালাইবা না’।
মফিজ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। আব্বাকে একজন নতুন মানুষ মনে হয়।
আগের অংশ
জন মার্টিন, সিডনি
|