-বাজান তুমি কেমুন আছো? তুমারে নিয়ে আমগো চিন্তার শ্যাস নাই। তুমার মায়ের চক্ষে ঘুম নাই। আমার চক্ষে ঘুম নাই। বাজান তুমি কেমন আছো?
রাত তিনটায় আব্বার টেলিফোনে মফিজের ঘুম ভাঙল। শুক্রবারে সে একটু বেশী রাত করেই বাড়ি ফিরে। কাজ শেষে বাঙ্গালী পাড়ায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে, বাঙ্গালী খাবার খেয়ে, ঘরে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। ততক্ষণে মফিজের বউ আর ছোট দুই বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়ে। এটা মফিজের প্রতি সপ্তাহের রুটিন। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার চেক করে যখন ঘুমাতে যায় তখন ঘড়ির কাঁটা রাত দুটা’র ঘরে। রাত তিনটায় বাবার ফোনে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলেও মফিজ বিরক্ত হয়নি। একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আব্বা, আপনি এতো অস্থির হইয়া আছেন ক্যান? কি অইছে’?
আক্কাস আলীর এক ছেলে আর এক মেয়ে। মফিজ বংশের বড় ছেলে। আদর-আহ্লাদে বড় হয়েছে। ভাগ্য বদলাতে মফিজ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিল পাঁচ বছর আগে। পড়াশুনা তেমন করেনি। এলাকায় বড় ভাইয়ের বুদ্ধিতে এদিক সেদিক টাকা দিয়ে ভিসা যোগাড় করলো। তারপর ‘এই দল’ আর ‘ঐ দল’ এর গল্প দিয়ে বিদেশে থাকার লটারি মিলে গেল। আক্কাস আলী খুশী হয়নি। বার বার বলেছে, ‘চইলা আসো। নানা রকম গল্প বানায়া বিদেশে থাকনের দরকার নাই’। এই পাঁচ বছরেও আক্কাস আলীর সেই আবদার বদলায়নি।
মফিজ ফোনের স্ক্রিনে তাকায়। আব্বার চেহারা দেখতে পায় না। আব্বা আজকে ভাইবারে ফোন দেয় নি। সরাসরি ফোন দিয়েছে। এতে খরচ বেশী সেটা আব্বা জানে। আক্কাস আলী উৎকণ্ঠা গলায় আবার জিজ্ঞেস করে, ‘বাজানরে। তুমি কেমন আছো? আমার তো চিন্তায় ঘুম হারাম হইয়া গ্যাছে। তুমার মা সাতদিন ধইরা নাওয়া খাওয়া বন্ধ কইরা দিছে’। মফিজ আশ্বস্ত করে, ‘আব্বা, আমারে নিয়ে এতো চিন্তার কিছু নাই। আমি ভাল আছি। আমরা সবাই ভাল আছি’। আক্কাস আলী ছেলের কথা শুনে শান্ত হয় না। আরও কিছু বলতে চায়। কিন্তু ছেলে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘আব্বা, আমগো এইখানে অনেক রাইত। প্রায় রাইত তিনটা। আমি আপনেরে কাইল সকালে ফোন দিমুনি। তারপর অনেকক্ষণ কথা কমু। আর আপনার নাতি নাতনী দুইটা ঘুমাইতাছে। অহন তো আর ওরা আপনের লগে কথা কইতে পারব না’।
আক্কাস আলী গ্রাম থেকে ফোন করার সময় ছেলের দেশের সময়ের হিসাব গুলিয়ে ফেলেছিল। কিংবা হয়তো জেনেও না জানার ভান করেছিল। আক্কাস আলী আঙ্গুল দিয়ে শুধু ঋণের টাকার হিসাব কষে না। এই আঙ্গুলে দিয়ে দিনভর হিসাব রাখে কতদিন ছেলের সাথে কথা হয় না। দুই হাতের আঙ্গুল দিয়ে গোনা শেষ হলে, পায়ের আঙ্গুল যোগ করে। গুনে গুনে দেখে মফিজ ত্রিশ দিন হয় ফোন করে না। মফিজও জানে অনেক দিন আব্বার সাথে কথা হয় না। প্রতিদিন দেশ থেকে মফিজের ফোন আসে। আম্মা নতুবা আব্বা পালা করে ফোন দেয়। বাড়ির সবার সাথে কথা বলে। সেই গল্পে তরকারিতে নুনের কথা থাকে, বাচ্চা দুটোর স্কুলের গল্প থাকে আর বাংলা দোকানে কি কি পাওয়া যায় ওগুলোর হিসাব আম্মাকে দিতে হয়। কিন্তু দেশ থেকে ফিরে আসার পর মফিজের কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করে না, ঘর থেকে বের হয় না। চৌদ্দ দিন তো একটানা কোয়ারেন্টাইনে ছিল। চার মাস আগে দেশে ছোট বোনের মেয়ের বিয়ে খেতে গিয়েছিল। ফিরে আসার ঠিক সাতদিন আগেই সকল ফ্লাইট বন্ধ। মফিজের ছেলের বয়স পাঁচ আর মেয়েটি এবারে সাতে পা দিল। ছোট বোন ওর ছোট্ট বাড়িতে ভাইয়ের জন্য একটি ঘর খালি করে দিয়েছিল। ওখানেই গাদাগাদি করে ভয়ে ভয়ে চার মাস কাটিয়েছে। তিনবার ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। দেশ ছাড়ার উপায় নেই। বাচ্চা দুটা ঘরে থাকতে থাকতে বদলে গ্যাছে। কিছু বললেই কাঁদে না হয় চিৎকার করে। ওদের কান্না দেখে মফিজের বুকে কান্না জমে। কাউকে দেখাতে পারে না। রাতে বাচ্চা দুটাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাত। মফিজ এখনও হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে ঘরের মধ্যে হাটাহাটি করে। মাথার কাছের জানালা বন্ধ করে রাখে। ভয় পায়। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘জানি না। ক্যান জানি খালি ডর ডর লাগে। মনে অয় মইরা যামু’।
মফিজ ডাক্তার দেখায়। সাতদিনে তিনবার ডাক্তারের কাছে ঘুরে এসেছে। কত কিছু পরীক্ষা করিয়েছে। ডাক্তার বুঝিয়ে বলেছে, ‘আপনার মনে ভয় ঢুকেছে। মৃত্যুভয়’। মফিজ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমি কি মরে যাব’? ডাক্তার সাহস দেয়, ‘মৃত্যুভয় হচ্ছে মরে যাবার আগেই মরে যাওয়া । আপনার এমন কোন রোগ নেই যে আপনি এখনি মরে যাবেন’।
মফিজ তারপরও মনে শান্তি পায়না। একা একা ভাবে বোনের মেয়ের বিয়েতে না গেলেই ভাল হতো। তাহলে আর দেশে আঁটকে যেত না। চার মাস- সাবান দিয়ে হাত ধুতে ধুতে এখন দিনে একশ বার হাত না ধুলেই ওর অস্বস্তি শুরু হয়। বাচ্চা মেয়েগুলোকে হাত পা ধুইয়ে ধুইয়ে তো ঠাণ্ডা-জ্বর লাগিয়ে রেখেছিল। দেশ ছেড়ে আসার সময় মেয়েটি প্লেনে কতবার সিট ছেড়ে উঠতে চেয়েছে। মফিজ বাচ্চা দুটোকে সিট ছেড়ে উঠতে দেয় নি। গুনে গুনে আট ঘণ্টায় দুবার টয়লেটে যেতে দিয়েছে। কিচ্ছু ধরতে দেয় নি। বাচ্চা দুটা ভয়ে কুঁকড়ে ছিল। এখন ঘরে কোন কিছু ধরলেই আব্বা-আম্মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘এইটা ধরলে কি ভাইরাস আসবে?’ ছোট মেয়েটি রাতে ঘুমের ঘোরে বিছানা ছেড়ে ঘরে হাঁটাহাঁটি করে। পরের দিন কোন কিছু মনে থাকে না। হাঁটাহাঁটির কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘তোমরা মিথ্যে কথা বলছো। আমি তো বিছানায় ঘুমাচ্ছিলাম’। ডাক্তার বলেছে এটা স্লিপ ওয়াকিং। বাচ্চাদের এই বয়সে এমন হতেই পারে। আবার ভয় পেলেও বাচ্চারা এমন করতে পারে।
ছেলেটি প্রতিরাতে বিছানা ভিজায়। অথচ আগে এমন ছিল না। দেশে আঁটকে যাবার পর থেকে ওর বিছানা ভিজানোর কাণ্ড শুরু হয়েছে। রাতে দুবার ডেকে উঠিয়ে টয়লেটে নিয়ে যায় । তারপরও ছেলের বিছানা ভিজে যায়। মেয়েটি ঘুমের ঘোরে বাবা-মা’র ঘরে চলে আসে। মফিজ বুঝে না মেয়েটি ঘুরে ফিরে শুধু ওদের ঘরের ভিতর কেন আসে? মফিজের সংসারে এতো কিছু ঘটে যাচ্ছে - কিন্তু আব্বাকে কিছু বলতে পারে না। আব্বা বুড়ো মানুষ। এই চার মাসে আব্বা -আম্মা ওদের চিন্তায় বড় কাহিল হয়ে গিয়েছিল। চারিদিকে ভাইরাস। সবাই ভয়ে তটস্থ। আব্বার শরীরও খুব তরতাজা না। আম্মা অনেকদিন ধরে অসুস্থ। বড় ডাক্তার দেখাতে হবে। মফিজ ভেবেছিল সে নিজে আম্মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। কিছু করতে পারেনি। দেশ ছেড়ে আসার সময় মফিজ আব্বার সাথে দেখা করতে পারেনি। টেলিফোনে আব্বা আর আম্মার বুক ফাটা আহাজারি শুনেছে। সেই কান্নায় মফিজের বুক ভারী হয়েছে। মফিজ জানে এই কান্না আর আহাজারি মৃত্যুকে থামাবে না। চারিদিকে মৃত্যুকূপ পাতা রয়েছে। কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই। শুধু চুপ করে আব্বা আর আম্মার কান্না শুনেছে।
মফিজ আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলো। এপাশ ওপাশ করলো কিছুক্ষণ। তারপর উঠে গিয়ে ঠাণ্ডা পানি খেল। মাথার কাছের জানালা খুলে দিল। ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগলে মফিজের আম্মার কথা মনে পড়ে। আম্মা খালি গায়ে থাকতে দিত না। বিকেল বেলা গোসল করতে দিত না। বলত, ‘ঠাণ্ডা লাগলে তখন বুঝবা’। মফিজ এখন ঠাণ্ডা লাগার ভয়ে জানালা বন্ধ করে রাখে না। সে ভয়ে জানালা খুলে না। কিসের ভয় ঠিক জানে না। শুধু মনে হয় খারাপ কিছু হবে। জানালার পাশে দাড়িয়ে মফিজ ফোনের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ আগে আব্বা ফোন দিয়েছিল। মফিজের আবার ফোন দিতে ইচ্ছে হোল। রি-ডায়াল চেপে ফোন কানের কাছে ধরল। ফোন একবারের বেশী বাজতে পারে নি। মফিজের আব্বা ফোন ধরল। জিজ্ঞেস করলো, ‘বাজান তুমি ঘুমাও নাই’? -না আব্বা। ঘুম আসতাছেনা। -তোমার শরীর খারাপ হয় নাই তো? মাথার কাছের জানালা কি খুইলা ঘুমাও? তোমার আম্মা আমারে কতবার মনে করায় দিল । কিন্তু এই কথাটা তুমারে তখন বলতে ভুইলা গেছি। মফিজ আব্বাকে আশ্বস্ত করে, ‘আব্বা। আমি ভাল আছি’। আক্কাস আলী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমার শরীরে ঐ ভাইরাস নাই তো? ডাক্তার দেখাইছ? টেস্ট করছ? ডাক্তার কি কইল? কেন যে তুমি বিয়া খাইতে আইলা? আইচ্ছা তুমি এই ত্রিশ দিন ফোন দেও নাই ক্যান? তুমার কি কিছু হইছিল?’ মফিজ তাঁর আব্বাকে ভাল ভেবে চিনে। একবার প্রশ্ন করা শুরু করলে আর থামে না। আব্বার কথার মাঝখানে সুযোগ বুঝে উত্তর দিল, ‘আব্বা শুনেন। আমার গায়ে ঐ ভাইরাস নাই। আমরা সবাই টেস্ট করছি। আর আমি আপনারে এতদিন ফোন দেই নাই তাঁর একটা কারণ আছে’। -কি কারণ খুইলা বল। মফিজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ভাবে সত্যি কথাটা বলবে কিনা। জানালাটি আরেকটু খুলে দেয়। ঠাণ্ডা বাতাস মফিজের গাঁ ছুঁয়ে যায়। গাঁ শির শির করে উঠে। টেলিফোনে কানে রেখে টের পায় আব্বা উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। -আব্বা। আমার চাকরি চইলা গেছে। তুমগো পাঠানোর মত ট্যাকা আমার হাতে নাই। তাই এতদিন ফোন করি নাই। আক্কাস আলীর গলার স্বর তিনগুণ বেড়ে যায়। ‘এইটা একটা কথা কইলা বাজান? আমরা কি তুমার কাছে খালি ট্যাকা চাই? মায়া মহব্বত বইলা কি দুনিয়াতে কিছু নাই? এইটা কি কইলা বাজান? এইটা কি কইলা?’
মফিজ শুনতে পায় আব্বার পাশে আম্মা হাউ মাঊ করে কাঁদছে। মফিজের মনটা খারাপ হয়ে যায়। হুট করে জানালা বন্ধ করে দেয়। আব্বাকে বলে, ‘আব্বা শুনেন। আমি জানি আপনেরা আমার কাছে খালি ট্যাকা পয়সা চান না। কিন্তু বড় ছেলে হিসাবে তো আমার কিছু দায়িত্ব আছে। আপনি কইছিলেন আপনের ঘর ঠিক করতে হইব। বর্ষাকালে শান্তি মত ঘুমাইতে পারেন না। দুইটা গরু কিনতে হইব। একটা গরু দিয়া আর ক্ষেতের কাম হইতাছে না। আম্মারে বড় ডাক্তার দেখাইতে হইব। আমি তো জানি আপনে গো কত ট্যাকা লাগব। কিন্তু দিমু কেমনে? এতদিন তো আর চাকরি আছিল না’ আক্কাস আলী মুখের কথা কেড়ে নেয়, ‘নারে বাজান। এই খারাপ সময়ে তুমারে আর ট্যাকা পাঠাইতে হইব না। তুমি আমগো নিয়া চিন্তা কইর না।‘ মফিজ এবার জোড় দিয়ে বলে, ‘আব্বা। শুনেন। আমার হাতে কিছু টাকা আইছে। আমি তিন সপ্তাহ কাম কইরা কিছু জমাইছি’। -তুমি না বল্লা তোমার চাকরি চইলা গেছে? কিসের কাম করলা? -একটা হোটেলে কাম পাইছি। নগদে কাম। যেদিন কাম করি সেই দিনই নগদ ট্যাকা দিয়া দেয়। আপনের লাইগা দুই হাজার ডলার জমাইছি। বাংলা ট্যাকায় এক লাখের উপরে হইব। শুনেন, ভাইরাস না যাওয়া পর্যন্ত এই ট্যাকা দিয়া আর বাড়িঘর ঠিক কইরেন না। ট্যাকাটা জমাই রাইখেন। কওয়া যায় না- সামনে কি আছে’।
|