bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












সুন্দর ফন্টের জন্য SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন...



জন মার্টিন, সিডনি, জুন, ২০১৪


একঃ

অস্ট্রেলিয়াতে শীত আসে বেশ ঘটা করে। উইন্টার সেল, উইন্টার ফ্যাশন – আরও কত মন ভুলানো নাম আছে। তবে সব চেয়ে চোখ ধাঁধানো বিষয়টি হোল – গাছের পাতার রঙ বদলানো। এখন চারিদিকে গাছের পাতার রঙ বদলাচ্ছে। আমার মেয়ে ঋষিতার একটা ব্যাখ্যা আছে। প্রতি সকালে ওকে স্কুলে ড্রপ করার সময় ওর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনতে হয়। ঋষিতা আমাকে জিজ্ঞেস করে , ‘বাবা তুমি জানো ওই লিফগুলো কেন কালার চেঙ করে’?

-না তো? দূর এই পাতার রঙ তো এমনিই ছিল।

- না না। তুমি জানো না। বাট আই নো।

- ওরা কেন রঙ বদলায়?

- কারণ উইন্টার এ ওদের নতুন ড্রেস পড়তে হয়। নতুবা ওদের অনেক ঠাণ্ডা লাগে।

আমি অন্য সবুজ পাতা দেখিয়ে বলি, ‘তাহলে ওই গাছের পাতা সবুজ কেন?’

ঋষিতার উত্তর একদম তৈরি, ‘ওরা অনেক স্ট্রং তো তাই ওদের নতুন জামা লাগে না’।

ঋষিতার কাছে শীত মানে নতুন জামা, নতুন স্টাইল। ও কখনও শীতের কাপড়ের ভিতর থেকে কর্পূরের গন্ধ পায়নি। পাবে কি করে? শীত শেষ হলেই তো ওর কাপড় চলে যায় ‘স্মিথ ফ্যামিলিতে’।

ঋষিতাকে আমি কর্পূরের গন্ধের গল্প বলি।

-আমি যখন তোমার মত ছোট ছিলাম, আমার একটা মেরুন রঙের সোয়েটার ছিল।

-তুমি কি ওটা কে-মার্ট থেকে কিনেছিলে?

-না। আমাদের তো তখন কে মার্ট ছিল না। আমার সোয়েটারটা আমার মা বানিয়েছিল।

ওকে বলেই চলি – ওই একটিই সোয়েটার ছিল। কি সাদা সার্ট, কি লাল সার্ট, কি নীল সার্ট – সব কিছুর সাথে ওই মেরুন রঙের সোয়েটার ছিল সর্ব সঙ্গী। একবার ভুল করে গরম পানি দিয়ে আমার সোয়েটারটি ধোয়া হোল। ব্যাস। আমার সোয়েটার আমার ছোট ভাইর জন্য প্রায় বরাদ্দ হয়ে যায় আর কি? আমি জানি – আবার নতুন সোয়েটার পাবার জন্য আরও একটি শীতের অপেক্ষা করতে হবে। আর এই শীতে দুইটা তিনটা করে মোটা সার্ট পড়তে হবে যেন গা গরম থাকে।

আমি নাকি মায়ের 'দোল্লা পিঠা'। এই পিঠা নাকি অনেক আদর করে বানাতে হয়। আমি কখনো চোখে দেখিনি। কিন্তু এই বয়সেও আমার ভাই বোন আমাকে 'মায়ের দোল্লা পিঠা' বলে ক্ষ্যাপাতে চায়। ওদের অনেক রাগ - মায়ের আলগা আদরগুলো আমি পেতাম বলে। আমি একটু বেশি কালো বলেই মনে হয় মা একটু বেশি আদর করত। আমিও দোল্লা পিঠার আবদারে মাকে গিয়ে বললাম, ‘তোমার তো কত উল আছে। আমার সোয়েটারটা একটু বড় করে দাও না’। মা’র হাতে কি আর এতো সময় আছে? উল্টা বকা দিল, ‘এইটারে নিয়া এতো টানাটানি ক্যান? এইটা রনিরে দিয়া দে- তরে আগামী বছর আরেকটা বানায় দিমু’।

আমি কি আর পরানের ধন ছাড়তে রাজী? মাকে অনেক পটিয়ে রাজী করালাম। মা রাজী হোল। কিন্তু সমস্যা হোল – ওই রঙের উল যে মার কাছে আর নেই। আমি উলের ডালা নিয়ে বসলাম। ডালা ভরা কত উল। লাল, হলুদ, সবুজ। কোথায় মেরুন? উলের ডালায় মেরুনের বড় দুর্দিন। একমাত্র সবুজ উল একটু বেশী। আমি সবুজ উল নিয়ে মাকে দিলাম, ‘এইটা দিয়া জোড়া লাগায় দাও’। মা’র চোখ কপালে উঠল।

‘তোর কি মাথা খারাপ? এই রঙের লগে কি ওই রঙ মিলে’?

‘কিচ্ছু হইব না। তুমি জোড়া লাগায় দাও’।

মা আমার আকুতি বুঝল। আমি ওই দু রঙের উলের জোড়া লাগানো সোয়েটার পড়ে দিব্বি স্কুলে গেলাম।

ঋষিতা বলল, ‘ওটা তো একটা ডিজাইন হোল – তাই না বাবা’?

‘হ্যারে মা। কিছু কিছু দুষ্টু বন্ধুরা ওই ডিজাইন দেখে হাসাহাসি করল’।

‘সো হোয়াট? ওটা তো তোমার ফেভারিট জাম্পার ছিল’?

সোয়েটারটি আমার এতই ফেভারিট ছিল যে পড়তে পড়তে হাতের কনুই এর উল পাতলা হওয়া শুরু হোল। তারপর সেখানে একটা ছোট ছিদ্র হোল এবং সে ছিদ্র ধীরে ধীরে বড় হোল। মা উলের ডালা থেকে আবার সবুজ উল বেড় করল। মেরুন সোয়েটারের হাতের কনুইতে আবার সবুজ উলের ডিজাইন হোল। নতুন ডিজাইনের সোয়েটার দেখে সেই দুষ্টু বন্ধুরা আবার হাসাহাসি করল। ওদের হাসাহাসিতে আমার গা গরম হয়ে যেত। সোয়েটার খুলে ফেলতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু মা বলে দিত, ‘গায়ে গরম কাপড়টা ঠিক কইরা পরিস। নাইলে ঠাণ্ডা লাগব’। মার কথা ফেলি কি করে?

শীতের শেষে মা ওটাকে আবার ভাঁজ করে, কর্পূর দিয়ে বাক্সে ভরে রাখত।

‘কর্পূর কি বাবা’? ঋষিতা জিজ্ঞেস করে।

আমার মা তো স্কুলের শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল না। ন্যাপথলিন কে কর্পুর বলত। আমরাও তাই বলতাম। ঋষিতাকে কি বলব বুঝতে পারি না। মনে হোল ওই মরটিনের উদাহরণটি কাজে লাগবে। যেই না মরটিনের কথা বললাম। ঋষিতা নাক কুঁচকালো।

-উহু। আমি মরটিন লাইক করি না। হাউ কাম ঠাকু তোমার জাম্পারে ওটা দিত?

আমি চুপ করে রইলাম। তাইতো? মা কেন কাপড়ে কর্পূর দিত? শুধু কি পোকা কাটার ভয়ে? নাকি মা ভাবত – আগামী শীতে এটা আবার কেউ পড়বে। প্রতি শীতে তার ১৩টি গরম জামা দরকার। ১৩ টি ছেলেমেয়েকে তো আর একসাথে কোলে নিয়ে আদর আর উমে উষ্ণ রাখা যায় না !

মা হিসাব করে - এই বছর কয়টা গরম জামা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ানো যাবে? এক সোয়েটার আমার গায়ে না লাগলে – ওটা আমার ছোট ভাই পড়বে। ওই সোয়েটার পড়তে পড়তে – উল গুলো আবার পাতলা হবে, মা আবার উলের ডালা নিয়ে বসবে। মেরুন আর সবুজের নতুন ডিজাইন হবে। আবার কর্পূর দিয়ে মা যত্ন করে বাক্সে তুলে রাখবে।

তারপর আবার শীত আসবে।

আমরা বাক্স খুলব।

কর্পূরের গন্ধে ঘর ভরে যাবে।

বাক্সের ভিতর পুরানো সোয়েটার দেখে মনে হবে এর আগে ওটা দেখিনি। মা সোয়েটারটা ঝাড়া দিয়ে গায়ে পড়িয়ে দিবে। একটু ছোট হলেও মা ওটা জোড়ে টান দিয়ে বড় করতে চাইবে। আদর করে বলবে, ‘এই বছরও তর গায়ে কি সুন্দর ফিট করছে’। মা হাত ছেড়ে দিলে সোয়েটার টি আবার চুপসে যাবে। আমি গাঁই গুই করলে মা আবার বলবে, ‘খালি হাতটা একটু ছোট হইয়া গেছে, তাতে কি? হাতে তো আর শীত লাগে না? বুকটা আসল। ওইটা ঢাকা থাকলেই হয়’। আমি সারাক্ষণ হাত দিয়ে কেবল সোয়েটারটি বড়ই করতে চাইব। আর সোয়েটারটি ক্রমশই চুপসে যাবে। সারা সপ্তাহ শীতের হালকা ছোঁয়া আর কর্পূরের গন্ধ আমাদের ঘিরে রাখবে। আর আমরা সারাক্ষণ শুনবো , ‘গায়ে গরম কাপড়টা ঠিক কইরা পরিস। নাইলে ঠাণ্ডা লাগব’।

হ্যাঁ। গরম কাপড়টা ঠিক করে পড়ব। কারণ শীত আসছে।


দুইঃ

প্রতি বছর নাকি শীতের কাপড় বদলাতে হয়। এক কাপড় দুবার পড়া যায় না। তাহলে লোকে তাকিয়ে থাকবে আর বলবে, ‘গেঁয়ো’। এই কথাগুলো প্রতি বছর মৌসুমীর কাছ থেকে শুনতে হয়। আমি এক জাম্পার ৫ বছর পড়ে কাটিয়ে দিতে পারি। কে কি বলল আমার কি? আমি যতই না বলি মৌসুমী ঠিকই নতুন কিছু কিনে নিয়ে আসবে। নতুন কাপড় দেখলে আমার তর সয় না। ওটা পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালে ও খোঁচা দেয় , ‘কেনার সময় তো না না বল, তো এখন পড়ছ কেন’?

আমি কিছু বলি না।

আমি ওই নতুন কাপড়ে দেখি মেরুন আর সবুজের ডিজাইন আছে কিনা?

কাপড়ে কর্পূরের গন্ধ আছে কিনা?

অস্ট্রেলিয়া তে সবাই পাতার রঙ, ঝরা পাতা আর উইন্টার সেল দেখে বুঝে শীত আসছে। আমি আকাশ, পাতা আর দিনের রঙ দেখে ঋতুর পরিবর্তনের টের পাই না। আমার কাপড় গোছান দেখে টের পাই শীত আসছে। গ্রীষ্ম আসছে। আমার কাপড়গুলো যে কখন এই ভাবে ঋতুর সাথে জায়গা বদলায় বিয়ের পর থেকে আমি আর টের পাইনা।

probashimartins@gmail.com





Share on Facebook               Home Page             Published on: 7-Jun-2014

Coming Events: