‘তুমি তো খুব সুন্দর লিখ। আমাকে একটা লিখা লিখে দাও না’? মৌসুমির এই উদ্ভট আবদার শুনে আমি হাসব না কাঁদবো?
‘মানে’?
‘আমি তোমার মত লিখতে পারি না তো ? কিন্তু একজনের কথা আমি ভীষণ লিখতে চাই’।
‘তোমার প্রিয় মানুষের কথা আমি লিখবো কেমন করে? আমি তো সব কথা জানি না’?
‘আমি তোমাকে বলবো’।
‘কিন্তু আমি লিখলে তো ওটা আমার লেখা হবে। তোমার না’।
‘তাতে কি? আমার কথাগুলো তো বললাম ? কেউ না পরুক, আমার প্রিয় মানুষটি তো পড়বে। সে জানবে তার জন্য আমার ভালবাসার কথা’। মৌসুমির মন ভারী হয়ে আসে।
প্রতি নভেম্বরের ৭ তারিখে মৌসুমির মন ভীষণ ভারী থাকে। ওর মনে কত কথা ঘুরে বেড়ায় ওর প্রিয় মানুষকে ঘিরে। আমাকে দু একটি কথা বলে। আমি বেশি কিছু জিজ্ঞেস করি না পাছে ওর মন আরও ভারী হয়।
আমি খুঁজে বের করি মৌসুমির নাটকের জন্য প্রেমের উৎস। ওর প্রিয় মানুষটি ও নাটক করতেন, নাটক করাতেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন এর প্রথম নাটক ‘একতলা দোতালা’। সেই ১৯৬৫ সনের ঘটনা। তখন তো আর অনুষ্ঠান রেকর্ড করে রাখা যেত না, তাই সরাসরি সম্প্রচার হতো। নাটকে অভিনয় করলেন ফেরদৌসি মজুমদার, রামেন্দু মজুমদার, ডলি ইব্রাহিম সহ আরও অনেকে। নাটকটি লিখেছিলেন শহীদ মুনির চৌধুরী। আর এই নাটকটি যিনি প্রযোজনা এবং নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনিই মৌসুমির সেই প্রিয় মানুষ। মনিরুল আলম। মৌসুমির আব্বার বড় ভাই। মৌসুমির বড় চাচা।
এই মানুষটি মৌসুমিকে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল রামপুরার টেলিভিশন অফিসে। তাকে নিয়ে মৌসুমির কত স্মৃতি। মানুষ বেড়ে উঠে মনের ভিতর তার পছন্দের মানুষকে জায়গা করে দিয়ে। এই মানুষটি মৌসুমিকে স্বপ্ন দেখাত। ভাল মানুষ হবার স্বপ্ন। সুন্দর মানুষ হবার স্বপ্ন।
আমার অস্ট্রেলিয়া আসার প্ল্যান শুনে মৌসুমি উত্তেজিত হয়ে বলে , ‘জানো আমার বড় চাচা অস্ট্রেলিয়া এসেছিল’।
‘তাই নাকি? কেন এসেছিল’?
‘বড়চাচার কাছে অস্ট্রেলিয়া সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছিল। ঐ বণ্ডাই বীচে বসে সে সমুদ্র আর আকাশ দেখত। আর আমার বড় খালাকে বস্তা বস্তা চিঠি লিখত’।
আমার বিশ্বাস হোল না। মৌসুমি ঠিকই ওর বড় খালার কাছ থেকে ওর বড় চাচার লেখা গাদা গাদা চিঠি নিয়ে এলো।
মৌসুমির বড় খালা আমাকে ভীষণ আদর করে। আমার ছেলে ঋভু উনাকে ‘দোলা ডার্লিং’ বলে ডাকে। মৌসুমির বড় চাচা আর বড় খালা একসাথে সংসার পেতেছিল।
আমি যত্ন করে চিঠিগুলো খুলি। মজনু তার লাইলীকে প্রেমের কথা বলেছে। সিডনি’র কথা বলেছে। লিখেছে যে ভারী সুন্দর এই দেশ, এই দেশে তার লাইলীকে ঘুরতে নিয়ে আসবে।
‘জানো, বড় চাচা কিন্তু অস্ট্রেলিয়া এসে থাকতে চেয়েছিল’। কি জানি তার মুখে শুনে শুনেই কি মৌসুমি অস্ট্রেলিয়ার প্রেমে পড়েছিল? নতুবা এত দেশ থাকতে – ও এখানে আসবে কেন?
আমি মৌসুমির আম্মাকে বড় চাচার কথা জিজ্ঞেস করি, ‘নভেম্বরের ৮ তারিখে উনার অফিসের কাজে অস্ট্রেলিয়া আসার কথা ছিল। উনার অবস্থা তোমার মত। কোথাও গেলে নিজের ব্যাগ নিজে গুছাতে পারতো না । আমি ব্যাগ গুছিয়ে দিলাম’।
বড় চাচার অস্ট্রেলিয়া আসা হোল না। পচাত্তুরের ৭ই নভেম্বর দেশ অস্থির হয়ে উঠল। সবাই তাকে বলল , ‘আলম সাহেব, দেশের অবস্থা ভাল না। আজ আর অফিসে যাবেন না’।
মৌসুমির আম্মার এখনও ঐ দিনটির কথা মনে আছে। ‘তোমার বড় চাচা গাড়িতে উঠতে উঠতে বললেন, আমরা রেডিও – টেলিভিশনের মানুষ। বন্দুকের মুখেও কাজ করতে হবে’।
উনি রামপুরার টেলিভিশন অফিসে গেলেন। একদল জলপাই পোশাকের জল্লাদ আরও তিনজন সহ বড় চাচাকে তারই অফিসে আটকে রাখলেন সারাদিন। কেউ দেখা করতে পারল না, কথা বলতে পারল না। শুধু জানল তার সাথে দেখা করা, কথা বলা নিষিদ্ধ।
সেই একাত্তুরের যুদ্ধের সময় এক সকালে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এক কাপড়ে পুরো পরিবারকে বন্দুকের মুখে পাঠিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানে – ঠিক এমন খাকি রঙের পোশাকের জল্লাদগুলো। সবাই ভেবেছিল বড় চাচার পরিবার আর বেঁচে নেই। ওরা দেশ স্বাধীন হবার পর পালিয়ে চলে এলো। নিজ দেশে । দেশকে জীবন দিয়ে ভাল না বাসলে কি জীবন দেবার জন্য কেউ দেশে ফিরে আসে?
পচাত্তুরের ৭ই নভেম্বরে সেই মানুষটিকে খুন করে, হাত পা বেঁধে, বস্তায় ভরে রামপুরার পিছনের ঝিলে ফেলে দেয়া হোল।
কেউ জানল না।
তারপর শুধু প্রতীক্ষা।
এই পরিবার প্রতীক্ষার এক নতুন সংজ্ঞা তৈরি করলো।
প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ ওরা কেবলই প্রতীক্ষা করলো। এই বুঝি দরজায় কড়া নেড়ে সেই প্রিয় মানুষটি ঢুকবে আর বলবে, ‘কি রে ভয় পেয়েছিলি’?
ফকির-দরবেশ, বন্ধু-বান্ধব, উঁচু মহল – কোথায় যায়নি ওরা? শুধু একটি খবরের জন্য। মানুষটি কেমন আছে? কোথায় আছে?
কেউ জানল না। কেন মারা হোল?
চারমাস পর রামপুরার ঝিলের পানি শুকালো, কিন্তু এই পরিবারের চোখের পানি শুকালো না।
রামপুরার ঝিলে তিনটি বস্তা ভেসে উঠল। এই নির্বাক পরিবারের মনে নতুন আশা জেগে উঠল। এখনও বুঝি সে বেঁচে আছে! স্বপ্ন মানুষকে কতখানি বোকা বানাতে পারে?
প্রায় পচে যাওয়া বস্তার মুখ খুলে দেখল – সেই মানুষের হাসিটি আর নেই। শেষ দিনের পড়ে যাওয়া কাপড়গুলো আগলে আছে কিছু হাড়গোড়। এমনও হয় যে মানুষের কাপড় গুলো হয়ে উঠে তার নিশানা। কোথায় সেই চোখ, মুখ, হাসি আর মায়া? কিচ্ছু নেই। ঐ বস্তার ভিতর কেবল কষ্ট আর কান্না। প্রিয়জনদের না দেখা কান্না। অনাদরে চলে যাবার অভিমান আর ঘেন্না।
ওরা জানল – সিপাহি বিপ্লবের নামে এই ভাল মানুষটিকে কিট পতঙ্গের মত মেরে ফেলা হয়েছে।
তার শরীর পোকামাকড় কামড়ে কামড়ে খেয়েছে। কি অনাদরে মানুষগুলো পড়ে ছিল ঐ পানির নীচে।
বড় চাচার তো মরে যাবার কথা ছিল পাকিস্তানে? ছোট তিন বাচ্চা আর বউকে নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার সময়। সেই অন্ধকারে তিন রাত ফলের ট্রাক আর গাধার পিঠে করে চুপি চুপি পাহাড় পাড়ি দেবার সময় অচেনা পাঠান ড্রাইভার তো তাদের মেরে ফেলতে পারতো? যে মায়া ঐ ভিনদেশের পাঠানের বুকে ছিল, সেই মায়া কেন জলপাই রঙের পোশাকে নেই?
যে দেশটাকে সবচেয়ে নিরাপদ ভেবে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে চলে এলো – সেই দেশেই তাকে মরে যেতে হোল। যে দেশটাকে ভালবেসে – নিজ হাতে গড়ার দায়িত্ব নিলো, সেই দেশেই বেয়োনেটের খোঁচায় রক্তাক্ত হোল তার বুক। হায়রে অভাগা দেশ আমার!
আর যারা মারল তাদের কি হোল ? তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াল। ওটাই তো নিয়ম।
মানুষটিকে মেরে ফেলার পরও তাকে নিয়ে কথা বলা যাবে না। কিচ্ছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। এমন শত ধমকে চুপসে গেলো মৌসুমির বড় খালা। তার তিন ছেলে জলি, পলি আর কলি’র মুখ চেপে ধরল। যেন ভুলেও জিজ্ঞেস না করে, ‘আব্বা কোথায়? কবে বাড়ি আসবে’?
কেউ সেই মানুষটির কথা মনে করে ঐ রামপুরার ঝিলে একটি ফুল ও দিল না।
প্রিয় মানুষগুলো জানতে ও পারল না – তাকে মেরে ফেলার আগে কিছু খেতে দেয়া হয়েছিলো? ওরা শুনেছে সারাদিন তাকে তার অফিসে আটকে রাখা হয়েছিলো। সে কি একটু পানি পেয়েছিল? কাউকে কি দেখতে চেয়েছিল?
মৌসুমি এগুলোর কিছুই জানে না। শুধু জানে ওরই দেশের মানুষ ওর প্রিয় মানুষটিকে ওর কাছ থেকে অন্যায় ভাবে ছিনিয়ে নিয়েছে। ও বুঝল, ভাল মানুষগুলো বেশী দিন বেঁচে থাকে না ।
মৌসুমি এখন আর সেই দেশে নিঃশ্বাস নেয় না।
কিন্তু পালিয়ে এসেও কি ওর নিস্তার আছে?
বণ্ডাই বীচের শীতল হাওয়া, আর নীল পানি ওর কানে কানে বলে, ‘এখানে কোন একদিন তোমার প্রিয় মানুষটি বসেছিল। এই আকাশের নীল রঙ দিয়ে সে তার ভালবাসার কথা লিখেছিল। বলেছিল ম্যাগ্নলিয়া ফুল তার ভীষণ পছন্দ’।
মৌসুমির মনে পড়ে, কোন এক বিকেলে বড় চাচা মৌসুমি আর পলিকে নিয়ে রমনা পার্কে একটি গাছ দেখিয়ে বলেছিল , ‘এই গাছটির নাম ম্যাগ্নলিয়া। এই গাছে যখন ফুল ফুটে তখন সব পাতা পড়ে যায়’।
সেই গাছ মৌসুমি অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছে আর ভেবেছে এই অচিন দেশে কেবল সেই মানুষটির স্মৃতি আছে, মানুষটি নেই। ঐ গাছের মত। কেবল ফুল থাকে – পাতা ঝরে যায়।
মৌসুমির আরও জানতে ইচ্ছে করবে পলি কি কানাডায় ম্যাগ্নলিয়া গাছ খুঁজে? সাদা বরফ দেখে কি ওর ম্যাগ্নলিয়া ফুলের কথা মনে হয়? বড়খালা কি এখনও অপেক্ষা করে কবে তার মজনু তাকে বণ্ডাই বীচে বেড়াতে নিয়ে আসবে। বড়খালা এখন কথা বলতে পারে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
বড় চাচাকে আমি কখনও দেখিনি। শুধু শুনেছি তার উজ্জ্বল প্রতিভা আর উপস্থিতির কথা। যে মানুষটি মৌসুমিকে এমন সুন্দর হবার স্বপ্ন দেখিয়েছে সে আমার প্রিয় না হয়ে কি পারে?
আমি মৌসুমির জন্য ম্যাগ্নলিয়া গাছ কিনে এনেছি। আজ সাতই নভেম্বর। আজ মৌসুমি তার মাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে ম্যাগ্নলিয়া গাছ লাগাবে।
আজ মৌসুমির প্রিয় মানুষটির প্রিয় গাছ মৌসুমির বাড়িতে আবার বেড়ে উঠবে।
এই গাছে ফুল ফুটবে।
সাদা আর হাল্কা গোলাপির নাচন দেখব সে ফুলে।
এই ফুলগুলো মৌসুমিকে মনে করিয়ে দিবে ওর প্রিয় মানুষটির আদর আর ভালবাসার কথা।
সেই মানুষটি একদা পরম মমতা দিয়ে ওকে আগলে রেখেছিল। আর এই গাছ ওর প্রিয় মানুষ হয়ে ওকে ছায়া দিবে।
কে বলে প্রিয় মানুষটি ওর কাছে নেই?
সিডনি, ৭ নভেম্বর,২০১৪
|