|
জন মার্টিন
হ্যাঁ। ঠিক তাই। উনি ঘুমাতে গেলেন। পাতলা পায়জামা-পাঞ্জাবী পড়ে উনি ঘুমাতে গেলেন। হয়ত এই ভাবেই উনি ঘুমাতেন সব সময়। তাই সেদিন আর সেই নিয়মের ব্যত্যয় করেননি। উনি এমন করেই ঘুমাতে চেয়েছিলেন। ছেলে-মেয়েদের হয়ত বলে গিয়েছিলেন। উনার শেষ ঘুমের যাত্রাটি কেমন হবে!
মানুষ কত ভাবে তাঁদের এই শেষ যাত্রাটি পাড় করে। বিভিন্ন ধর্মে, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এই শেষ যাত্রার কত রকম ধরন আর কত রকম নিয়ম আছে। আমরা এমন একটি পরিবেশে বড় হয়েছি – যেখানে মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে নেই। যেন মৃত্যু নিয়ে কথা বললেই মৃত্যু এসে দরজায় কড়া নাড়বে। নজরুল ভাই জানতেন – জন্মের মত মৃত্যু জীবন নামের বইয়ের একটি আখ্যান। তাই মৃত্যু না হলে সেই বইটির শেষ অধ্যায়টি লেখা হবে না। মানুষের জীবনের প্রথম অধ্যায় থেকে শুরু করে অনেকগুলো অধ্যায় অন্যেরা লিখে দেয়। এই যেমন কোন ধর্মের ছায়াতলে বড় হবে, কোন স্কুলে যাবে, কোথায় থাকবে। তারপর একটু একটু করে মানুষ যখন পাখা মেলে – তখন জীবন নামের এক অসীম আকাশের সীমাহীন পছন্দের তালিকা থেকে সে একটু একটু করে নিজের পছন্দের বিষয়গুলো বেঁছে নেয়া শিখে। কিন্তু তারপরও অধিকাংশ মানুষ তাঁদের শেষ যাত্রার পরিকল্পনা করার সাহস রাখে না। তাই তাঁদের শেষ যাত্রাটি লিখে দেয় কিছু আচার,আচরণ আর নিয়ম। যে মানুষটিকে নিয়ে সেইসব আয়োজন – সেই মানুষটি জানে না তাকে নিয়ে কি হচ্ছে? কি ভাবে তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়টি লেখা হোল? কেউ জানল না সেই মানুষটি কি ঠিক এইভাবেই সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে চেয়েছিল?
নজরুল ভাই উনার শেষ অধ্যায়টি নিজেই লিখে যেতে চেয়েছিলেন। তাই হয়ত নিখুঁত ভাবে পরিকল্পনা করেছেন। শেষ যাত্রায় কোন কবিতাটি আবৃতি হবে, কোন গান বাজবে? আর সবার চোখের আড়ালে যাবার সময় কাকে বলবে, ‘আমি তোমায় ভালবাসি’।
আমার ইচ্ছে ছিল নজরুল ভাইয়ের শেষ যাত্রায় যোগ দেই। সাধ-সাধ্য আর করোনার হিসাবে আমাদের কাজে থাকতে হোল। কিন্তু হিসাব করে সময় বের করে নিলাম। তারপর স্ক্রিনে চোখ আটকে রইল। নজরুল ভাই এলেন। সারাজীবন একটি খাটে ঘুমিয়েছেন। আজ একটি বাক্সে ঘুমালেন। প্রিয়জনেরা আদর করে আস্তে আস্তে হাঁটলেন। পাছে উনার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আজ আর ঘুম পাড়ানী গান বাজেনি। বেজেছে সেতারের সুর। সেতারের রাগ আজ নজরুল ভাইকে অঘোর ঘুমে ডুবিয়ে রাখবে!
ঘুমানোর আগে ইয়াসমিন ভাবীকে বলতে ভুলেননি তাঁর প্রাণের আকুতির কথা।
‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে।
এইসব সুর হয়ত নজরুল ভাইকে জীবনের কথা বলেছে। তাই সুর দিয়ে সেই কথাগুলো বাঁধলেন। ঘুমের আগে সবার সাথে উনি কথা বলে যেতে পারেন নি। শেষ ঘুমের সময় উনাকে সেই সুযোগ দেন নি। নজরুল ভাই জানতেন হয়ত এমন হবে। সবাই কে বিদায় বলার সময় হাতে থাকবে না। ফিরে গেলেন রবি ঠাকুরের কাছে। ধার নিলেন উনার কিছু কথা তারপর বললেন-
ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল– তুলে নিল দ্রুত-রথে দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে তোমা হতে বহুদূরে।
আমরা বুঝে নিলাম- নজরুল ভাইয়ের অসহায়ত্বের কথা। কত কিছু বলার ছিল, বলা হয়নি। কিন্তু কি সুন্দর ভাবে কবি রুমিকে ভর করে আমাদের বললেন –
When I die When my coffin Is being taken out You must never think I am missing this world
Have you ever seen A seed fallen to earth Not rise with a new life Why should you doubt the rise Of a seed named human
আমার মনে পড়ল নজরুল ভাই আমাদের জন্য একটি বটগাছ ছিলেন। সেই বটগাছের শিকড় এই মাটিতে ছড়িয়ে গেছে। গাছে ফল ধরেছে, সেই ফলের বীজ ছড়িয়েছে এই অচেনা-অজানা বাতাসের দেশে। জানি এই বীজ নতুন করে নতুন গাছের জন্ম দিবে। কারণ নজরুল ভাই সেই স্বপ্ন নিয়ে ঘুমাতে গেছেন। চোখে রেখেছিলেন সেই আলো যা ছড়িয়ে দিতে ভুলেন নি। উনি আবার ফিরে গেলেন রবিঠাকুরের কাছে। আমরা শুনলাম নজরুল ভাইয়ের আকুতি।
চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে। অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে॥
তারপর নজরুল ভাই শেষ ঘুমের জন্য বিদায় নিলেন। জীবনের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা নিয়ে বললেন-
I see trees of green Red roses too I see them bloom For me and you And I think to myself What a wonderful world
I see skies of blue And clouds of white The bright blessed day The dark sacred night And I think to myself What a wonderful world
ধীরে ধীরে নজরুল ভাই আমাদের দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেন। কিন্তু উনি শেষ কথাটি বলতে ভুললেন না। মানুষটি সেই ৭০ দশকের শুরুতে অস্ট্রেলিয়া নামের একটি দ্বীপে বসত গড়েছিলেন। বাঙ্গালী অভিবাসীদের ক্যাপ্টেন কুক। কিন্তু কি এক অদ্ভুত ভালবাসায় বললেন-
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে ও মা, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।
এই গানটি শুনলে আমার চোখ ভারী হয়ে আসে। আজ আমার চোখে হু হু করে বাধন হারা জলের ঢেউ টের পেলাম। আহা নজরুল ভাই – এই ভাবে আমাকে কাঁদিয়ে গেলেন?
আমি চোখ বুজে আমার শেষ ঘুমের যাত্রাটি দেখলাম। নিজের মত করে শেষ যাত্রাটি এমন নান্দনিক ভাবে লিখে আমাকে অনেক সাহসী করে গেলেন নজরুল ভাই। নিজের বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা ভারী সাহসের কাজ। এই সাহস আরও অনেককে সাহসী করে তুলুক।
পুনশ্চ:
এই নান্দনিক যাত্রার শেষে একজন বললেন উনি কারো কাছে ঋণী থাকলে যেন উনাকে ক্ষমা করেন অথবা উনার পরিবারের সাথে কথা বলেন। আমি বলি উনার কাছে আমাদের অনেক ঋণ। সেই ঋণ শোধ করার দায় এখন আমাদের।
|
জন মার্টিন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
Share on Facebook               Home Page             Published on: 11-Jul-2021
| | |