সেই কত পুরানো কথা। আমিও একটি চাকরি পেলাম। হাতে চাঁদ পাওয়ার মত। কাজের ধরণই শুধু পছন্দ নয়, সেই সাথে আছে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ। আজ এই দেশ তো কাল ওই দেশ। বন্ধুরা আমার বিদেশ ঘুরার ভাগ্য দেখে আর আগুনে জ্বলে। পুরানো ঢাকায় একটি খেলা খেলতাম। কেউ আমাদের সামনে একা একা কিছু খেলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর মনে মনে বলতাম, 'বড় পোকা, ছোট পোকা, তোর পেটে সুঁই ফোটা।' এই মন্ত্র বার বার বললে ওই ছেলের পেট খারাপ হবে। আর তাতেই আমাদের শান্তি। একা একা খেলে এই শাস্তি পেতেই হবে। আমার বিদেশ ঘুরার ভাগ্য দেখে আমার বন্ধুরা মনে হয় বলতো, 'বড় দেশ, ছোট দেশ, এইবারই সর্বশেষ।'
আমি স্যালভেশন আর্মিতে এইচআইভি/এইডস এর উপর কাজ করতাম। সম্ভবত ১৯৯৩/৯৪ সালের দিকে। আমার কাজের উপর একটি গবেষণা করে পেপারটি জাপানে পাঠিয়ে দিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে উত্তর এলো যে ওই ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে আমার পেপারটি পড়া যাবে। শুধু তাই না - ওরা আমার থাকা- খাওয়া, এবং প্লেনের টিকেটি ও পাঠিয়ে দিচ্ছে। আহারে!! কি আনন্দ!! আমি ফন্দি ফিকির খুঁজা শুরু করলাম কি ভাবে মৌসুমীকে সাথে নিয়ে যাওয়া যায়। হানিমুন আর কনফারেন্স এর কম্বিনেশন মোটেই খারাপ হবে না।
বই খুলে পড়া শুরু করলাম। জাপান , টোকিও, কিয়োটো, হিরোশিমা। ওখানে কি আছে? হিরোশিমায় কি দেখবো? ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় বিচিত্রায় হিরোশিমার উপর লম্বা একটি লেখা পড়েছিলাম। মানুষগুলো কি ভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গ্যাছে! পড়ার সময় মনে হয়েছে - আমিও শুনছিলাম ওদের যন্ত্রণা আর কান্নার শব্দ। এটম বোমাটি কত বড় ছিল? কি দিয়ে তৈরি ছিল? কত শক্তি ছিল ওই বোমাটির? আমি একা একা মনের ভিতর ছবি বানিয়ে নেই। মানুষ পুড়ছে, মানুষের মাংস গলে গলে পড়ছে। চারিদিকে পোড়া গন্ধ। আমি হিরোশিমা যাবার জন্য তৈরি হই। কনফারেন্স শেষ করেই দৌড় দিব। ভিসা এপ্লিকেশন আর পাসপোর্ট নিয়ে জাপান এম্বাসীতে লাইন দিলাম। বুকের ভিতর লাফাচ্ছে আমার উত্তেজনা। সব কাগজ অফিসারের কাছে দিলাম। অফিসার আমার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো , 'তুমি কেন যাচ্ছ?' আমার উত্তেজনা এবার আরো বেড়ে গেলো। 'আমি শুধু তোমাদের দেশ দেখতে যাচ্ছি না , আমি ওখানে একটি পেপার প্রেজেন্ট করবো।' অফিসার মাথা তুলে তাকালো। ওর তাকানোর ভঙ্গি দেখে মনে হলো ও আমার কথা বিশ্বাস করছে না। আমি ইশারা দিয়ে আমার পেপারটি দেখালাম । 'ওই যে দেখ আমার পেপার। ওই টা পড়বো। ' অফিসার আর কিছু বললো না। হাতে একটি রিসিট দিয়ে বললো , 'দু দিন পর এসে পাসপোর্ট নিয়ে যেও। '
আমার উত্তেজনা আর থামে না। মনে হলো এখনই প্লেনে গিয়ে উঠি। হাতে তখন ও সাত দিন বাকি। মৌসুমীকে বেশি কিছু বলতে পারছিলাম না। বেচারাকে তো আর নেয়া যাচ্ছে না। সবাই বললো, 'ওকে নিতে চাইলে আর ভিসা পাবে না’। আমি ও তাই বিশ্বাস করলাম। মৌসুমীকে বললাম, 'তোমাকে পরে আবার নিয়ে যাবো। এক সাথে তো থাকবো সারা জনম।' দুদিন পর এমব্যাসিতে গিয়ে হাজির। কই? কই? আমার ভিসা কই? জানালা দিয়ে পাসপোর্ট বাড়িয়ে দিলো। আমি এক ঝটকায় পাতা উল্টালাম। প্রথম পাতা, দ্বিতীয় পাতা ..... শেষ পাতা ! নাহ, কোথাও নেই। জাপানের ভিসা নেই। একটি চিঠি আছে আর তাতে লেখা আছে, 'তোমাকে ভিসা দেয়া গেলো না। তুমি আবার এপ্লাই করতে পারো। ' হাতে আছে মাত্র সাত দিন। এর মধ্যেই আমাকে আবার সব রেডি করতে হবে। আমার বস ছিল নিউজিল্যান্ডের। খুব ভাল। তাকে সব বুঝিয়ে বললাম। সে আমার সাথে পরের দিনই জাপান এমব্যাসিতে গিয়ে হাজির। লন্ডনের হেড অফিস থেকে আমার জন্য আরো একটি জোরালো চিঠি দিল বড় বস। মৌসুমী সাহস দেবার জন্য আমাদের দলে যোগ দিলো। ওকে গাড়িতে রেখে আমি আর আমার বস ভিতরে গেলাম। আবার সেই একই অফিসার মুখ না তুলে জিজ্ঞেস করলো, 'তুমি কেন যাবে?' এবার বস ওদের বললো আমি কত ভালো এবং বিশ্বস্ত স্টাফ। লোকটি মাথা তুলে তাকালো। বলল, 'কাল এসে পাসপোর্ট নিয়ে যেও।' আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক এবার তাহলে আমার হিরোশিমা দেখা হবে।
বাক্স গুছিয়ে পরের দিন গিয়ে হাজির। মনে হোল পাসপোর্ট নিয়ে আর বাড়ি আসব না। সোজা এয়ারপোর্টে যাবো। আমাদের ড্রাইভার মাহতাব জিজ্ঞেস করে , 'স্যার চা খাইবেন?' ‘না রে ভাই। এখন চা খেয়ে সময় নষ্ট করবো না’। এমব্যাসির গেট খুললো। আমি সবার সামনে। কই? কই ? আমার পাসপোর্ট কই? একজন এসে পাসপোর্ট আমার হাতে দিলেন। আমি কি খুলে দেখবো? মনে হলো দেখার কোনো কারণ নেই। কারণ ভিসার সিলটি অবশ্যই ওখানে দেয়া আছে। এখন আমার জাপান যাবার পালা। আমি সবুজ পাসপোর্ট খুললাম। এবার শেষের পাতা থেকে দেখা শুরু করলাম। একবার, দুইবার, তিন বার। আমি কি ভুল দেখছি? নিজের চোখকে ও বিশ্বাস করছি না। আমার হাত ঘামছে। পা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমার পাসপোর্টে কোনো সিল নেই। কোনো ভিসা নেই। ওরা আমাকে ভিসা দেয় নি। কোনো কারণ নেই। ওদের ইচ্ছে হয়নি তাই দেয়নি। কাল থেকে ঈদের টানা লম্বা ছুটি। আরেকবার যে এপ্লাই করবো তার সুযোগ নেই। মানে আমার আর হিরোশিমা দেখা হচ্ছে না। হিরোশিমার ওই কান্না শোনা হচ্ছে না। হাত দিয়ে এটম বোমের আগুনে ঝলসে যাওয়া ধুলা স্পর্শ করা হচ্ছে না। আমি অফিসে এসে একা বসে রইলাম। আমার টেবিলে প্লেনের টিকেট, হোটেল বুকিং, আমার প্রেজেন্টেশন। আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম।
ঋভু আজ জাপান যাচ্ছে। বন্ধুদের সাথে ঘুরবে পাক্কা ১৫ দিন। ভোর চারটায় এয়ারপোর্টে চলে গেলো। সকাল ছ টায় ওর ফ্লাইট। সিডনি থেকে আমাদের সীমানার শেষ মাথা কেইন্স। ওখান থেকে সোজা টোকিও। সকালে কেইন্স এ পৌঁছে ও ফোন দিলো। 'বাবা ১২ টায় আমাদের ফ্লাইট। এখান থেকে সোজা টোকিও। নয় ঘণ্টা লাগবে। তোমার জন্য কি আনবো ?' আমি বললাম তোমাকে একটি লম্বা লিস্ট পাঠাচ্ছি। তোমার মেইল চেক করো।
আমি ঘরে একা বসে রইলাম অনেকক্ষণ। ঋভুকে কি আনতে বলবো ?
ঋভুর বাবা অনেকক্ষণ ভাবলো তারপর একটি চিঠি লিখলো।
বাচ্চা আমার, আমার চোখ দুটা তোমাকে দিয়ে দিলাম আমি তোমার চোখ দিয়ে দেখবো হিরোশিমা। এই নাও আমার হাত স্পর্শ করে দেখ ওই পুড়ে যাওয়া মাটি আমি এখানে বসে টের পাবো সেই পোড়া মাটির উত্তাপ। কাছে যাও। আর একটু কাছে। নিচু হয়ে বসে পোড়া মাটির গন্ধ শুকে দেখ আমিও সেই গন্ধে খুঁজে পাবো কেবল কান্না। তোমার দু চোখে ভরে দিলাম আমার চোখের জল আমার হয়ে এক ফোটা ওখানে রেখে এসো আর ওদের বলো তুমি এখানে একা নও তোমার ভিতরে বসে আছে ছোট্ট বাবা। আমি ও ওদের দেখছি মন ভারী করে তাকিয়ে আছি।
জীবনের এই এক আশ্চর্য ক্ষণ। যখন তোমার ভিতরে আমি আর আমার ভিতরে তুমি বসে থাকো।
জন মার্টিন, সিডনি
|