bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













জন মার্টিন


একঃ

নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু - একটি গল্পের বই লিখলেন। 'ঘুম নেই'। আমি বইটি কতবার পড়েছি জানিনা। মুক্তিযুদ্ধের গল্প এমন করে আর কাউকে বলতে দেখিনি। পুরো বইটি আমার মুখস্থ ছিল। কারণ ঐ গল্পগুলো নিয়ে আমি মঞ্চ নাটক তৈরি করেছিলাম। আঠারো বছরে নাটকটি একশ'র বেশী প্রদর্শনী করেছে মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়।
এই নাটক তৈরি করতে গিয়ে আমাকে বেশ কিছু হোম ওয়ার্ক করতে হয়েছিল। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলতে হয়েছে, দেখা করতে হয়েছে। আমার খুব ইচ্ছে ছিল ডাঃ জাফরুল্লাহ'র সাথে দেখা করে উনার গল্পগুলো শুনব। এই মানুষটিকে আমি কখন কাছ থেকে দেখিনি। শুধু নাম শুনেছি। সেলিম ভাই (নাট্য-গুরু সেলিম আল দিন) বলেছিলেন, 'যা উনার সাথে গল্প করে আয়।' শত চেষ্টা করেও দেখা করতে পারিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় উনার বেশ কিছু গল্প শুনেছি অনেকের কাছ থেকে। উনার সাক্ষাৎকার পড়েছি। সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নুরুজ্জামান কে আমি আঙ্কেল বলে ডাকতাম। উনার বাড়িতে আমার দীর্ঘ সময় কেটেছে। উনার কাছেও শুনেছি ডাঃ জাফরুল্লাহ'র কথা। তারপর বাচ্চু ভাইয়ের ঘুম নেই এর গল্পে আবার উনাকে খুঁজে পেয়েছি। বাচ্চু ভাই গল্পগুলো লিখেছেন। আর আমি সেই গল্পগুলো নিয়ে ঘুম নেই নাটকের সংলাপ লিখলাম। অনেকদিন পর সেই পাণ্ডুলিপি থেকে কেটে ছিঁড়ে ঘুম নেই নাটকে ডাঃ জাফরুল্লাহ'র অংশটুকু একটি কারণে জুড়ে দিলাম।



দুইঃ

ডাঃ আজিজ: (বর্ণনা) - ফিল্ড হাসপাতালের সেই সব দিনগুলো কেমন উজ্জ্বল আজো ডাঃ মোরশেদের চোখে। কি অবলীলায় ছুটে এসেছে লন্ডন থেকে ডাঃ মোবিন, ডাঃ জাফরুল্লাহ। ঢাকা থেকে এসেছে ডাঃ নাজিমুদ্দিন, মিনু, লুলু, টুলু, রেশমা, আসমা, পদ্মা, খুকু, অনুপমা- সব কৈশোর উত্তীর্ণ মেয়েরা কেমন করে কিসের ডাকে, কোন ভালবাসায় ঘর ছেড়ে, পিতা মাতাকে ছেড়ে এসেছে ফিল্ড হাসপাতালে? ওদের মত মেয়েদের ঘর ছেড়ে যুদ্ধে যোগ দেয়া আজ কি সম্ভব? হয়ত সম্ভব না। সম্ভব শুধু স্মৃতিচারণ।

গান: এই দেশ ডাকে এই মাটি ডাকে
যুদ্ধে যাবার জন্য
আঁচল দিয়ে বাঁধবে তুমি
কেমন করে ভাবলে?
স্নেহের টানে ঘরে ফিরি
স্নেহের ভয়ে ঘর ছাড়ি
শুধু একটি স্বপ্নের জন্য।

ডাঃ জাফরুল্লাহ, ডাঃ মোরশেদ তখন মেডিকেলের ছাত্র। আরও এসেছিল সামসুদ্দিন, মাহমুদ, কিরণ, ডালিয়া, লুতফর - এরা সবাই মেডিকেলের ছাত্র-ছাত্রী। সবাই কেমন করে, কিসের টানে একটি পরিবার হয়ে গেল? বাঁশের ছাপরা দিয়ে তৈরি হোল ছোট ছোট টিলার উপর হাসপাতাল। চারিদিকে লিচু আর কাজু বাদামের বাগান। স্মৃতি, স্মৃতি আর স্মৃতি । স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়ে যায় মোরশেদ।

বর্ণনা: কটি কুড়িয়ে পাওয়া অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি, হারিকেন, টর্চ দিয়ে কি নিপুণ ভাবে অপারেশন চালিয়েছে ডাঃ মবিন, ডাঃ জাফরুল্লাহ। কত মৃত্যু পথযাত্রী মুক্তিযোদ্ধা বেঁচেছে। আর কত শহীদ হয়েছে - হিসাব নেই।

ডাঃ আজিজ: এই হাসপাতালে কতজন মুক্তিযোদ্ধার হাত -পা কেটে বাদ দিয়েছি। ক্যাপ্টেন ডাঃ আক্তার যে যুদ্ধের প্রথম দিকে আঙ্গুল দিয়ে টেনে বের করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের শরীর থেকে বুলেট। ডাঃ মবিন, তুমি এখন কোথায়? মবিন পালিয়ে থাকে ইংল্যান্ডের কেন্টে। পাছে মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ উঠে এসে জিজ্ঞেস করে ঘুম নেই কেন? ডাঃ জাফরুল্লাহ এখন যখন ঢাকা -সাভারের রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেন অনবরত, ঘুম নেমে আসে চোখে। তন্দ্রার সাথে হানা দেয় ঐ সব হাত-পা।

যোদ্ধা - ১: আমার গাঁ থেকে বের করা বুলেট ফিরিয়ে দিন। ওটা আমি আমার ছেলের কাছে রাখব।
যোদ্ধা -২: আমার হাটতে ভীষণ কষ্ট হয়। আমার বা পা টা ফেরত দিন।
যোদ্ধা- ৩: আমার হাতটা দিন না। স্টেনটা জোড়ে আঁকড়ে ধরবো।
যোদ্ধা- ৪: আমার আঙ্গুল নেই কেন? আমি ট্রিগার টিপতে পারি না। আমার আঙ্গুলগুলো ফেরত দিন।
ডাঃ আজিজ: না ...। না...। না...।

গান: ঘুম নেই। ঘুম নেই আমারও চোখে
ঘুম নেই ঘুম নেই
ঘুমহীন রাত্রিতে দুচোখ চেয়ে থাকে
ঘুম নেই, ঘুম নেই
দখিণা বাতাস আর দীর্ঘশ্বাস এক হয়ে বলে
ঘুম নেই, ঘুম নেই
ওদেরও চোখে।।



তিনঃ

ডাঃ জাফরুল্লাহ যুদ্ধের পর থেমে থাকেন নি। মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গণস্বাস্থ্য গড়ে তুলেছেন। মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো যখন চড়া দামে ওষুধ বিক্রি করে পয়সা বানাচ্ছে ডাঃ জাফরুল্লাহ'র তখন দেশে ওষুধ বানিয়ে পানির দামে বিক্রি করেছেন। উনি অনেকের চক্ষুশূল হয়েছেন। এখনো উনি অনেকের হিংসার কারণ। উনাকে অনেকই যে কারণে হিংসা করেন সেই কারণেই আমি উনাকে ভালবাসি।

এই যে WHO এর রেফারেন্স দিয়ে উনার কিট নিয়ে এতো গড়িমসি চলছে, আমার জানতে ইচ্ছে করে সেই একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উনার বানানো ফিল্ড হাসপাতাল এর ব্যাপারে WHO কি রেকমেন্ডেশন দিয়েছিল? WHO কি আমাদের সেই ফিল্ড হাসপাতাল দেখতে গিয়েছিল? ডাঃ জাফরুল্লাহ'র 'বদ্ধ জানালার' বাইরে চিন্তা করেছিলেন বলেই ফিল্ড হাসপাতাল, গণস্বাস্থ্য তৈরি হয়েছিল।

আমি বলছি না কোন রকম পরীক্ষা ছাড়া উনার টেস্টিং কিট ব্যবহার হোক। এই মহামারীতে কত নিয়ম পরিবর্তন করা হোল। কত কিছু দ্রুতগতিতে করা হোল। কিন্তু হায় গণস্বাস্থ্যের টেস্টিং কিট এর পরীক্ষা আর হয় না।
অনেকেই বলে, “এই মহামারী একাত্তরের মতো। একাত্তরে যুদ্ধ জয়ী হয়েছি। এবারও জয়ী হব।“
একাত্তরের এই রেফারেন্স আমরা কথায় কথায় ব্যবহার করি। তা সে ডেঙ্গু মোকাবিলা হোক, কিংবা হোক সেটা বন্যা। সবাই একাত্তরের চেতনায় নাকি ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আমার এতে ভীষণ আপত্তি। একাত্তর এর যুদ্ধ একাত্তরেই হয়েছিল। সেই যুদ্ধে একজন নেতা ছিলেন। সেই নেতার কণ্ঠে যে তেজ আর আহবান ছিল - তাঁর ছিটেফোঁটা ও এখন কারো গলায় নেই। একাত্তরে দেশের জন্য ভালবাসা আর প্রেম ছিল। সেই প্রেম এখন লুটপাটের ভিড়ে হারিয়ে গেছে। একাত্তরে একটি ফিল্ড হাসপাতাল ডাঃ জাফরুল্লাহ আরও অনেককে নিয়ে তৈরি করেছিলেন। এখন আবার যুদ্ধ হলে, আমি নিশ্চিত উনি চাইলেও আর একটি ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করতে পারবেন না। যেমন আমরা মানিক, রুমি, আজাদ আর কিশোর টিটোর মত নাম না জানা হাজার মুক্তিযোদ্ধাও হয়তো পাব না।
একাত্তর আর দু'হাজার বিশ এক না।
আর ভাল কথা- একাত্তর কোন ছেলের হাতের মোয়া না। ইচ্ছে হলেই এখানে - সেখানে সিকি পয়সায় বিক্রি করা যায়।
ভাল থাকুন ডাঃ জাফরুল্লাহ। আপনার সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি। হয়তো হবেও না। কিন্তু আপনি আমার ভীষণ কাছের মানুষ।


জুন, ২০২০



জন মার্টিন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া




Share on Facebook               Home Page             Published on: 16-Jun-2020

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot