টনি আমার বড়দি’র বড় ছেলে। আমার বড়দি দীর্ঘ দিন নার্সিং করেছে হলি ফ্যামিলিতে। এখন অবসর নিয়েছে। তার দু ছেলেকে বড় করতে গিয়ে এই বোনটা আমার কি দুর্গম পথই না পাড়ি দিয়েছে !! ছোট্ট একটি বাড়িতে দু ছেলে টনি আর জনি কে নিয়ে ঘর করেছে। প্রতি রবিবার বড়দি আর দাদাবাবু তাদের দু ছেলেকে নিয়ে মহাখালী আমাদের বাড়িতে চলে আসত। মহাখালীতে তখন তারুণ্যের মেলা। ওখানে গান, নাটক, খেলা - কি হয়নি ? আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম - বড়দি এত কষ্ট করে মগবাজার থেকে মহাখালী কেন আসে ? আমি এখন এই ভিনদেশে যখন আমার ছেলে মেয়েকে নিয়ে কোনো রবিবারে সাতার আর নাচের ক্লাসে ঘুরাঘুরি করি আমার মনে পড়ে আমার ছেলেবেলার কথা। আমাদের ছোটাছুটির কথা। মনে পরে গেণ্ডারিয়া, নারিন্দা, লক্ষীবাজার আর মহাখালীর কথা। বড়দি ও মনে হয় তেমন ছোটাছুটির জায়গায় বড় করতে চেয়েছে টনি আর জনিকে। ছেলে দুটা বড় হলো আর বড়দি ও বুড়ো হলো। এবার ছেলে দুটির দেবার পালা। টনি নাটক করে, নাটক বানায় আর একটি জম্পেশ অফিসে বেশ হাঁকিয়ে কাজ করে। এই নিয়েই বড়দি বেশ তৃপ্তির ঢেকুর তুলতো। টনির গায়ের রং বেশ কালো। বড়দি তো কথায় কথায় বলত ' হ্যা , আমরা তো কালো, আমাদের পাত্তা দিবে কেন?'
যেন কালো ছেলের কিছু করতে নেই, কিছু ধরতে নেই, কিছু বলার নেই।
কিন্তু বড়দির সেই কালো ছেলেটি এবার একটা বেশি দারুণ কাজ করে ফেলল।
গতকাল মালালাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দিয়েছে নোবেল কমিটি। আমি বলি পুরস্কারটি আসলে দেয়া হয়েছে মেয়ে শিশুদের এবং জগতের সকল শিশুর অধিকারের জন্য। মালালার কথা বলার জন্য তিন মিনিটের একটি ভিডিও বানানো হয়েছে। যেটা নোবেল কমিটি মূল অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত করেছে। এই তিন মিনিটের ডকুমেন্টারিটির পরিকল্পনা আর নির্দেশনা দিয়েছে দুজন। একজন ইংল্যান্ডের আর একজন বাংলাদেশের। বড়দির কালো বড় ছেলে টনি সেই বাংলাদেশের একজন !! ছবিটি মূল অনুষ্ঠানে দেখানো হয়েছে, এর মধ্যেই তিনটি ভাষায় ডাবিং হয়েছে আর টনির হিসাব মত ৭২০০০ হিট পড়েছে ইউ টিউব আর ফেসবুকে।
মালালা পেয়েছে নোবেল পুরস্কার আর বড়দি কি পেল ? আমি সারাদিন এই কথাটি ভেবেছি। আমার মনে পড়েছে বড়দির মগবাজারের সেই ছোট্ট বাড়ির কথা, এক হাজার একশটি সীমাবদ্ধতার কথা। টনি আর জনি বড় হয়েছে এই নিয়ে। মালালার মায়ের বুকে যে আনন্দ, আর টনির মায়ের বুকে যে তৃপ্তি - তার মধ্যে কি কোনো তফাৎ আছে ? দুই মা পৃথিবীর দুই প্রান্তে বসে যে চোখের জলে বুক ভাসিয়েছে - সেই জলের নোনা-স্বাদ একই। আমার সকল অর্জন লাইন করে দাড় করলেও - বড়দির এই অর্জনের কাছে ভিড়তে পারব না। আমার তৃপ্তি আর আনন্দ ঠিক এখানেই। বড়দিকে আমার ফোন দিতে ইচ্ছে করলো। কেন জানি পারলাম না। আমার মনে হলো আমার চোখ আর বুক ভরা যে আনন্দ সেটা বড়দি ছুঁয়ে দিলেই জল হয়ে যাবে। আমাদের ১৩ জন ভাই বোনের বিশাল পরিবারে - অনেক সূর্যমুখী বেড়ে উঠছে। ওরা দিনভর সূর্য খুঁজে। টনি এবার একটা বড় সূর্য হয়ে উঠলো। এই সূর্যের সংখ্যা দিন দিন বাড়ুক আর আমাদের সূর্যমুখীরা সেই আলোয় বেড়ে উঠুক। টনি কে শুভেচ্ছা।
সিডনি, ডিসেম্বর, ২০১৪
|