bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন




কাছের মানুষ হারানোর কষ্ট কত গভীর? মানুষ কত দিন প্রিয়জনের জন্য কাঁদে?

এক সপ্তাহ? একমাস? এক বছর?

‘মানুষের শোকের আয়ু বড় জোড় এক বছর’ – এমন কবিতা শুনে বেড়ে উঠেছি। মনে হয়েছে – আসলেই মানুষ কতদিন আর কাঁদতে পারে? বছর ঘুরে মৃত্যু বার্ষিকীতে কবর পরিষ্কার করবে, ফকির খাওয়াবে, নিজেরা একটু প্রার্থনা করবে । ব্যস, প্রিয় মানুষকে মনে করার ‘বার্ষিক-পরিকল্পনা’ শেষ।

আসলেই কি তাই ? এর পর ও কি মানুষ কাঁদে?

-আমি প্রতিদিন আমার বাবার কথা ভাবি আর কাঁদি।

আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখি পিটারের চোখ লাল হয়ে গেছে। চোখ বেয়ে এই এখনি পানি গড়িয়ে পড়বে। আমি টিসু এগিয়ে দেই।

-আপনার বাবা কবে মারা গেছেন?

- ৫ বছর আগে। ক্যান্সার হয়েছিলো। অনেকদিন ভুগলো। বাবাকে নিজের হাতে কবর দিলাম। তার গাড়িটা বিক্রি করে দিলাম। আমার বাড়ি বিক্রি করে – বাবার বাড়িতে উঠলাম।

- বাবার বাড়ি বিক্রি না করে – নিজের বাড়ি বিক্রি করলেন কেন?

- ওই বাড়িতে যে আমি বড় হয়েছি। ওই বাড়ির দেয়ালগুলো যে আমাকে চিনে।

পিটারের চোখে আবার জলের বন্যা। আমি চুপ করে ওর কথা শুনি। ও হাত দিয়ে চোখ মুছে। পিটার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। পাঁচ মিনিট। দশ মিনিট। কিংবা তার চেয়ে ও বেশী। আমরা দুজনই চুপ করে থাকি। এর নাম মনে হয় পিনপতন নিস্তব্ধতা। কোন কথা না বলেও যে কত কথা বলা যায়। আমি পিটারের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনি। নাকি নিঃশব্দ কান্না?

পিটার নিজেকে সামলে নিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এক গ্লাস পানি দিব’? পিটার মাথা নেড়ে জানাল, পানির দরকার নেই।

একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ‘আমি বাড়িটার কিছু পরিষ্কার করতে পারি না। কিছু ফেলতে পারি না।

- কেন ?

- সব কিছুর সাথে যে আমার বেড়ে উঠার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কোনটা ফেলব?

-বাবার ঘরটা কি ওই রকমই আছে?

- হ্যাঁ। বাবা যেমন রেখে গিয়েছিলেন।

- বাবার খাটে আপনি ঘুমান?

- হ্যাঁ। প্রতি রাতে আমি বাবার বিছানায় ঘুমাই। এই বিছানায় আমি বাবার সাথে ছোটবেলায় কতবার ঘুমিয়েছি। এতবছর পর আমি যখন প্রথম রাত ওই বিছানায় বাবা ছাড়া শুয়েছি – আমার ঘুম আসেনি। আমার মনে হয়েছে সেই ছোট বেলায় বাবার সাথে কি গল্প করতাম?

- আপনার বাবা বুঝি গল্প বলতো?

আমি আরো আগ্রহ নিয়ে পিটারের কথা শুনি।

- বাবার ঘরের এক কোনায় একটা বড় মাকড়সার জাল ছিল। বাবা আর আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ওই মাকড়সার জালে ফুঁ দিতাম । আমাদের বাজি হতো কে বিছানায় শুয়ে ওটাকে নড়াতে পারে।

- বাহ বেশ মজার খেলা তো?

- পনের বছর পর বাবার বিছানায় শুয়ে দেখলাম সেই মাকড়সার জাল – এখনও আছে। বাবা ওটা ভাঙ্গে নি। এই পনের বছর যখন আমি ছিলাম না, বাবা কি একা একা বিছানায় শুয়ে ওই মাকড়সার জালের সাথে খেলেছে? আমি একা বিছানায় শুয়ে কতবার সেই জালে ফুঁ দিলাম। মাকড়শার জাল নড়ে উঠল। কেবল বাবার হাসি শুনলাম না।

পিটার চুপ করে রইলো।

জগতের বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’আপনার বাবা পনের বছর ধরে ওটা রেখে দিয়েছিল’?

পিটার বলল, ‘আমিও তো ওটা রেখে দিয়েছি’। আমি পিটারের কথা বুঝলাম না, ‘ আপনি কি করেছেন’?

- বাবা মারা যাবার পর বাবার ঘরটি রঙ করেছি। কিন্তু ওই মাকড়সার জালের কোণাটি ঠিক তেমন রেখেছি। ওখানে রঙ করিনি। প্রতিদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফুঁ দিয়ে ওই জালটি নাচাই। আমি জানি বাবা ওটা দেখে আর মিটি মিটি হাসে।

অনেকক্ষণ চুপ করে পিটারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। পিটারের চোখ লাল হয়ে আছে। একবার ও বলল না , ‘চোখে ময়লা পড়েছে’। সারা মুখে কি আনন্দ। পিটার বাবার জন্য কাঁদছে। ভালবাসার কান্না এমনিই হয়। চোখ দিয়ে পানি পড়ে, কিন্তু মনের কোথায় যেন শান্তি খুঁজে পায়। ভালবাসার শান্তি। আস্থার শান্তি।

আমি রাতের অন্ধকারে গাড়ি চালাতে গিয়ে ভাবি – শোকের আয়ু কতদিন?

আমার বাবার কথা মনে পড়ল। বাবা খুব কম বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন সেই চল্লিশ বছর আগে। আমি তখন ছোট। শোকের অর্থ কি ? সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে কান্না ? ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে চিৎকার করা? আমার কাছে শোক মানে হয়তো তাই ছিল। বাবা যেদিন মারা গেলো, সবার সাথে আমিও সেদিন খুব কাঁদলাম। কত মানুষ এসেছিল! আমার মত তার ছাত্ররা ও দেখলাম কাঁদল। আমার বাবা কি ওদের ও বাবা ছিল? ছোট্ট মনে কত প্রশ্ন !

তেজগাঁয়ে বাবার শরীরটা যখন মাটির নীচে নামাচ্ছিল, কেবল তখনি মনে হয়েছিল এই মানুষটিকে আমি আর দেখব না। আমার ভীষণ কান্না পেয়েছিলো। আমি টের পেলাম, আমাকে আর জোড় করে কাঁদতে হচ্ছে না। কোথা থেকে আমার দুচোখ পানিতে ভরে গেছে। আমি কত চেষ্টা করলাম –যেন আমার চোখের পানি কেউ না দেখে। ব্রাদার হোবার্ট ছিলেন আমার একজন প্রিয় শিক্ষক। আমার চোখের পানি কি উনি দেখতে পেয়েছিলেন? বাবার শরীরটা যখন মাটির একদম নীচে নামিয়ে দিয়ে ওরা উপরে উঠে এলো, আমার বিশ্বাস হয়নি বাবা ওখানে একা শুয়ে থাকবে। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। আমি মুখ ঘুরিয়ে কবরের সামনে থেকে সরে যেতে চাইলাম। একবারও টের পাইনি আমার পিছনে ব্রাদার হোবার্ট দাঁড়িয়েছিলো। উনি আমাকে পালাতে দিল না। জাপটে ধরল আর কোথা থেকে সব কান্না এসে প্রিয় শিক্ষকের কাঁধ ভিজিয়ে দিল। ব্রাদার হোবার্ট পরম মমতা ভরে আমার পিঠে হাত দিয়ে বলল, ‘অল অয়েজ রিমেম্বার, ইয়র ড্যাড ওয়াজ এ গুড ম্যান অ্যান্ড হি ওয়াজ এ গ্রেট টিচার’।

এই গল্পটি আমি ঋভুকে অনেকবার বলেছি। আর সেদিন পিটারের গল্প শুনে ঋভুকে নতুন করে বললাম , ‘বাবা, আই থিংক আই এ্যাম গ্রিভিং’।

‘তুমি কার জন্য গ্রিভ করছ’? ঋভু অবাক চোখে আমার দিকে তাকায়।

তোমার দাদাভাইয়ের জন্য। মনে হয় আমি তখন তোমার দাদাভাইয়ের জন্য কাঁদিনি। আর এখন মানুষের এতো কান্নার গল্প শুনে আমার জমে থাকা কান্না গুলো চোখে জমা হচ্ছে।

উনিশে পা দেয়া ছেলে আমার কি বুঝল জানি না। ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমিও অনেকক্ষণ ঋভুকে জড়িয়ে ধরে রইলাম। কিন্তু আমার বুকের মধ্যে তখন এক শূন্যতার রাজ্য ভর করল। বার বার মনে হোল –এতো বছর পর কোথা থেকে এই সব উথাল-পাতাল অনুভূতি এসে জড়ো হোল?

আমি রাত জেগে – গ্রিভিং এর উপর রাজ্যের গবেষণা দেখি। বিস্মিত হই নতুন করে শোকের এই জগতের কথা জেনে। মানুষ কত ভাবে তাদের শোকের গল্প বলে । এই গল্প বলা ৩০ বছর পরও কেউ নতুন করে বলতে পারে? আমার ভিতরে আমি উত্তেজনা অনুভব করি। সত্যি তাই ? মানুষ ত্রিশ বছর পর ও তাদের লুকিয়ে থাকা শোকের কোথা বলতে পারে ? তাহলে আমার শোকের গল্পটি কি ? শোকের শুরু আছে। শেষ কি আছে? নাকি বয়ে বেড়াই অনাদিকাল?

আমি তাকিয়ে দেখি ঋভু আর ঋষিতার বেড়ে উঠার গল্প। ওগুলো আসলে আমারই গল্প। আমার পাওয়া না পাওয়ার গল্প।

ঋভু ছিল ‘দি মনভোলা মাস্টার’। স্কুলের প্রেজেন্টেশন, ওর স্পীচ, বাড়ির কাজ, লাইব্রেরীর বই থেকে শুরু করে এহেন জিনিষ নেই যে ও বাড়িতে ফেলে যায়নি। তারপর স্কুলে গিয়ে ফোন, ‘বাবা, আমাকে একটু হেল্প করতে পারো’? আমি মনে মনে বলি, ‘বাছারে,আমি তো এই হেল্প করার জন্যই সেই সকাল থেকে বসে আছি। বল কি করতে হবে?’ ও জেনে গেছে বাবাকে বললেই হবে। ঝড়, বৃষ্টি, ভূমিকম্প, আগুন – কোন কিছুই ওর বাবাকে আটকাবে না। বাবা ঠিকই ওর কাছে হাজির হবে।

ঋষিতাও কম যায় না। এগারটায় স্কুলে ওর বক্তৃতা, আর দশটায় স্কুল থেকে ফোন, ‘তোমার মেয়ে তোমার সাথে কথা বলবে’।

আমি তখন কাজে। ভাবি কি জানি কি হয়েছে? ঋষিতা মিষ্টি গলায় বলে, ‘বাবা, আমার পাম কার্ডগুলো কি আমার টেবিল থেকে নিয়ে আসতে পারো’?

‘পারি, পারি, পারি রে মা। তুমি বলেছ আর বাবা করবে না’ ?

ঋষিতার চোখে জগতের আনন্দ, ‘আমার বাবা চ্যাম্পিয়ন’।

এই ভাবেই আমার বাচ্চা দুটা বড় হয়েছে আর আমি বুড়ো হয়েছি। আর বুড়ো হওয়ার সাথে সাথে টের পেয়েছি আমার বাবার সাথে আমার পূর্ণতার আর শূন্যতার তফাৎ ।

আমার বাবা ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। তেরজন ভাইবোনের আবদারের তো আর শেষ নেই। বাবা সেই সকালে চলে যেতেন টিউশনি করতে। আমরা তখনও বিছানায় গড়াগড়ি দিতাম। কিন্তু বাবার সেই সুযোগ নেই। উনি সেই সকাল থেকে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। সকালের টিউশনি শেষ করে বাড়িতে নাস্তা খেতে আসতেন। তারপর শুরু করতেন স্কুল। স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে আবার সেই টিউশনি। বাড়ি ফিরতেন অনেক রাতে।

আমার বাবা কেমন শিক্ষক ছিলেন? ছোট্ট একটি গল্প বলি।

সেই ছোট বেলা থেকে দেখেছি, তার ছাত্ররা বাবার খবর নিতেন। আমাদের দেখলেই জিজ্ঞেস করতো, ‘ আমাদের স্যার কেমন আছেন’? সবচেয়ে অবাক হয়েছি সেই ১৯৭১ সনে। আমি তখন খুব ছোট। যুদ্ধের জন্য আমরা তখন দিদিমার বাড়িতে। ওখানে যুদ্ধ নেই। দিদিমার ছোট্ট বাড়িতে আমরা সবগুলো ভাইবোন গাদাগাদি করে ঘুমাতাম। কারো কোন অভিযোগ নেই। বাবা, মেজদা আর বড়দা তখন ঢাকায় থাকতো। বাবা ২ সপ্তাহ পর পর আমাদের কাছে আসত। বাবা গ্রামে আসা মানে ঢাকার বিস্কুট আর চানাচুরের গন্ধ।

ডিসেম্বরের এক গভীর রাতে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দিদিমার উঠানে মানুষের আনাগোনা। অনেকগুলো মানুষের গলার স্বর। আমরা ঘুম মাখা চোখে বাইরে এলাম। দেখি বাইরে অনেক মানুষ। কারো হাতে বন্ধুক, কারো হাতে মেশিনগান। এরা কারা? এখানে কি করছে? আমাদের বাড়িতে কি মিলিটারি এসেছে? আমি ভয়ে কুঁচকে গেলাম। মোটা কাঁথা থেকে মুখ বেড় করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওরা কারা? কি করছে? আমাদের ধরে নিয়ে যাবে’?

‘দূর, ওরা বাবাকে দেখতে এসেছে’।

আমি বুঝলাম না। এই রাতে ওরা বাবাকে কেন দেখতে আসবে? ওরা কি বাবাকে ধরে নিয়ে যাবে? আহা , বাবা ঢাকা থেকে কেন আমাদের দেখতে এলো? আমাদের বিস্কুট, চানাচুরের দরকার নেই। বাবাকে ধরে নয়ে গেলে আমাদের কি হবে?

আমার কানে কানে কে যেন বলল, ‘এরা মুক্তিবাহিনী’।

আমাদের গ্রামে যেন শোরগোল শুরু হয়েছে। ‘ওই মুক্তি আইছে’। ফেনু মামার ঘরে সবাইকে ঘুম থেকে উঠিয়ে, সব মুক্তিযোদ্ধাদের বসতে দিল। দু’তিন জন বন্দুক নিয়ে বাইরে নজর রাখছিল।

সেই রাতে মুরগীর খোয়ার খুলে মুরগী জবাই হোল, রান্না হোল, আর মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ান হোল।

আমরা কয়েকজন অতি উৎসাহী বালক খুব কাছ থেকে দেখছিলাম, মেশিনগান। ওগুলো দেখতে কেমন? কোনটা ট্রিগার? কয়টা গুলি থাকে? ওগুলোর রঙ কেমন? এগুলো দিয়ে কি ঢিসুম ঢিসুম করে পাকিস্তানী মারে?

খাবার শেষে সবাই দিদিমার বাড়ির উঠানে এলো। বাবা ওখানে বসে ছিল। ওদের দলের লিডার বাবার কাছে এলো। বাবার পা ধরে সালাম করল।

‘স্যার আপনি এখানে আছেন জানতাম না’।

বাবা আদর ভরা গলায় জিজ্ঞেস করলও, ‘তোমরা কোথা থেকে আসলে আর যাবা কোথায়’?

লিডার সঙ্কোচে জড়িয়ে যায়। ‘স্যার, যুদ্ধের প্ল্যান তো বলা যাবে না। আমরা এদিক দিয়ে নৌকা নিয়ে যাচ্ছিলাম। আপনাদের বাজারে থেমেছিলাম কিছু খাবারের জন্য। একজন বলল আপনি এখানে আছেন। আপনার দোয়া নিতে এসেছি। আমাদের দোয়া করবেন’।

বাবা জিজ্ঞেস করলও, ‘দেশ স্বাধীন হবে কবে’?

লিডার বলল, ‘আর বেশী দিন বাকি নাই স্যার। খুব শিঘ্র আমরা স্বাধীন হবো’।

আমি অবাক হয়ে ওই লিডারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই লিডার আমার বাবার ছাত্র? বাবাকে এই গভীর রাতে দেখতে এসেছে?

মুক্তিযোদ্ধারা ভোর হবার আগে চলে গেলো।

আমি বিছানায় শুয়ে কি ঘুমিয়েছিলাম? নাকি ভেবেছি মেশিনগানের রঙ কেমন? ট্রিগার কোনটা? গুলি কোনদিকে দিয়ে ভরে ? আর কিভাবে ঢিসুম ঢিসুম করে পাকিস্তানী মারে?

পরের দিন দিদিমার উঠানে আবার মানুষের ভিড়।

আবার কি মুক্তিযোদ্ধারা এলো? এবার গ্রামের মানুষ বাবাকে দেখতে এলো। বাবার ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা, এটা কি কম কথা? বাবা দিদিমার বাড়ির উঠানে একটা চেয়ার নিয়ে বসে ছিল আর তার চারিদিকে মনে হয় পুরো গ্রামের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বাবাকে কত প্রশ্ন করল?

‘অরা কি কইল’?

‘ও মাস্টার, দ্যাশ কি স্বাধীন হইব’?

‘আপনের ছাত্র কেমুন ফাইটার’?

বাবার সেদিন কেমন লেগেছিল? আমার বেশ লাগলো। মনে হোল পুরো গ্রাম বাবার ক্লাসরুম আর বাবা ওদের পড়াচ্ছে। আমার মন তখন সেই লিডারের সাথে। তার দল এখন কোথায় যাচ্ছে? আমি মনে মনে লিডারকে বুদ্ধি দেই- মেশিনগান কি ভাবে লুকিয়ে রাখতে হবে, কি ভাবে যুদ্ধ করতে হবে? আমি যেন ওই লিডারের টিচার। ওই লিডারের সব প্ল্যান জানি। আমার বালক বন্ধুরাও মন দিয়ে আমার কথা শুনত।

দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা আবার সেই নারিন্দার বাড়িতে ফিরে এসেছি। পত্রিকায় কত মুক্তিযোদ্ধার ছবি দেখেছি। আমি কেবল খুঁজেছি সেই লিডারকে। আমার বাবার ছাত্র। আমি তো তার নাম জানি না। অনেক বছর পর, অনেক বড় হয়ে জেনেছি, রাতের অন্ধকারে দেখা সেই লিডার এর নাম মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। যিনি যুদ্ধের নিয়ম ভেঙ্গে কেবল তার শিক্ষককে গভীর রাতে দেখতে এসেছিলেন। উনি এখন অনেক বড় রাজনৈতিক নেতা।

বাবাকে সেদিন আকাশের মত বড় মনে হয়েছিলো। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল বাবা আমার কত বড়? বাবাকে আর ছুঁয়ে দেখা হয়নি। বাবা তো তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন। ঋভু আর ঋষিতা হাত বাড়ালেই যে ভালবাসা আর আস্থার ছোঁয়া খুঁজে পায়, আমিও হাত দিয়ে সেই স্পর্শ খুঁজি, কিন্তু ধরতে পারি না। খুব ইচ্ছে হয় সব ছেড়ে বলি, ‘ঝড়, বৃষ্টি, ভূমিকম্প, আগুন – যাই থাক, আমার বাবা ঠিকই আমার জন্য বসে থাকবে’। মন ভাবে, মন বলে – এটাই হবার কথা। আমি জানি এ হবার নয়। আমার কি ঋভু আর ঋষিতার ‘বাবা ভাগ্য’ দেখে হিংসা হয় ? আমার এমন বাবা নেই কেন ? আমি কেন চোখ বুজে পাহাড় থেকে লাফ দিতে পারি না? কেন ভাবতে পারিনা বাবা আমাকে ঠিকই আগলে ধরবে? আমি সিডনির পুরানো দোকান খুঁজে খুঁজে টাইপ রাইটার কিনি, হাতে চাবি দেয়া বড় ঘড়ি কিনি। বাবা আমাদের টাইপ রাইটার দিয়ে ইচ্ছে মত টাইপ করতে দিত, বড় দেয়াল ঘড়ির কানমলা দিয়ে চাবি দেয়ার সময় আমাদের ডাক দিত। আমরা বাবাকে ঘিরে বসতাম। আমিও এখন ঘড়িতে চাবি দেবার সময় ঋষিতাকে ডাক দেই। বাবার মেট্রিক আর গ্রাজুয়েশন এর সার্টিফিকেট আমার দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখি। তারপরও কি বাবাকে স্পর্শ করতে পারি ?


পরের অংশ

জন মার্টিন, সিডনি - probashimartins@gmail.com





Share on Facebook               Home Page             Published on: 2-Sep-2015

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far