ঈদ মানে – আজ মেজদির বাড়িতে যাব আমরা সবাই। মেজদি আজ সকাল থেকে আমাদের জন্য খিচুরি রান্না করবে, সাথে থাকবে ঝাল গরুর মাংস। খাবার শেষে থাকবে নানা রকমের সেমাই। দুপুরে গেলেও – আসার সময় মেজদি কত বাহানা করবে – যেন রাতেও খেয়ে যাই। সাথে যোগ দিবে সুমি আর ঊর্মি। ওদের তখন কত বায়না।
-‘মামা বসেন না। আমাদের বাড়িতে তো আসেনই না’।
আসলেই তো তাই। হিসাব কষি – কবে মেজদির বাসায় এসেছিলাম । হিসাব মিলাতে বেশী কষ্ট করতে হয় না । ওই যে দুই ঈদ – ওটা আমাদের শিয়র টার্গেট । সেদিন মেজদির বাসায় না গেলে আমাদেরই লস । অমন খিচুরি আর মাংস জগতে আর কেউ রান্না করে কিনা জানি না । কারণ মেজদি সেদিন কেবল তার ভাইবোনের জন্যই রান্না করে। তার বাড়িতে আর কে এলো, কে খেল – সেটা মেজদির হিসাব নয়। তার ভাইবোনেরা এলো কিনা সেটাই আসল। প্রতি ঈদে এটাই আমাদের হিসাব। সারাদিনে যেখানেই ঘুরি, যাই করি না কেন, ওই বাড়িতে যে একবার আমাদের যেতেই হবে। নতুবা মেজদি অপেক্ষা করবে।
এই আমাদের মেজদি। আমাদের তের জনের একজন। মেজদির এক অদ্ভুত শখ ছিল। চিত্রালীর পাতা কেটে প্রিয় নায়ক-নায়িকার ছবি দিয়ে পুরানো বিজ্ঞানের প্র্যাকটিকেল খাতায় ভাত লাগিয়ে নিজের গল্প বানাত। আমরাও সেই খেলায় যোগ দিতাম। বিভিন্ন সিনেমার নাম গুলো এক করে একটা গল্প বানাত। আমার মনে পড়ে একটি লাইন, ‘নীল আকাশের নীচে, পীচ ঢালা পথে, কে তুমি, আগন্তুক? দস্যু বনহুর নাকি মাসুদ রানা?’ মেজদির এই সৃজনশীল চিন্তা আমাকে তার শিষ্য বানিয়ে ফেলল। বাংলা সিনেমার পোকা ছিল সে। কিন্তু সিনেমা হলে গিয়ে সবগুলো সিনেমা দেখার জো কথায়? সাধ আর সাধ্য বলে একটা কথা আছে না? তবে মেজদির এই শখের অর্ধেকটাই মিটত ববিতার সাথে কথা বলে। গেণ্ডারিয়াতে আমাদের বাড়ি আর সুচন্দা-ববিতার বাড়ির পাঁচিলের উচ্চতা ছিল হাঁটুর অর্ধেক । সেই অল্প উচ্চতার কারণেই হোক বা পাশাপাশি থাকার কারণেই হোক – আমার বোনদের সাথে ওদের বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল। আমাদের দোতালা বাড়ির রান্না ঘরের জানালা দিয়ে সিনেমার কত ‘স্টার’ দের দেখেছি। জহির রায়হান, রওশান জামিল, বেবী জামান। ওদের মা যখন মারা গেল – তখন সারা দিন-রাত আমরা ওই রান্না ঘরের জানালায় কাটালাম। এক সাথে এতো স্টার কে কোন জন্মে দেখেছে? কতদিন আমরা ছাদে দাড়িয়ে অপেক্ষা করেছি সুচন্দা কখন শুটিং শেষ করে ফিরবে? চম্পা তখন অনেক ছোট। অতএব আমাদের সাথে না খেলে ওর উপায় কি ? আমার বেড়ে উঠার স্মৃতিতে চম্পার সাথে খেলার কত কথা ! দেশ ছাড়ার আগে – এক ব্যাঙ্কের এটিএম বুথে চম্পার সাথে দেখা। বুথের ভিতরে কেবল চম্পা আর আমি। একবার মনে হোল আমার পরিচয় দেই। খুব ইচ্ছে হোল ওর সাথে কথা বলি। আমি চম্পাকে কিছু বলতে পারলাম না।
মৌসুমিকে ঘটনাটি বলতেই ও জিজ্ঞেস করল , ‘তুমি ওর সাথে কথা বলনি কেন? বলতে যে তুমি তার সেই ছোট বেলার খেলার বন্ধু।’
আমি মৌসুমিকে উত্তর দিতে পারলাম না।
আমার মনে হয়েছিল – যদি আমার কথা ওর মনে না থাকে? যদি ভাবে আমি একটা ক্যাবলা ? নায়িকার সাথে কথা বলার জন্য বাহানা করছি? আমি সেদিন চম্পাকে কিছুই বললাম না। শুধু অপেক্ষা করলাম। ও টাকা তুলে বেড়িয়ে গেল। তারপর আমি টাকা তুললাম। কিছুক্ষণ সেই বুথের ভিতর একা একা দাড়িয়ে আমার বেড়ে উঠার স্মৃতির সাথে কথা বললাম। মন ভারী হয়ে উঠল। প্রবাসী হবার প্রথম শর্ত হোল – ছোটবেলাকে বিদায় দিয়ে বড়বেলার সাথে নতুন করে বন্ধুত্ব করা। সেদিন কি আমার ছোটবেলার স্মৃতিকে বিদায় জানানোর জন্য জগত এমন আশ্চর্য আয়োজন করেছিলো ?
গত কয়েক বছর আগে সুচন্দা-ববিতা-চম্পা সিডনিতে এসেছিল। আমার আবার ও ভীষণ ইচ্ছে হয়েছিল ওর সাথে গিয়ে কথা বলি। এবার ও বলা হয়নি। মেজদিকে ঘটনাটি বলেছিলাম।
-‘দূর, আমার কথা বললেই তো হতো’। মেজদি বলল ।
কি জানি, হয়ত বললে হতো। দেখি ওরা আবার কবে সিডনি আসে। এবার আর মিস করা যাবে না ।
ওদের কারণেই হোক বা মেজদির নিজের ঝোঁকের কারণেই হোক, আমরা মেজদির সাথে সিনেমা সিনেমা খেলতাম। আমাদের একটা হারমোনিয়াম, একটা গিটার আর একটা একরডিয়ান ছিল। মেজদা নিয়ে এসেছিল। আমরা ওগুলো বাজাতে পারতাম না । তাতে কি ? মেজদি প্রায় সন্ধ্যায় আমাদের জন্য বিচিত্রানুষ্ঠান করত। আমি, রনি, রিনা, ছবি, বিনা ছিলাম গানের শিল্পী। ঘরের লাইট বন্ধ করে – টেবিল ল্যাম্প এর শেডের গোল ফোঁকা দিয়ে আমাদের মুখে লাইট দিয়ে মেজদি ঘোষণা দিত, ‘এখন গান গাইবে আমাদের জনপ্রিয় শিল্পী রুনা লায়লা’। আমরা হাততালি দিতাম। আমাদের ছোট বোন বিনা, রুনা লায়লা সেজে গান গাইত। আমি ছিলাম আব্দুল জাব্বার। কি গাইতাম তা ঈশ্বর জানে। তবে মেজদির মুখ দেখে তো মনে হতো দারুণ গান গেয়েছি। গলার সাথে হারমোনিয়াম মিলত না, গিটারের তার ছিঁড়ে যেত। তাতে কি ? শো মাস্ট গো অন ।
এই ছিল আমাদের প্রায় প্রতি রাতের খেলা। এই করতে করতে আবিষ্কার করলাম – আমি হারমোনিয়াম বাজাতে পারি। আমি গানও গাইতে পারি। পাড়ার কচিকাঁচার অনুষ্ঠানে হারমোনিয়াম বাজিয়ে একা একা গান ও গাইলাম। আহারে, আমার আনন্দ কে দেখে সেদিন ! মেজদি আমাকে রবিঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটি শিখালো। হাত, মুখ, চোখ নেড়ে কি ভাবে অভিনয় করে আবৃতি করতে হয় শিখে নিলাম। পাড়ায় এবার সেই কালো ছেলেটির কদর বেড়ে গেল। এখানে সেখানে কালো ছেলের ডাক পড়ে। ছেলেটি গান গায়, আবৃতি করে আর হাতে একটা দুটা পুরষ্কার নিয়ে আসে। কালো ছেলের নাম বদলে হয়ে গেল ‘বীরপুরুষ’। আহা ! সেই সুখ দেখে কে ?
সেই কবিতা আমার এখনও মনে আছে। আমি ঋভু আর ঋষিতাকে শুনিয়েছি কত দিন, কত রাত। আমার আবৃতি আর অভিনয় শুনে ঋভু- ঋষিতার ঘুম পালায়।
মৌসুমি বকা দেয়, ‘এই ঘুমের সময় ওদের এমন উত্তেজিত না করলে তোমার হয় না ?’
আমি মৌসুমিকে কি করে বুঝাই, এই উত্তেজনা ঋভু- ঋষিতার না। ওটা আমার উত্তেজনা। আমার শৈশবের উত্তেজনা। নিজেকে আবিষ্কারের উত্তেজনা। আর এই কাজটি মেজদি পরম যত্নের সাথে করেছে। আমি যখন ঋষিতাকে বীরপুরুষ শুনাই – আমার মন উড়ে যায় নারিন্দার সেই বাড়িতে, সেই বারান্দায়, সেই ছাদে, সেই ছাদের সিঁড়িতে – মেজদি কোন এক অলস দুপুরে আমাকে লাইন ধরে ধরে শিখাচ্ছেঃ
‘এমন সময় , হাঁরে রে রে রে রে রে , ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে। তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোনে ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে’।
বাবা মারা যাবার পর আমরা একটা বড় ঝড়ের ভিতর দিয়ে গিয়েছি। কোথায় যেন সুতোটা ছিঁড়ে গিয়েছিল । সব আছে আবার যেন কেউ নেই। আমাদের ঘরের অবস্থা ও তেমন ভালো নয়। মেজদি একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করত। রূপসী বাংলা । সেই সকালে যেত আর ফিরত সন্ধ্যায়। কোন কোন মাসে বেতন পেত না। মেজদি টাকা দিয়ে কি করত ? বাংলা সিনেমা দেখত? হয়ত ইচ্ছে হতো। কিন্তু উপায় কোথায়? বাড়িতে যে অনেকগুলো ভাই বোন আছে। সেই ভাইবোন গুলোর ক্ষুধার্ত মুখ আছে, আছে মনের ভিতরে লুকিয়ে থাকা শখ। মেজদি কি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল? আমরা তো কখনও তাকে জিজ্ঞেস করিনি, ‘তুমি কেমন আছ?’
মেজদি মনে হয় ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই একদিন আমাদের কাউকে কিছু না বলে প্রিয় মানুষের হাত ধরে চলে গেল। আমরা জানতাম। আবার জানতাম ও না। মেজদির কথা ভাবতাম, কিন্তু কিছু বলতাম না। পাছে মা আবার কষ্ট পায়। আমরা কেমন যেন চুপসে গেলাম। মনে হতো সবাই আমাদের খারাপ বলছে। রাস্তায় হাটার সময় কোন দিকে তাকাতাম না। বন্ধুদের সাথে কথা বলতাম না। কিন্তু মেজদি কি দোষ করেছে? নিজের পছন্দের মানুষের সাথে সংসার করেছে? দোষের কি হোল?
সপ্তাহ না যেতেই মেজদি খবর পাঠালও কোথায় আছে। আমি আর রবিন (নাকি রনি) বাড়ির কাউকে কিছু না বলে মেজদির বাসায় গেলাম। মেজদির নতুন বাড়ি। নতুন খাট, নতুন বালিশ, নতুন চাদর। একটা ছোট শো কেশ। এখনও সবগুলো তাক সাজান হয়নি। আমরা ছোট দুটা টুলে বসলাম।
-‘কিছু খাবি?’ মেজদি জিজ্ঞেস করল।
আমরা দু’ভাই – একজন আরেক জনের দিকে তাকালাম। কিছু কি খাব? যদি বাড়িতে জেনে যায়? যদি মা বকা দেয়?
-‘কি খাবি?’ মেজদি আবার জিজ্ঞেস করল।
-‘আরে অগো জিগাও ক্যান? বিস্কুট গুলি খাইতে দেও’। ইউসুফ ভাই যেন আমাদের বাঁচিয়ে দিলো। ইউসুফ ভাই মেজদির পছন্দের মানুষ। তার হাত ধরেই নতুন সংসার শুরু করেছে।
কাঁচের বয়াম থেকে নানা রকমের বিস্কুট বেড় করে সামনে দিলো। আমি অবাক হয়ে বিস্কুট গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। বিস্কুটের উপর কি সুন্দর বাদাম ছড়ান। পুড়ে আরও বাদামি হয়েছে। এইগুলো ওই বেকারির শো–কেসে সাজান দেখি। কত খেতে ইচ্ছে করেছে, কিন্তু খেতে পারিনি। মেজদি এই কথাটা জানল কি করে ?
রাস্তায় বেরুনোর সময় হাতে বিস্কুট গুঁজে দিয়ে বলল, ‘রাস্তায় হাটতে হাটতে এগুলো খাইস’।
এরপর মেজদির বাড়িটা হোল আমার বিস্কুট খাবার জায়গা। তা ও আবার চুপি চুপি।
আমাদের বাড়িতে অনেকদিন একটা ভারী মেঘ জমে ছিল। মেজদিকে নিয়ে কথা বলতাম না, যেন আমরা তাকে চিনি না। আমাদের জমে থাকা ভারী মেঘটা হালকা করল মেজদা। বিদেশ থেকে প্রথমবার যখন এলো, নিজেই মেজদি আর ইউসুফ ভাইকে বাড়িতে নিয়ে এলো। আমাদের কাছের মানুষগুলো খুব অবাক হয়েছিল। আমার ছোট পিসী তো পারলে আমার মাকে পাটা-পুতা দিয়ে ডলা দিত। মেজদা সব কিছু না দেখার ভান করে দুজনকে বাড়িতে নিয়ে এলো।
মেজদি আর ইউসুফ ভাই যেদিন প্রথম এলো, মা সেদিনও ভীষণ কেঁদেছিল। হয়ত ভেবেছিল মেজদা কেন আরও আগে ওদের বাড়িতে নিয়ে আসেনি। ইউসুফ ভাই আমাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠল। মেজদি আবার সেই আগের মেজদি হয়ে উঠল। তার কোল জুড়ে এলো সুমি আর ঊর্মি । মেজদি স্কুলে চাকরি করে, টিউসুনি করে, অনেক চরাই উৎরাই পার করে মেয়ে দুটাকে বড় করল। তার যখন সব দায়িত্ব শেষে আকাশে পাখা মেলে উড়ার কথা, তখনি ইউসুফ ভাই সব ছেড়ে চলে গেল। ভীষণ একা হয়ে গেল মেজদি। মেজদির আর হোল না ভালো থাকা। এখন যখন ফিরে তাকাই, মনে হয় আমি মেজদির মনের খবর কখনও নেই নি। কখনও জানা হয়ে উঠেনি, সব ছেড়ে, যে জীবন তুমি শুরু করেছিলে, কেমন ছিল তোমার সেই জীবন? তোমার সাথে একা বসে কখনও জানা হয়নি তোমার জীবনযাপন। তোমার কালো চুল কবে সাদা হোল- খেয়াল করলাম না। তোমাকে তো আমার সেই মেজদি মনে হয় যে আমাকে বীরপুরুষ বানিয়েছিল। তুমি ভালো ছিলে? নাকি ভাইবোনদের কথা ভেবে কখনও মনের কথাটি খুলে বলনি ? পাছে তোমার ভাইবোনদের আবার মন খারাপ হয়?
আজ ঈদ। আজ তোমার ভাই বোনেরা কেবল তোমার কথাই মনে করবে।
ঈদ আমাদের প্রিয় কেবল তোমার চোখের ‘তৃষ্ণার’ জন্য। তুমি আমাদের দেখতে চাইবে। প্রিয় এই দিনটি কেবল তোমার ‘অপেক্ষার’ জন্য। তুমি সারাদিন অপেক্ষা করবে – এই বুঝি আমরা এলাম। দরজায় কেউ ভুল করে টোকা দিলেও তোমার মনে হবে তোমার ভাইবোনেরাই এসেছে। কারণ ঈদের দিনে তোমার বাড়ির চেয়ে প্রিয় আর ভালোবাসার জায়গা আমাদের ও যে নেই।
এই এতদূরে থেকেও তোমার আদর আর মমতার স্পর্শ আমি, আমার পরিবার টের পায়।
তোমাকে ঈদের শুভেচ্ছা। ভালো থাকো ।
------------------------------------------------ সিডনি, ২৯শে জুলাই, ২০১৪
|