|
জন মার্টিন
দু’হাজার বিশ নিয়ে মানুষের অভিযোগের শেষ নেই। সারা বছর আতঙ্কে কেটেছে। মানুষ প্রিয়জনদের হারিয়েছে। দম বন্ধ করে ঘরে বসে ছিল সবাই। প্রিয় মুখের সাথে দেখা নেই, প্রিয়জনদের সান্নিধ্য নেই। এমন ‘নেই’ এর তালিকা বিশাল। এই দু’হাজার বিশে - আমরা নতুন পৃথিবীর সাথে পরিচিত হয়েছি। বেঁচে থাকার নতুন নতুন নিয়ম শিখেছি। এই যেমন সন্তান অনেকদিন পর বাড়ীতে ফিরলে - ওকে বুকে জড়িয়ে বলা যাবে না, ‘বাচ্চা তোকে খুব ভালবাসি।‘ কিংবা বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে স্বজন হারানোর কষ্টে সান্ত্বনা নামের আদর দেয়া যাবে না। আহা! কি এক অসহ্য, কঠিন, রূঢ় নিয়মে বেঁধে দিল দু’হাজার বিশ। চারিদিকে ভয় নামের নতুন ভাইরাস করোনা’র সাথে জড়িয়ে গ্যাছে। এমন একটি বছর কে পছন্দ করবে? মনের ঝাল মিটানোর জন্য কতজন এই ‘বিশ’ কে ‘বিষ’ বলে গালাগাল দিচ্ছে। কেউ কেউ এই বছরটিকে ‘কালো বছর’ বলছে। কিন্তু এই দু’হাজার বিশ কি আসলেই বিষের বছর?
এই বছরে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। মৃত্যু ভয় আমাদের জীবনকে নতুন করে আবিষ্কারের মন্ত্র শিখিয়েছে। অনেকেই এই প্রথম তাদের শখের তালিকা তৈরি করেছে। করোনা শেষে তারা কি কি করবে? মানুষ নতুন করে শিখেছে - যে জীবন ভারী মূল্যবান এবং তা যেকোনো সময় হুট করে শেষ হয়ে যেতে পারে। অতএব ‘আজ নয় কাল করবো’ এই চিন্তাকে বদলে দিয়েছে এই দু’হাজার বিশ। করোনা যখন আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে - তখন সব কিছু উপেক্ষা করে কত মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। ভাবুন দেখি - আমাদের স্বাস্থ্য কর্মীরা কি ভাবে অন্যের জন্য নিজেদের জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে এগিয়ে এসেছে? এই গল্পগুলো আপনাকে কোন কথা বলে? আমি এই গল্পগুলোর একটি শিরোনাম দিতে চাই - ‘মানুষ একা নয়, মানুষ মানুষের জন্য!’
আমরা হয়তো টয়লেট পেপার নিয়ে হুড়মুড় করেছি। খাবার স্টক করেছি। কিন্তু কেউ কি না খেয়ে মারা গিয়েছে? মানুষ চাকরী হারিয়েছে জানি, অনেকের আয় কমে গ্যাছে। বিভিন্ন দেশের সরকার বিশেষ প্রণোদনা দিয়েছে। সাধারণ মানুষও তাদের সামর্থ্য দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই যে অন্যকে সাহায্য করার আকুতি নদীর উথাল ঢেউ এর মতো আমাদের বুকে আছড়ে পড়লো - সেটা করোনা না হলে কি আর দু’হাজার বিশে টের পেতাম? আমাদের মনের গভীরে মায়া বাস করে। মানুষের জন্য মায়া। এই মায়ার কথা দু’হাজার বিশ আমাদের নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছে। এই বছরে আমরা আবার সেই মায়ার জালে জড়িয়েছি।
আমরা তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণী বাস করে। আমরা ভূমি দখল, বন দখল থেকে শুরু করে পুরো পৃথিবীটাকে দখল করে নিচ্ছিলাম। কিন্তু দু’হাজার বিশ আমাদের মনে করিয়ে দিল এই পৃথিবীতে আমাদের মতো অন্য প্রাণীদেরও অধিকার আছে। আমরা ভাবিনি যে আমাদের আগ্রাসনে অন্য প্রাণীগুলো কেমন কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। এই বছরটি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে সবাইকে নিয়ে এই পৃথিবী আরো সুন্দর করে সাজাতে হবে। আমরা এই পৃথিবীর যত্ন নিব অন্যের জন্য নয় বরং আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্য।
অনেকদিন পর আমরা একসাথে, এক ঘরে লম্বা সময় কাটিয়েছি। কাজের ব্যস্ততায় ভুলেই গিয়েছিলাম বাচ্চাগুলো কি ভাবে বড় হচ্ছে? স্কুলে কি শিখছে? কোন পুরস্কার পাচ্ছে? কোন কবিতাটি শিখেছে? ছেলেমেয়ের কত অভিযোগ ছিল যে ‘বাবা - মা আমাদের সময় দেয় না।‘ এই নয় মাস - আমরা প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছি। নতুন করে সম্পর্ক ঝালাই করে নেবার এমন সুযোগ দু’হাজার বিশ ছাড়া আর অন্য কোন বছর আমাদের দিয়েছিল? আমার তো মনে পড়ে না। আমি ফিরে তাকাই আর দেখি এই ‘বিশ’ আমার আত্ম-উপলব্ধির বছর। এই আমি কে? কেমন মানুষ? দু’হাজার বিশ আমাকে থমকে দিয়ে বুঝিয়ে দিল। ঠিক এই কারণেই আমি দু’হাজার বিশের কাছে ভীষণ কৃতজ্ঞ।
পৃথিবী বদলে গ্যাছে, বদলে গ্যাছে আকাশ মাঠের সবুজ ঘাস, বদলে গ্যাছে। বদলেছে পানি আমাদের চোখের ছানি বদলে গ্যাছে সব। বদলেছে ভাষা মনের যত আশা বদলে গ্যাছে। ডলফিনের নাচ দোলা দেয় আজ কাঁকড়ার ভিড় নদী বহে ধীর সব বদলে গ্যাছে। তৈরি হচ্ছি নতুন দিনের জন্য এই আজ অথবা কাল আমরা আবার মিলবো নতুন খেলায় নতুন ছন্দে নতুন দোলায় ফুলের গন্ধে। মানুষের ইতিহাস মানুষ লিখবে, লিখবে না ক্রান্তিকাল দেখা হবে তোমার সাথে আজ অথবা কাল।
|
জন মার্টিন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
Share on Facebook               Home Page             Published on: 31-Dec-2020
| | |