জীবনের গল্প শেষ হয়না!
 কাতারের সুখ-দুঃখ - শেষ পর্ব ড. আব্দুল্লাহ আল-মামুন
আগের পর্ব
সিডনী ছেড়ে মরুর দেশ কাতার পাড়ি দিয়েছি এক যুগ পেরিয়ে গেলো গত ৩০ জুন। যদিও দীর্ঘ বারোটি বছর পেরিয়ে গেছে, তবুও নস্টালজিয়ার অলি-গলিতে হাঁটতে গিয়ে মনে হয় কাতারে এলাম এইতো সেদিন। পেছনে ফিরে তাকালে ফেলে আসা দিনগুলো গোধূলি বেলার এক চিলতে আলো হয়ে বুকের গভীরে বার বার পরশ বুলিয়ে যায়।
অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে প্রবাস যাত্রা আমার জন্য খুব একটা সহজ ছিলনা। হাসি-কান্না ভরা জীবনের প্রায় কুড়িটি বছর কাটিয়ে দিয়েছি সিডনী শহরে। ওই শহরের মাটি, আলো-বাতাস আর মানুষের জন্য এক ধরনের ভালোবাসা জন্মে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, স্বদেশের বাইরে এই অস্ট্রেলিয়া হল আমার স্থায়ী আবাস; এই দেশ ছেড়ে আবার যাবো কোথায়? কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশে কখনো আসবো ভাবিনি। শেষ পর্যন্ত সেই আরব দেশেই কাটিয়ে দিলাম এক যুগ।
কাতার চট্টগ্রাম সমিতির সভাপতি |
 আইইবি কাতার চ্যাপটারের চেয়ারম্যান |
কাতারের প্রথম দিনগুলোতে বড় উদাস থাকতো মন। নিজেকে সবসময় শামুকের মত গুটিয়ে রাখতাম। খুঁজে ফিরতাম অস্ট্রেলিয়ার ফেলে আসা দিনগুলো। কিন্তু সময়ের আবর্তনে ধীরে ধীরে কাতারে বহতা সময়ের জমিতে ছড়িয়ে পড়ি। এইতো কিছুদিন আগে সিডনী শহরে ছুটি কাটাতে গিয়ে নিজেকে আগন্তুকের মত মনে হচ্ছিল। রাস্তায় চলতে গিয়ে কোথাও শুনতে পেলামনা মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসা অতি পরিচিত আযানের ধ্বনি। রেস্তরাঁর সামনে গাড়ীতে বসে কাড়াক চা আর সিঙ্গারা খাওয়ার জন্য নিজের অগোচরে আনচান করছিল মন। এখানে দেখি শুধু কাপুচিনো আর কাপুচিনো।
পেট্রোল পাম্পে তেল ভরতে গিয়ে নিজের অজান্তেই গাড়ীতে অপেক্ষা করছিলাম কখন আসবে পেট্রোল বয়, তেল ঢেলে দেবে গাড়ীর ট্যাংকে। স্ত্রীর ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। ও হ্যাঁ! এখানে তো নিজেকেই পেট্রোল ভরতে হবে। পরিবার নিয়ে বেশ কয়েকটা আড্ডায় গিয়ে নিজেকে কেমন বেখাপ্পা লাগছিল। আড্ডার মধ্যমণি হয়েও মনে হচ্ছিল আমি যেন আড্ডায় নেই। বহু দিনের পুরনো বন্ধুদের আবার যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম।
 কাতারের প্রবাসী র্যামিটেন্স যোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত কনসারটে |
কাতারের বহতা দিনগুলোতে পেয়েছি মানুষের নিরন্তর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। মিলেছে বহু আলোকিত ও ভালো মানুষের সন্ধান। পেয়েছি অনেক অকৃত্রিম বন্ধুর সান্নিধ্য। স্বজনহীন প্রবাসে আনন্দ বেদনার সাথী হয়ে ছায়ার মতো এরাই ছিলেন আমার ও আমার পরিবারের পাশে।
বহু সামাজিক, পেশাদার সংগঠনের সাথে কাজ করার ও নেতৃত্ব দেয়ার যেমন সুযোগ হয়েছে তেমনি চারপাশের মানুষ থেকে শিখেছিও অনেক কিছু। তাইতো একযুগ আগের তুলনায় আজকের আমি, একজন অনেক বেশী সমৃদ্ধ এবং পরিপূর্ণ মানুষ। মরুর দেশ কাতারে এসে ভালোলাগার বহতা নদীতে অবগাহন করা সুযোগ করে দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই মহান বিধাতাকে।
 কাতারের নাগরিক সমাজ আয়োজিত সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান |
কাতারে গত একযুগের পথ চলায় সমাজের বিত্তবান মানুষের সাথে যেমন মিশেছি, তেমনি অভাবী, শ্রমজীবী আমজনতার সাথে বসেও আড্ডা দিয়েছি। দোহার রাস্তায়, চোরা গলিতে, বাংলাদেশী চায়ের টেবিলে বসে কান পেতে শুনেছি জীবন থেকে নেয়া এমন কত সুখ দুঃখের গল্প। সত্যি বলতে কি, সুখ-দুঃখ মিলিয়ে কাতারে কাটানো এক যুগ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়ের অংশ হয়ে থাকবে।
কাতারের পাট চুকিয়ে আবার অস্ট্রেলিয়ায় ফিরেও এলাম। আসা-যাওয়া, এতো প্রকৃতিরই নিয়ম। আমরা সবাই যেন যাযাবর। মরুর বেদুঈনের মত ছুটে যাচ্ছি এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্য স্থলে। সব খেলা সাঙ্গ হলে একদিন পাড়ি জমাবো পরপারে। (সমাপ্ত)
 সিডনি হিল্টনে কোয়ারাইন্টিনের নিঃসঙ্গতায় |
আগের পর্ব
 ড. আব্দুল্লাহ আল-মামুন, কাতার থেকে
|