bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia














কাতারের সুখ দুঃখ - ২৪
ড. আব্দুল্লাহ আল-মামুন



আগের পর্ব পরের পর্ব


আবারও অবরুদ্ধ কাতার! আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে প্রতিবেশী চারটি দেশ কাতারের উপর আরোপ করেছিল পূর্ণ অবরোধ। তবে এবারের অবরোধের সাথে পার্থক্য হচ্ছে করোনা ভাইরাসের ভয়াল আক্রমণ মোকাবেলা করতে বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশের মত কাতার স্বেচ্ছায় এই পথ বেছে নিয়েছে।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি ইরান ফেরত একজন কাতারী নাগরিকের দেহে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। সেই থেকেই শুরু। আজকের (মার্চ ২০) হিসাব অনুযায়ী কাতারে করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৪৬০। ঐতিহাসিকভাবে ইরানের সাথে কাতার সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। কাতারে ইরানী বংশোদ্ভূত নাগরিকের সংখ্যা একদম উড়িয়ে দেবার মত নয়। আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করা কিংবা ব্যবসায়িক কাজে যেসব কাতারী নাগরিক ইরান গিয়েছিল তারা বাড়ী ফিরছে আর সাথে নিয়ে আসছে ভাইরাস। এর কয়েকদিনের মাথায় কয়েকজন প্রবাসী শ্রমিকের শরীরে করোনা শনাক্ত হবার পর সবার মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। তবে এ বিষয়ে আরব অঞ্চলের সরকারগুলো খবর চেপে না রেখে যে ধরণের স্বচ্ছতা প্রদর্শন করছে, দৈনিক কতজন সংক্রমিত হচ্ছে তার হিসাব দিচ্ছে, তা দেখে রীতিমত বিস্মিত হয়েছি।

কাতারের নির্মাণ খাতে কাজ করছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। এছাড়া এখানকার বাড়ী বাড়ী রয়েছে অসংখ্য পরিচারিকা, কাজের মানুষ ও ড্রাইভার। অনেক কাতারী তো নিজের হাতে পানি তুলেও খায়না। সবখানেই কাজ করছে হাজারো সেবক/সেবিকা। যেমন পেট্রোল পাম্পগুলোতে শীত-গ্রীষ্ম বলে কথা নয়, সবাই গাড়ীতে ইঞ্জিন চালিয়ে বসে থাকে। গাড়ীর ট্যাংকে তেল ভরে দেয় পেট্রোল সেবকের দল। এসব নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীরা বাস করে বিভিন্ন ক্যাম্পে। ক্যাম্পের কোনো কোনো রুমে ঠাসাঠাসি করে থাকে ৬/৭ জন মানুষ। সব ধরণের গন জমায়েত বন্ধ হলেও এইসব ক্যাম্প বসবাসরত শ্রমিকরা রয়েছেন ভীষণ ঝুঁকিতে। এ নিয়ে কাতার সরকার খুবই সচেতন।

কাতারে কর্মরত শ্রমিকদের একটি বিরাট অংশ বসবাস করে দোহা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া বা সানাইয়াতে। এই এলাকার সব সড়ক বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে বিশেষ নজরদারীতে রাখা হয়েছে। লেবার ক্যাম্পগুলোতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করা হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাস্তায় টহল দিচ্ছে অত্যাধুনিক অসংখ্য এম্বুলেন্স। খোলা হয়েছে ৭ টি ভাষায় কথা বলার মতো হট লাইন। পুরো কাতার জুড়ে সব ধরনের হোটেল রেস্টুরেন্টে এখন কেবল পার্সেলে খাবার বিক্রি হচ্ছে, গ্রাহকদের বসিয়ে খাওয়াতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে (ছবি)।

খুব ছোট্ট একটি দেশ হলেও crisis management-এ কাতারের নীতি নির্ধারকরা বড় বড় উন্নত দেশ যেমন আমেরিকা, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার চেয়েও পরিপক্বতা এবং দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। বিশেষ করে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হবার পর কাতার সময় অপচয় না করে তড়িৎ পদক্ষেপ নিয়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সাথে সাথে ১৫টি দেশে থেকে আকাশ পথে যাত্রী আগমন নিষিদ্ধ করা হয়। এখন পুরো দেশটাকেই locked down করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে ২৫ জানুয়ারি, কাতারের প্রায় মাসখানেক আগে। অথচ সেই তুলনায় করোনা প্রতিরোধে অস্ট্রেলিয়ার সরকারের প্রতিক্রিয়া ধীর মনে হচ্ছে।

দু’সপ্তাহ আগে সকালে অফিসে যাবার পর আমাকে বাড়ীতে ফেরত পাঠানো হল। সরকারের নির্দেশে পঞ্চান্নোর্ধ কর্মচারীদের বাড়ী থেকে কাজ করতে বলা হচ্ছে। অফিসের সব টি-বয় ছুটিতে। কিচেন বন্ধ। ফ্লাস্কে করে কাড়াক চা বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেটাও খাওয়া হয়নি। বলতে গেলে সেই থেকে বাড়ীতে self-quarantine-এ রয়েছি। মাস্ক, আর হাতে গ্লাভস পড়ে বের হই। গ্রোসারী দোকান ছাড়া আর কোথাও যাওয়া হয়না। করোনা সন্ত্রাসে থমকে গেছে পুরো বিশ্ব। মুখোশের অন্তরালে চলে গেছে আমাদের পৃথিবী। মনে হয় আমাদের শহরগুলো দখল করে নিয়েছে ভিনগ্রহের মুখোশধারী কিছু প্রাণী।

এখানে স্কুল বন্ধ হয়েছে অনেক আগে। শিক্ষার্থীদের দুরবর্তীভাবে পাঠ দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে যাদের পরীক্ষা রয়েছে তাদের ফুল মার্কস দেয়া হবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা দপ্তর। সিডনীতে প্রাইমারী, হাইস্কুলগুলো কেন যে এখনো খোলা তা মাথায় ধরছেনা। সিডনীতে আমার স্কুল পড়ুয়া মেয়ের কথা ভেবে বুকের ভেতরটা হীম হয়ে আসছে।

লকডাউনের সমস্যাও অনেক। হাসপাতালে ডাক্তারের সাথে সব অ্যাপয়েনমেন্ট বাতিল হবার ফলে বিপাকে পড়েছি। আমার জরুরী ভিত্তিতে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর কথা। কোনভাবেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাচ্ছিনা। অবশেষে এক আরব প্রতিবেশীর সাহায্য নিয়ে চেষ্টা করে দেখছি, কিছু করা যায় কিনা।

অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে প্রাইভেট সেক্টরে ২৫ বিলিয়ন ডলার ঢালছে কাতার সরকার। দোহা মেট্রোসহ সব গণ-পরিবহন বন্ধ। আতিথেয়তা, পর্যটন, খুচরা খাত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ভাড়া মওকুফ, ব্যাংক লোনের কিস্তি স্থগিত সহ ছয় মাসের জন্য বিদ্যুৎ ও পানির বিলের অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে।

কাতারের শপিং সেন্টারগুলোতে এখনো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েনি। অস্ট্রেলিয়ায় টিস্যু রোল কেনার জন্য বাজারে ক্রেতাদের হুড়োহুড়ি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রবাসে টিভির পর্দায় এসব দেখে বেশ বিব্রত হয়েছি। কাতারে এ ধরণের অনাহুত ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য সেনিটাইজারের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার।

আগামী ৬ মাস সকল ধরনের খাদ্যপন্য আমদানির উপর সরকারী শুল্ক মওকুফ করা হয়েছে। এই কৌশলগত পদক্ষেপ খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় সহায়ক হবে। এছাড়া শুল্ক মওকুফের ফলে জনগণ যাতে সুলভ মূল্যে দ্রব্যসামগ্রী কিনতে পারে সেটাও নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছে সরকার। কাতারে এখন স্থানীয়ভাবে বহু ধরনের খাদ্য সামগ্রী উৎপন্ন হচ্ছে। তাই খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলা করতে কাতারের সক্ষমতা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশী।

দোহা শহরের সবচেয়ে আকর্ষণ হচ্ছে মুশাইরিব এলাকার ঐতিহাসিক বাজার “সুক ওয়াকিফ”। যাকে আমি দোহার “টাইম স্কয়ার” বলে থাকি। বিকেল হতেই সুকের গলিতে দোকানে, রেস্তোরাঁর উপচে পড়ে ক্রেতার ভিড়। সিসার রমরমা সুগন্ধে মাতোয়ার হয়ে ওঠে চারপাশ। কিন্তু সেই সুক ওয়াকিফ এমনকি সাপ্তাহিক বন্ধের দিনেও জনশূন্য দেখে চমকে উঠেছি, ব্যথিত হয়েছি (ছবি দেখুন)।

নিষেধাজ্ঞার কারণে কাতারের অন্যান্য এলাকায় জনসমাগম কমে গেলেও বাংলাদেশি অধ্যুষিত কিছু এলাকার চিত্র এখনো বদলায়নি। করোনা ভাইরাসের কথা ভুলে এখনো বাংলাদেশিরা রাস্তায়, রেস্তোরাঁর সামনে আড্ডা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব এবং দেশে বিদেশে বাংলাদেশিদের নিয়ম অগ্রাহ্য করার প্রবণতা দেখে সত্যিই দুঃখ হয়।

স্বল্প জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অথচ বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ কাতার। তাই অস্ট্রেলিয়া কিংবা অন্যান্য বড় দেশগুলোর সাথে কাতারের হয়তো তুলনা চলেনা। যেমন কিছুদিন আগে জার্মানি এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে হাজার হাজার গরু প্লেনে উড়িয়ে এনে কাতারের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত খামারে এখন দুগ্ধ উৎপাদন করা হচ্ছে। দোহা মেট্রোর জন্য প্রায় দুই ডজন tunnel boring machines এনে বিশ্ব-রেকর্ড সময়ে নির্মাণ কাজ শেষ করেছে কাতার। সেখানে সিডনী মেট্রো নির্মাণ করতে মাঠে ছিল কেবল চারটি মেশিন। এছাড়া আগামী এক মাসের মধ্যেই কাতারের ফ্যাক্টরিতে তৈরি হতে যাচ্ছে মাস্ক। অস্ট্রেলিয়ায় ইতিমধ্যে মাস্কের ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে অনেক ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মী নিজ দেহে ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে সিক কল করছেন।

কাতার অত্যন্ত ধনী দেশ বলে হয়তো এসব করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু সর্বোপরি কাতারি নাগরিক ও নানা দেশের অভিবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাতারের আন্তরিকতা ও ছাড় না দেয়ার মনোবৃত্তি আমাকে মুগ্ধ করেছে। যার একটি নমুনা হল পেট্রোল স্টেশনে যাতে নগদ কিংবা কার্ডে টাকা দিতে না হয় সেজন্য জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে গাড়ীতে প্রিপেইড মাইক্রোচিপ্স লাগিয়ে ঘরে বসেই পেট্রোল কেনার ব্যবস্থা করেছে কাতার (ছবি)। ডিএইচএল এবং আমাজনের সব পার্সেল ঔষধ ও ইউভি দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে।

দ্রুত বদলে যাচ্ছে আমাদের চেনা পৃথিবী, বদলে যাচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের দৃশ্যপট। বিশ্বব্যাপী প্লেগ, মহামারীর কথা এতদিন মানুষের মুখে শুনেছি। এবার নিজেই করোনা সন্ত্রাসের জিম্মি হয়ে দিন কাটাচ্ছি। সামনে কি আসছে কে জানে? (চলবে…)



আগের পর্ব পরের পর্ব




ড. আব্দুল্লাহ আল-মামুন, কাতার থেকে




Share on Facebook               Home Page             Published on: 5-Apr-2020

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far