 কাতারের সুখ দুঃখ - ২২ ড. আব্দুল্লাহ আল-মামুন
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
ডিসেম্বরের ৫ তারিখ কাতারের উপর আরোপিত চারটি প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রের অবরোধের আড়াই বছর পূর্ণ হল। অবরোধের অন্তরালে কেমন আছে কাতার? কেমন কাটছে প্রবাসীদের দিন? এসব কথা অনেকেই জানতে চেয়েছেন আমার কাছে। আজ সে নিয়েই লিখবো।
অবরোধের অন্তরালেঃ ২০১৭ সালের মে মাসের কথা। সৌদি আরবের রিয়াদে ৪১ মুসলিম রাষ্ট্রসহ ৫৫টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হল বিশাল সন্মেলন। এই সন্মেলনের সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় ছিল প্রধাণ অতিথি হিসাবে সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের আমেরিকায় প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যোগদান। শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে মুসলিমদের সত্যিকারের বন্ধু হিসাবে আখ্যায়িত করে সৌদি আরবের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদকে ভূষিত করা হয়। এছাড়া সৌদি আরব আমেরিকার তৈরি ১০ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র কেনারও অঙ্গীকার করে। সৌদি রাজ পরিবারের ট্রাম্পকে তোয়াজ করার মাত্রা দেখে বিস্মিত হয় বিশ্ব। সৌদি বাদশাহের সাথে তলোয়ার নৃত্য শেষ করে ট্রাম্প আমেরিকা ফিরে যাবার পরই ধীরে ধীরে সব কিছু পরিস্কার হতে শুরু করে। সৌদি আরবের এই চরম আনুগত্যের প্রতিদানে মোহাম্মদ বিন সালমানকে যা খুশী তাই করার ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে এসেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

তবে এই সন্মেলনে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার অন্যতম মিত্র দেশ কাতারকে সাইড লাইনে রেখে ইরানকে রুখে দেয়ার আহ্বান যেনো অশুভ কোনো কিছুর ঈঙ্গিত দিচ্ছিল। রিয়াদ সন্মেলন শেষ হবার ঠিক পরদিন কাতার সরকারী সংবাদ সংস্থার ওয়েবসাইট হ্যাক করে ইরানের প্রশংসা আর আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির সমালোচনা করে সৌদি জোটের হ্যাকার বাহিনী মিথ্যে খবর পোষ্ট করে। যা আরব আমিরাত ও সৌদি সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। সেই সূত্র ধরে মাত্র দু’সপ্তাহ পর ২০১৭ সালের ৫ই জুন, সব কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর কাতারের উপর পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে। কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাশের মদদ দেয়া সহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের স্বার্থ বিরোধী প্রচারণা চালানোর অভিযোগ আনা হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় কাতার অনেকটা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। পুরো কাতার জুড়ে তখন থমথমে পরিবেশ। যেকোনো সময় সৌদি সেনাবাহিনী কাতারে অনুপ্রবেশ করতে পারে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিক। ২০১১ সালে শিয়া বিদ্রোহ দমনের জন্য বাহরাইনের রাস্তায় যেরকম সৌদি ট্যাঙ্ক নেমেছিল, ঠিক তেমনি কাতারে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তাদের পছন্দের একজনকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া হতে পারে বলে জল্পনা-কল্পনা চলছিল। কিন্তু তাতে বাধ সেধে বসেন আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব রিক্স টিলারসন। তিনি সৌদি আগ্রাসনে সায় দেননি। ট্রাম্পের অবাধ্য হবার জন্য রিক্স টিলারসনকে যে মাশুল দিতে হয়েছে সে কথা আমাদের সবারই জানা। তবে সবাইকে উপেক্ষা করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান কাতারের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেলে সৌদি আরব পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ২০১৪ সালে কাতারে তুর্কী সামরিক ঘাঁটি করার জন্য চুক্তি হলেও নব নির্মিত ঘাটিতে মাত্র ১০০ জন তুর্কি সৈন্য অবস্থান করছিল। কিন্তু আবরোধ আরোপের পর পরই সৌদি আগ্রাসন রুখে দিতে জরুরী ভিত্তিতে পাঁচটি সাজোয়া গাড়ী সহ বেশ কিছু সৈন্য কাতারে পাঠানোর নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। এর কিছুদিনের মধ্যে ৩০০০ হাজার সৈন্য আগমন করে তুর্কি ঘাঁটিতে। এখন এই সংখ্যা বেড়ে ৫০০০ হাজারে যেতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। আমেরিকার পাশাপাশি কাতারের মাটিতে তৃতীয় শক্তি হিসাবে তুরস্কের আবির্ভাব সৌদি জোটের করা পরিকল্পনায় ঠান্ডা পানি ঢেলে দেয়।

অবরোধের পরবর্তী সময়গুলো উৎকন্ঠা আর অস্থিরতায় কাটছিল সবার। কাতারের অধিকাংশ খাদ্যপণ্য আসতো সৌদি আরব ও আমিরাত থেকে। অবরোধের পর আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কয়েকদিনের মধ্যে সপিং মলের পন্য-সামগ্রী ভর্তি সারি সারি তাক শুন্য হয়ে গিয়েছিল। দুঃসময়ের প্রস্তুতি হিসাবে অনেকে চাল, ডাল, অন্যান্য আবশ্যকীয় পণ্যদ্রব্য কিনে বাড়ীতে মজুদ করছিল। বহু কাতারী ও ভারতীয়রা ব্যাংকের সঞ্চিত টাকা ডলার করে কাতারের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যাতে কাতার থেকে বের হওয়া যায় সে জন্য আমি কাতারের অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাসে যোগাযোগ করলাম। জরুরী নথিপত্র, কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক সহ অন্যান্য মুল্যবান জিনিস পত্র একটি ব্যাগে গুছিয়ে রাখলাম। যাতে প্রয়োজনে কয়েক ঘন্টার নোটিশে কাতার ছাড়তে পারি। ইরান ও শিয়া ফ্যাক্টরঃ ঐতিহাসিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের আরব অঞ্চলে শিয়া-সুন্নীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই বহু দিনের পুরোনো। সুন্নী শাসক শ্রেনী, শিয়াদের ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে। তাই যে কোনো মূল্যে শিয়াদের উত্থান প্রতিহত করতে তারা বদ্ধ পরিকর। এই অঞ্চলের বেশ কিছু আরবদের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি শিয়াদের প্রতি সুন্নী আরবরা কি ধরণের ঘৃণা পোষণ করে। শিয়ারাও সুন্নী আধিপত্যের অবসান ঘটাতে বিভিন্ন সময় আরব অঞ্চলে বিদ্রোহ করেছে, অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। উল্লেখ্য, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন ও বিপুলসংখ্যক শিয়া জনগোষ্ঠী রয়েছে। সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও কাতারেও শিয়া জনসংখ্যা কম নয়। কাতারের বড় বড় ব্যবসা ইরানী বংশোদ্ভূত কাতরীদের হাতে। বাহরাইনের ৭০ শতাংশ জনসংখ্যা শিয়া মতাবলম্বী। কিন্তু এর পরও শাসন ক্ষমতা সুন্নীদের হাতে। তাই বাহরাইনে শিয়াদের অসন্তোষ দানা বেধে বিদ্রোহে রুপ নিয়েছে বহুবার। সৌদি আরবের উত্তর পূর্বাঞ্চলের তেল সমৃদ্ধ এলাকার সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ হচ্ছে শিয়া। শিয়া অধ্যুষিত ইরান হচ্ছে শিয়া-শক্তির মুল উৎস। তাই আরব উপ-অঞ্চলের সুন্নী রাষ্ট্রগুলো ইরানকে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আমেরিকা ও ইসরাইলের সাথে জোট বেধেছে। কাতারের সাথে ইরানের সম্পর্ক যেন “শ্যাম রাখি না কূল রাখি” অবস্থা। কাতারের উত্তরে আরব সাগরের নীচে রয়েছে ৯৭০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাব্যাপী বিস্তৃত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাস ক্ষেত্র, যা যৌথভাবে নিয়ন্ত্রণ করে কাতার ও ইরান। সৌদি জোটের পক্ষ নিয়ে ইরানকে উত্তেজিত করার পরিণতি যে কি হতে পারে সেকথা কাতার খুব ভালো করেই জানে। তবে কাতারের সাথে ইরানের সুসম্পর্ক সৌদি আরব কখনোই ভালো চোখে দেখেনি। অবরোধ আরোপের পর ইরান কাতারকে এই বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করার জন্য সর্বোতভাবে সাহায্য করে। চট্-জলদি পন্যসামগ্রী আমদানি করার জন্য ইরানের সমুদ্রবন্দরগুলো কাতারে জন্য খুলে দেয়া হয়। খাদ্য সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে অবরোধের প্রথম দিকে প্রতিদিন ১২০০ টনের খাদ্র সামগ্রী পাঠাতে থাকে ইরান। ফলে অবরোধের চাপে রেখে ইরানের সান্নিধ্য থেকে কাতারকে ছাড়িয়ে আনার সৌদি চাল মাঠে মারা পড়ে। উল্টো, বিপদের বন্ধু হিসাবে ইরানের সাথে কাতারের সম্পর্ক আগের চেয়ে আরো ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। কাতারের স্বতন্ত্র পররাষ্ট্রনীতি ও আল-জাজিরাঃ পররাস্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কাতার, আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের মোড়ল সৌদি আরব ও আমিরাতের দিক-নির্দেশনা মেনে চলবে এমনটাই তারা আশা করে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে কাতারের স্বাধীন পদক্ষেপ তাদের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া আরব বিশ্বের জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরার প্রচারণা সৌদি নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ বা বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিতে পারে বলে সৌদি রাজ পরিবার বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফলে কাতারের উপর ক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গের মত আরব দেশগুলোর মধ্যেকার এই আত্মঘাতী বিরোধে সবচেয়ে বেশী লাভবান হচ্ছে আমেরিকা ও ইসরাইল। কাতার এবং সৌদি আরব, এ দুটি দেশেই রয়েছে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি। আমেরিকাকে সন্তুষ্ট রাখতে সৌদি আরবের সাথে পাল্লা দিয়ে সম্প্রতি কাতারও আমেরিকা থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে। আমেরিকার আনুকূল্য পাওয়ার জন্য ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ট হবার রীতিমত প্রতিযোগীতায় নেমেছে আরব দেশগুলো। আমেরিকার পিআর কোম্পানী ও লবিষ্ট গ্রুপের আয় আকাশ ছুঁতে চলেছে। আমেরিকার সিনেটর এবং প্রশাসনের উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য ২০১৭ সালের অবরোধের পর পিআর কোম্পানীর পেছনে কাতার ব্যয় করেছে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার! একই খাতে সৌদি জোটের ব্যায়ের পরিমান কাতারের দ্বিগুন। ২০১৭ সালে অবরোধ আরোপের পর এই প্রথম কাতারের মাটিতে গাল্ফ কাপ টুর্নামেন্ট খেলতে এসেছে সৌদি ও আমিরাতি ফুটবল দল। দীর্ঘদিন পর প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে কাতারের সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে আসলেই এই বিরোধের অবসান হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। (চলবে…)
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
 ড. আব্দুল্লাহ আল-মামুন, কাতার থেকে
|