 কাতারের সুখ দুঃখ - ১৮ ড. আব্দুল্লাহ আল-মামুন
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
গ্যাস আবিষ্কারের আগে কাতার নিয়ে কারো তেমন বিশেষ আগ্রহ ছিলনা। আজকের রাজধানী দোহা শহর একটি ঘুমন্ত জেলে পাড়ার মতো নীরব ছিল। কিন্তু ১৯৪৯ সালে গ্যাস রপ্তানি শুরু হলে বদলে যায় কাতারের অর্থনীতি। শুরু হয় উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। আজ একুশ শতকের দ্বার গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে তাই খুব জানতে ইচ্ছে করে পঞ্চাশ, ষাট দশক কিংবা তারও বহু আগে, সেই প্রাচীন কালে কেমন ছিল কাতার?
কাতার আরব্য উপসাগরের একটি উপদ্বীপ। আয়তনে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের চেয়ে সামান্য ছোটো। স্থানীয় কাতারি এবং প্রবাসী মিলিয়ে জনসংখ্যা হচ্ছে প্রায় ২৭ লক্ষ। কাতার পুরো দেশটা প্রায় সমতল। সমুদ্রতল থেকে এখানকার সবচেয়ে উঁচু জায়গার উচ্চতা হল মাত্র ১০৩ মিটার!
জনশ্রুতি আছে, আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে কাতার সৌদি আরবের মূল ভ’খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, আলাদা একটি দ্বীপ ছিল। কিছু প্রাচীন মানচিত্রে কাতারকে দ্বীপ হিসাবে দেখানোর জন্যই হয়ত এ রকম কাহিনীর প্রচলন হয়েছে। তবে এই তত্ত্বের সমর্থনযোগ্য কোনো ভূতাত্ত্বিক কিংবা ঐতিহাসিক প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
কাতারে নেই আমাদের দেশের মত জলাশয় কিংবা হ্রদ। এ দেশের বুক চিরে বয়েও চলেনা কোনো নদী-নালা কিংবা ঝরনা প্রবাহ। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, প্রাচীনকালে কাতারের মূল ভূখণ্ডের পানির অস্তিত্ব ছিল। এখানকার আবহাওয়া ছিল বেশ আদ্র, ছিল জলপ্রপাত, ও স্বচ্ছ পানির নালা। কিন্তু ধীরে ধীরে এলাকার তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে নালার পানি শুকিয়ে যায়। কাতারের বিভিন্ন এলাকায় পানি প্রবাহের সেই চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। শুকিয়ে যাওয়া এসব নালাকে বলা হয় “ওয়াদি”।

প্রাচীনকালে এই ওয়াদি দিওয়ই বয়ে যেতো পানি প্রবাহ। বৃষ্টিপাতের পর শুষ্ক, শীর্ণ ওয়াদিগুলো পানির স্পর্শে হঠাৎ করে জীবন্ত হয়ে ওঠে। বাদামী রংয়ের মাটি মেশানো পানির তীব্র স্রোতে চলার পথের সবকিছু খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সম্প্রতি জর্ডান, কুয়েত ও সৌদি আরবে ভয়াবহ বন্যার সময় খরস্রোতা ওয়াদির ভয়ংকর রূপ আমরা দেখেছি। ওয়াদি ছাড়াও কাতারের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে গুহা। ভ’পৃষ্ঠের নীচে প্রবাহের কারণে সৃষ্ট এই গুহার তলদেশে এখনো মিষ্টি পানির সন্ধান পাওয়া যায়।

আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে ব্রোঞ্জ যুগে আরব্য উপসাগরের অঞ্চলে বাহরাইন এবং কাতার এলাকাজুড়ে “দিলমুন” নামের একটি সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। ওই সময় বর্তমান ইরাক ও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে গড়ে উঠা বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয় সভ্যতা এবং পাক-ভারত উপমহাদেশের সিন্ধু অববাহিকার সভ্যতার মধ্যে বাণিজ্যিক লেন-দেন হত। সমুদ্রপথে যাতায়াতের পথে কৌশলগত অবস্থানের কারণে, বাহরাইনের পাশাপাশি কাতারকেও সিন্ধু অববাহিকা ও মেসোপটেমিয়ার সভ্যতাগুলির মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে গণ্য করা হতো। মধ্যপ্রাচ্যে আগত পর্যটকদের বিবরণীতে এর প্রমাণ রয়েছে। ওই সময় কাতার উর্বর ও চাষাবাদ যোগ্য আবাদি অঞ্চল ছিল, আজকের মতো চুনাপাথরে ভরা শুষ্ক মরু ছিলনা। কাতারের সবখানেই ছিল খেজুর গাছের বাগানের ছড়াছড়ি। তাই ব্যবসায়ীরা কাতারে যাত্রা বিরতির সময় বিপুল পরিমাণ উৎকৃষ্ট মানের খেজুর এবং রমণীয় মুক্তো কেনাকাটা করত। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২০০০ অব্দের দিকে ভারত থেকে বাণিজ্য আসা বন্ধ হয়ে গেলে দিলমুন সভ্যতার পতন ঘটতে শুরু করে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতকে গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে হানা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এর আগে পর্যবেক্ষণের জন্য আলেকজান্ডার তাঁর শীর্ষ নৌ সেনাপতি এন্ড্রসথেনেসকে ওই অঞ্চলে পাঠান। একজন বিজ্ঞানী এবং মানচিত্রকার এই নৌ সেনাপতির সমুদ্রে বিরল উদ্ভিদ এবং প্রাণীকুল অন্বেষণ করার প্রবল আগ্রহ ছিল। ফলে সম্রাটের নৌ অভিযানের তথ্য সংগ্রহের আগে আরব্য উপসাগরের জলরাশির রহস্য উন্মোচনের জন্য তিনি মনোনিবেশ করেন। এর কিছুদিনের মধ্যে হঠাৎ করে সম্রাটের মৃত্যু হলে উপসাগরীয় অঞ্চলে গ্রীক অভিযান অসম্পন্নই থেকে যায়।
এরপর রোম সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সম্রাট অগাস্টাস, তাঁর পালক পুত্র গাইয়াস সিজারকে আরব অঞ্চলে অভিযানের নির্দেশ দেন। কিন্তু আর্মেনিয়ার যুদ্ধে মাত্র ১৯ বছর বয়স্ক এই যুবরাজের মৃত্যু হলে সম্রাট অগাস্টাসের ইচ্ছা পূরণ হয়নি। ফলে কাতারকে ওই সময়কার দুইটি সবচেয়ে শক্তিধর সাম্রাজ্য রোম ও গ্রীকের অধীনস্থ হতে হয়নি ।

সপ্তম শতকে ইসলামের প্রসারের আগে কাতার ও বাহরাইন এই দুই অঞ্চলের শাসক ছিলেন বনু তামিম গোত্রের প্রধান মুনযির বিন সাওয়া আল তামিমি। বর্তমান শাসক আল-থানি পরিবার, আল তামিমিরই একটি শাখা। ইসলাম প্রচারের জন্য হযরত মুহাম্মদ (সা.) সাহাবী আলা আল হাদরামি (রা) কে ৬২৮ সালে দক্ষিণ আরব অঞ্চলে প্রেরণ করেন। বনু তামিমের গোত্র প্রধান মুনযির আল তামিমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে অন্যান্য গোত্রের মানুষও ইসলামের ছায়াতলে চলে আসে।
উমাইয়া (৬৬১-৭৫০ খ্রী) ও আব্বাসীয় (৭৫০-১২৫৮ খ্রী) শাসনামলে দুই সাম্রাজ্যের রাজধানী যথাক্রমে দামেস্ক ও বাগদাদে ভারত থেকে উচ্চমানের কাপড়, মসলা এবং চীন থেকে চীনামাটির পাত্র ও ঔষধ সরবরাহ করা হতো। ভারত ও চীনের সাথে সমুদ্র পথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সংযোগকারী স্থান হিসাবে কাতার বেশ গুরুত্ব পায়। আব্বাসীয় আমলে কাতারে মুক্তা ব্যবসার উন্নতি হয়। প্রাচ্যের দেশ সহ চীনেও কাতারি মুক্তার চাহিদা পরিলক্ষিত হয়।
যতদূর জানা যায়, কাজের অন্বেষণে পঞ্চাশ দশকের গোঁড়ার দিকে কাতারে বাংলাদেশিদের আগমন ঘটে। তবে পঞ্চাশ ও ষাট দশকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান আকর্ষণ ছিল দুবাই। সবাই উপার্জন করার জন্য দুবাই যেতে চাইতো। আত্মীয় কিংবা পরিচিত কোনো বন্ধুর আমন্ত্রণে হাতে গোনা কিছু মানুষ আসতো কাতারে। কাতারে আসার জন্য তখন ভিসার কড়াকড়ি তেমন ছিলনা। বাংলাদেশিরা করাচী বন্দর থেকে জাহাজে করে কাতারে আসতেন। কেউ ভিসা নিয়ে আবার কেউ ভিসা ছাড়াই আসতেন। জাহাজ ওয়াকরার সমুদ্রে নোঙর করতো, অভিবাসন কর্মকর্তারা ছোটো ছোটো ডিঙি নৌকায় চেপে জাহাজে এসে পাসপোর্ট নিরীক্ষা করে সিল মেরে দিতেন। অতঃপর যাত্রীরাও নৌকায় চেপে তীরে আসতেন। ভিসা বিহীন যাত্রীরা বিভিন্ন ধরনের ফন্দি ফিকির করে অভিবাসন অফিসারদের ফাঁকি দিয়ে কাতারে ঢুকে পড়তো। আবার জাহাজ থেকে সমুদ্রের পানিতে ঝাপ দিয়ে সাঁতার কেটে অনেকের পাড়ে আসার ঘটনাও জানা যায়। চলবে…
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
 ড. আব্দুল্লাহ আল-মামুন, কাতার থেকে
|