 কাতারের সুখ দুঃখ - ১৭ ড. আব্দুল্লাহ আল-মামুন
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। সিডনীর ছেড়ে কাতারে গিয়েছি মাত্র তিন মাস হল। সেপ্টেম্বরের শেষে রোজার ঈদ। মন ছুটে গেলো সিডনীতে। সিদ্ধান্ত নিলাম, পরিবারের সাথে ঈদ করবো। তখনো চাকুরীর পর্যবেক্ষণকাল বা প্রোবেশন পিরিয়ড শেষ হয়নি। তাই আমার চাকুরীর ঝুলিতে কোনো ছুটিও জমা হয়নি। তবুও ছুটির দরখাস্ত দিলাম। আমার ছুটিতে যাবার দৃঢ় সংকল্প দেখে অবশেষে এক সপ্তাহের ছুটি মঞ্জুর করা হল। বলা হল, বার্ষিক ছুটি জমা হলে সেখান থেকে কেটে নেয়া হবে।
কাতারে বৃহস্পতি এবং শুক্রবার হলো সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই বৃহস্পতিবারেই রওয়ানা দিতে হবে। চট্-জলদি বিমানের টিকিটি কেটে ফেললাম। বৃহস্পতিবার রাতে ফ্লাইট। তখন দুপুর একটা হবে। একজন সহকর্মীকে কথা প্রসঙ্গে অস্ট্রেলিয়া যাবার কথা বলতেই ও জানতে চাইলো, আমি এক্সিট পারমিট বা বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়েছি কিনা। আমিতো অবাক! এটা আবার কি? সাথে পাসপোর্ট আর বিমানের টিকিট আছে, আমার যাওয়া ঠেকায় কে? সহকর্মী বললেন, কাতারের বাইরে যেতে হলে কোম্পানির স্পন্সর বা কফিল থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। কাতারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ছাড়পত্র দিয়ে থাকে। এই ছাড়পত্র ছাড়া ইমিগ্রেশনের ফটকের বাইরে পা রাখা যাবেনা।
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। প্রতিটি অফিসেই ভিসা এবং ছাড়পত্র ইত্যাদির কাজ করার জন্য একজন কর্মচারী থাকে যাকে বলা হয় মান্দুপ। মান্দুপের কাছে ছুটে গেলে সে বললো, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুপুর একটার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। মান্দুপ তখন এইচআর ম্যানেজারের কাছে নিয়ে গেলো। তিনি আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন, “ওয়েলকাম টু মিডল ইস্ট!” উনি বললেন, এখন কেবল বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশান অফিসে সরাসরি আবেদন করলেই ছাড়পত্র পাওয়া যেতে পারে।
সিডনী যেতে পারবোনা সেই ভাবনায় হঠাৎ করে ভেঙ্গে পড়লাম। আমার বেগতিক অবস্থা দেখে কেরালা প্রবাসী মান্দুপ ভাইয়ের হৃদয়ে করুণার সঞ্চার হল। উনি আমার সাথে কোম্পানির স্পন্সরের চিঠি নিয়ে বিমানবন্দরে যেতে রাজী হলেন। বিধাতার দয়ায় সেবারের মত মস্তবড় একটি ফাঁড়া থেকে বেঁচে গেলাম। ইমিগ্রেশান শেষ করে বিমানে চড়ার পর অস্ট্রেলিয়ার একজন অভিবাসী যে ধরনের সুযোগ সুবিধা পায় সে কথা ভেবে অস্ট্রেলিয়ার সরকারকে নীরব কৃতজ্ঞতা জানালাম।
এক্সিট পারমিট নামের এই ফাঁদে আটকা পড়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীরা। কফিলের অনুমতি ছাড়া কেউ বিমানে চড়তে পারেন না। এমনও দেখেছি ট্রাফিক ফাইন দেয়া হয়নি বলে বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশান থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে অনেক প্রবাসী যাত্রীকে।
তবে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে এখন কাতারে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপ এবং আসন্ন ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরকে মাথায় রেখে সম্প্রতি স্থায়ী আবাসন সুবিধা এবং “এক্সিট পারমিট” বা বহির্গমন ছাড়পত্র সংক্রান্ত নতুন আইনের অনুমোদন দিয়েছেন কাতার সরকার। নতুন এই আইনের অধীনে কর্মরত শ্রমিকরা অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে কাতার ত্যাগ করতে পারবেন। কাজের ধরন বিবেচনায় কাতার ত্যাগের আগে কেবল নিয়োগকর্তার অনুমতি নিতে হবে। তবে এই আইনের অপব্যবহারের ফাঁক-ফোকর যদি না থাকে, তাহলে এটা কাতারের খেটে খাওয়া প্রবাসী মানুষদের জন্য সুখবরই বটে।
মধ্যপ্রাচ্যের এই প্রথম কোনো দেশ হিসাবে কাতারে বিদেশিদের স্থায়ী অভিবাসনেরও সুযোগ দেয়া হচ্ছে। তবে বছরে মাত্র ১০০জন অভিবাসী গ্রহণ করা হবে। আর অভিবাসী হবার জন্য যে ধরনের কঠিন শর্ত দেয়া হয়েছে সেগুলো পূরণ করে অভিবাসী কোটায় বাংলাদেশিদের স্থান করে নেয়াটা খুব একটা সহজ হবেনা বলেই মনে হয়। মনে হচ্ছে, যেসব কাতারী নাগরিক বিদেশিদের বিয়ে করেছেন তাদের এবং তাদের সন্তানদের কথা মাথায় রেখেই আপাতত এই আইন করা হয়েছে। এতে অন্যান্য উন্নত দেশের মত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অভিবাসীদের ভূমিকা রাখার দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনার চোখে পড়ছে না।
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
৩ অক্টোবর, ২০১৮
 ড. আব্দুল্লাহ আল-মামুন, কাতার থেকে
|