বিশ্ব কাপ ২০২২
 কাতারের সুখ দুঃখ - ১৬ আব্দুল্লাহ আল-মামুন
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
সেদিন সামাজিক মাধ্যমে সিডনীর এক ছোটো ভাইয়ের ক্ষুদে বার্তা পেলাম। সে আবদারের সুরে লিখেছে, “ভাই, কাতারে ২০২২ সালের বিশ্ব কাপের জন্য আপনার গেস্ট রুমটা এখন থেকেই বুকিং দিলাম”। রাশিয়ায় বিশ্ব কাপ ফুটবলের বিদায়ের ঘণ্টা বেজে গেছে ঠিকই, কিন্তু আসন্ন ২০২২ সালের বিশ্ব কাপ ফুটবলের আগমনী সুর এখন একটানা বেজে চলেছে কাতারে। বিশ্বের চোখ এখন কাতারের দিকে। কাতারে বসে সেই উত্তেজনার তাপ অনুভব করছি সবাই।
ইতিমধ্যে আগামী বিশ্ব কাপের সময়সূচী ঘোষণা করেছে ফিফা। জুন-জুলাই মাসে কাতারের অসহনীয় গরমের অজুহাত তুলে যেসব দেশ ছোট্ট এই দেশটিতে বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরোধিতা করেছিল, সেসব হিংসুটে দেশগুলোর জন্য এটি দুঃসংবাদই বটে। এই প্রথমবারের মতো শীতকালে ফুটবলের আসর বসবে কাতারে। যদিও কাতারি কর্তৃপক্ষ তাদের নবনির্মিত সবগুলো স্টেডিয়ামে আধুনিক শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করেছে, কিন্তু খেলার মাঠের বাইরে অসংখ্য ফুটবল ফ্যানদের এই তীব্র গরম থেকে স্বাচ্ছন্দ্য দেয়ার জন্যই আসন্ন ফুটবল আয়োজনকে শীতকালে নিয়ে আসা হলো।
২০২২ সালের ২১ নভেম্বরে শুরু হয়ে ফাইনাল খেলা হবে ১৮ ডিসেম্বর। জুন-জুলাই মাসে কাতারের গরমের তীব্রতা থাকে তুঙ্গে। তাপমাত্রা কখনো ৫০ ডিগ্রী ছাড়িয়ে যায়। এই জুন মাসেই সিডনী থেকে আমার কাতারে আগমন। তাই কাতারের গ্রীষ্ম আমার স্মৃতিতে এখনো অমলিন। তবে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে তাপমাত্রা কমতে শুরু করে এবং নভেম্বর-ডিসেম্বরে ২০ থেকে ২৪ ডিগ্রির মধ্যে উঠানামা করে। কখনো রাতে তাপমাত্রা ১০-১২ ডিগ্রীতেও নেমে আসে। বিশেষ করে জুন-জুলাই মাসের অসহনীয় গরমের পর কাতারের শীতকাল যে কতটা উপভোগ্য তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
রাশিয়ায় বিশ্ব কাপ হলেও দোহা শহরের বিভিন্ন জায়গায় নির্মিত “ফ্যান জোনের” সৌজন্যে কাতারে বসেই ফুটবল সমর্থকদের গগন বিদারী শ্লোগানে মুখরিত স্টেডিয়ামের উন্মাদনার কিঞ্চিত স্বাদ পেলাম। স্টেডিয়ামে যারা যেতে পারবেন না তারা পরিবার পরিজন নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে যাতে খেলা উপভোগ করতে পারেন সেজন্য নির্মিত হয়েছে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ফ্যান-জোন। সমগ্র কাতার জুড়ে এমন আরো ত্রিশটিরও বেশী ফ্যান-জোন তৈরি হচ্ছে। যা আগামী ২০২২ সালে বিশ্ব কাপের সময় চালু হবে।
ফ্যান-জোনে বিশ্ব কাপের খেলা দেখতে গিয়ে রীতিমত মুগ্ধ হয়েছি। ফ্যান-জোনে ঢোকার মুখে ছিল অসাধারণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা আর সারিবদ্ধভাবে দর্শকদের স্টেডিয়ামে প্রবেশের মধ্য দিয়ে কাতার আগামী বিশ্বকাপ আয়োজনের সীমিত মহড়াও যেন করে নেয়া হল এই সুযোগে।
ফ্যান-জোনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মনে হলো যেনো কোনো ফুটবল স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলাম। সারি সারি গ্যালারি ভর্তি দর্শক খেলা দেখছেন মেগা পর্দায়। দর্শকদের করতালি এবং চিৎকারের মধ্যে খেলা দেখার সময় মনে হচ্ছিল আমি কাতারে নয়, যেনো রাশিয়ার কোনো স্টেডিয়ামে হাজারো দর্শকের সারিতে বসে আছি।
খেলা চলাকালে যাতে রসনা তৃপ্ত করা যায় সেজন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরণের খাবারের স্টল। এছাড়াও রয়েছে বাচ্চাদের রকমারি খোলাধূলোর সরঞ্জাম সমৃদ্ধ একটি বিশাল কিডস-জোন। আছে টেবিলটপ ফুটবল, ভিডিও গেম, ভার্চুয়াল রিয়্যেলিটি ফুটবল, ফেস পেইন্টিং সহ ফুটবল চ্যালেঞ্জ গেমস। দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য বিভিন্ন দিন কাতারের বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীদের নিয়ে কনসার্টেরও আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া দেখলাম নামাজের জায়গা, ফার্স্টএইড রুম ও পর্যাপ্ত সংখ্যক টয়লেট। সব মিলিয়ে ফ্যান-জোনে গিয়ে মনে হল কাতার আগামী বিশ্ব কাপের জন্য সত্যিই প্রস্তুত। যে সব নিন্দুকেরা কাতারের বিশ্ব কাপ আয়োজনের সামর্থ্য নিয়ে কটু কথা বলছে তার উপযুক্ত জবাব হচ্ছে এই ফ্যান-জোন।
আসন্ন ২০২২ সালের বিশ্ব কাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হবে প্রধান ভেন্যু, প্রায় ৫০ হাযার দর্শক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন খলিফা স্টেডিয়ামে। বিশ্ব কাপ শুরু হবার চার বছর আগেই প্রস্তুত খলিফা স্টেডিয়াম। কিছু দিন আগে কাতার জাতীয় দলের সাথে এই স্টেডিয়ামে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলেছে ব্রাজিল। এই স্টেডিয়ামেও তৈরি হয়েছে একটি ফ্যান-জোন।
কোয়ার্টার ফাইনালের একটি খেলা দেখতে গেলাম খলিফা স্টেডিয়ামের ফ্যান-জোনে। খেলা শুরু হবে কাতারের সময় বিকেল পাঁচটায়। গ্রীষ্মের এই দিনে তাপমাত্রা তখনও ৪২ ডিগ্রী ছুঁই ছুঁই করছে। এতো গরমে স্টেডিয়ামে যাবো কিনা সে নিয়ে দ্বন্দ্বে ছিলাম। কিন্তু স্টেডিয়ামের গেইট পেরুতেই শীতল হাওয়ার পরশে চমকে উঠলাম, জুড়িয়ে গেলো শরীর। দেখলাম হাজার হাজার ফুটবল দর্শকের উপস্থিতিতে খলিফা স্টেডিয়ামের গ্যালারীর একটি অংশ কানায় কানায় পরিপূর্ণ। অত্যাধুনিক আর অভিনব শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে পুরো স্টেডিয়ামকে শীতকালীন তাপমাত্রায় নিয়ে আসা হয়েছে। স্টেডিয়ামের ঠিক উপরে দুপুরের তপ্ত সূর্য দেখা যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তীব্র গরমের পরিবর্তে হাজারো দর্শক গা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া হিম শীতল বাতাসে ফুটবল খেলাটি উপভোগ করছেন।
বিশ্ব কাপের বেশ আগেই অবকাঠামো এবং স্টেডিয়াম নির্মাণ কাজ শেষ করার জন্য কোনো কোনো নির্মাণ-ক্ষেত্রে দিন-রাত ২৪ কাজ চলছে। দোহা শহরের দিকে দিকে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে মেট্রো রেল স্টেশন। আরো হচ্ছে ফ্লাইওভার, আন্ডার-পাস, স্কাইস্ক্রেপার, সে এক এলাহি কারবার! কাতারের উপর জল, স্থল, ও আকাশপথে চারটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আরোপিত অবরোধের ১৫ মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এই অবরোধ, অর্থনৈতিক মন্দা সব কিছুকে ডিঙ্গিয়ে অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলেছে কাতার, লক্ষ্যস্থল ২০২২, বিশ্ব কাপ ফুটবল।
উল্লেখ্য, কাতারকে কেন এককভাবে বিশ্ব কাপ আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হল সেটাও কিন্তু হিংসুটে প্রতিবেশী দেশগুলোর মাথাব্যথার অন্যতম একটি কারণ। মিলিয়ন ডলার খরচ করে বড় বড় লবিস্ট নিয়োগ করে প্রতিবেশী দেশগুলো দুর্নীতি এবং গরমের অজুহাত দেখিয়ে কাতার থেকে বিশ্ব কাপ সরিয়ে নেয়া যায় কিনা সেজন্য দুর্নিবার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু তারা সফল হয়নি। প্রচেষ্টা আর দেশপ্রেম অটুট থাকলে যে কোন অসাধ্যকে জয় করা যায় - কাতার সেটি প্রমাণ করে দেখিয়েছে। (চলবে)
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
 আব্দুল্লাহ আল-মামুন, কাতার থেকে
|