 কাতারের সুখ দুঃখ - ১৫ আব্দুল্লাহ আল-মামুন
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
অস্ট্রেলিয়ার সিডনী শহরে আসার পর যে বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ করে তা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ানদের বদান্যতা ও দানশীলতা। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থাগুলোর আহ্বানে সবাই যেভাবে এগিয়ে আসে এবং অর্থ দান করে তা দেখে নিজের দীনতা চোখে পড়ছিল বার বার। তখন আমাদের মতো নবাগত অভিবাসীদের সাহায্য করার জন্য যে সব সংস্থা এগিয়ে এসেছিল তাদের মধ্যে সিডনি সিটি মিশন, স্যালভেশন আর্মি, ওয়াইএমসিএ, দ্যা স্মিথ ফ্যামিলি ছিল অন্যতম।
সিডনী সিটি মিশন নূতন অভিবাসীদের পুরনো ফার্নিচার, ফ্রিজ সহ ঘরের নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ধার দিত। চাল-চুলো-চাকরী বিহীন একজন অভিবাসীর জন্য এটা ছিল বিশাল ব্যাপার। এই আসবাবপত্র যতদিন প্রয়োজন ব্যবহার করে আবার সিটি মিশনে ফেরত দিয়ে দিতে হত। যাতে এগুলো আবার অন্য কাউকে দেয়া যায়। যদিও এই ধরনের বহু দাতব্য সংস্থা খ্রিস্টান চার্চের অধীনে পরিচালিত হয়, তবে শুধু খ্রিস্টান নয় যে কোনো ধর্মাবলম্বীদের সাহায্য করতে তারা এগিয়ে আসে। বাংলাদেশে মসজিদ, মাদ্রাসা কিংবা এতিমখানাতেই মানুষের দান-খয়রাত করার আগ্রহ বেশী দেখা যায়। তবে শিক্ষা, চিকিৎসা এবং সামাজিক সমস্যা সমাধানে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার জন্যও মানুষ এখন সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের কাতারে দাতব্য সংস্থার সংখ্যা খুবই সীমিত। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সবুজ সংকেত না পেলে কোনো কিছু করা যায় না। সন্ত্রাসী তৎপরতার কাজে অর্থ সংগ্রহের পথ বন্ধ করার জন্য সম্প্রতি এনজিও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খুবই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাতারী ধনী শেখরা প্রচুর দান করেন। অনেক সময় ধর্মীয় কারণে দানের কথা প্রকাশ করা হয়না বলে সেটা জানা যায়না।
পবিত্র রমজান আসলেই কাতার সহ মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশে দান খয়রাতের মাত্রাটা অনেক বেড়ে যায়। কাতারী মালিক তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিংবা অফিসের কর্মচারীদের রমজান মাসে কার্টুন ভর্তি খেজুর, দুধ, দই, জুস সহ নিজস্ব খামারের সবজি হাদিয়া হিসাবে দান করেন। কাতারী নাগরিকেরা বাজারের চেয়ে প্রচুর কম মূল্যে সরকারী রেশন হিসাবে উন্নত মানের চাল, তেল, ঘি, চিনি ইত্যাদি পেয়ে থাকেন। রমজানে এই চাল এবং তেলেরও কিছু অংশ তারা নিজের কর্মচারীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। অনেকে নিজের খরচে পালাক্রমে কর্মচারীদের উমরা এবং হজ্জ করিয়ে আনেন। প্রতিবছরই রমজান মাসে যাকাতের টাকা সংগ্রহ জন্য বাংলাদেশের মাদ্রাসা এবং মসজিদ থেকে বহু মানুষ আসেন কাতারে। এদের কেউ নিরাশ হয়ে ফিরে যান না।
পবিত্র রমজানের সময় কাতারের বিভিন্ন এলাকায় কাতারী শেখ এবং ধনী কাতারী নাগরিক সাধারণ মানুষ এবং শ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে ইফতার বিতরণ করেন। এজন্য ইফতারির আগে ধনী শেখদের বাড়ীর ফটকে ইফতার সংগ্রহ করার জন্য লম্বা লাইন লেগে যায়। এদের অধিকাংশই হলেন পাকিস্তানী পাঠান এবং প্রবাসী বাংলাদেশি। কে আগে যাবেন সে নিয়ে বিশাল লাইনে অনেক সময় হট্টগোল বেধে যায়। দুঃখজনক হল, লাইনে দাঁড়ানো বাংলাদেশিদের মধ্যেই এই প্রবণতা বেশী দেখা যায়।
এছাড়া রাস্তা-ঘাটে গাড়ীর থামিয়ে অনেকে পথচারীদের মধ্যে ইফতার বিতরণ করেন। মহাসড়কে চলমান ভারী যানবাহনের চালকদের নিয়মিত ইফতার সামগ্রী বিতরণ করে কাতারের ট্রাফিক বিভাগ। ইফতারের আগে চালকদের তাড়াহুড়োর কারণে মহাসড়কে যানজট সৃষ্টি এবং দুর্ঘটনা এড়াতেই এই কার্যকর্ম শুরু করেছে ট্রাফিক বিভাগ।
কাতারের প্রশাসনিক ক্ষমতা কিছু প্রভাবশালী পরিবারের মধ্যে সীমিত। বিভিন্ন ক্ষমতাধর পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য রেখে গঠিত হয় মন্ত্রীসভা। নামের শেষে পদবী বা পারিবারিক নাম দেখেই বুঝা যায় কে কতটা ক্ষমতা রাখে। কাতারের কিছু প্রভাবশালী পরিবারের নাম দিচ্ছি- যেমন আল-থানী, আল-আত্তিয়াহ, আল-মাহমুদ, আল-কুআরী, আল-ইমাদী, আল-সাদা, আল-সুলাইতি ইত্যাদি। কাতারের বর্তমান আমীর হলেন হলেন আল-থানী পরিবারের সদস্য। তাই যাদের নামের শেষে থানি রয়েছে তাদের মর্যাদা অন্যান্য সবার চেয়ে আলাদা। আমার ছোটো মেয়ে কাতারের ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ স্কুলে পড়ে। এই স্কুলের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী হল বৃটিশ নাগরিক। আমার মেয়ের একই ক্লাসেই পড়ে থানি পরিবারের সন্তান। স্কুলের প্রধান ফটকের পাশে দুটো গাড়ী পার্কিং করার জায়গা রয়েছে। ওখানে পুলিশ এবং থানি পরিবারের গাড়ী ছাড়া অন্য কাউকে গাড়ী রাখতে দেয়া হয়না। এটা স্কুলের নিয়ম বহির্ভূত বলে বৃটিশ বাবা-মায়েরা বহুবার স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছে, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। এধরনের বহু অলিখিত আইন চালু রয়েছে কাতারে। সব কাতারীই যে ধনী তা নয়। কেবল ধনী এবং ক্ষমতাধর পরিবারের কাতারী নাগরিকদের শেখ বলে ডাকা হয়। আর শেখের বাড়ী খুব সহজেই চেনা যায়। রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছেন, হঠাৎ দেখবেন ফুটপাতের গা ঘেঁষে উঁচু দেয়াল ঘেরা বিশাল অট্টালিকা। দেয়ালের উচ্চতা দেখে মনে হবে যেনো রহস্য ঘেরা প্রাসাদপুরী। শেখের বাড়ীর প্রাচীর সংলগ্ন রাস্তার ফুটপাতও থাকে শেখের দখলে। ফুটপাত জুড়ে খেজুর গাছ কিংবা বিশাল আকারের টব রাখা থাকে। আর ওই ফুটাপাতটুকু বরাবর রাস্তায় অন্য কারো গাড়ী রাখাও নিষিদ্ধ। যদিও ট্রাফিক আইনে এসব কথার উল্লেখ নেই কিন্তু শেখদের জন্য রয়েছে অলিখিত আইন। সেই আইন ভাঙ্গে সাধ্য কার? (চলবে)
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
 আব্দুল্লাহ আল-মামুন, কাতার থেকে
|