bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন





কাতারের সুখ দুঃখ - ১৩
আব্দুল্লাহ আল-মামুন



আগের পর্ব পরের পর্ব


কা’বার পথে – ৬: হিরা গুহার সন্ধানে - নুর পাহাড়ের চুড়ায় রয়েছে মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী হিরা গুহা। আমার কন্যা মুনিরাকে সাথে নিয়ে আছরের নামাজ পড়েই নূর পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। বিকেল সোয়া চারটার মধ্যে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম নুর পাহাড়ের পাদদেশে। দেরী না করে শুরু করে দিলাম হিরা গুহার সন্ধানে পথ চলা। আমাদের আশে পাশে বেশ কিছু তুর্কি হাজ্জীদের দল দেখলাম। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল ১৪০০ বছর আগে মহানবীর হেঁটে যাওয়া পথ বেয়ে চলতে পেরে। যেতে দেখলাম মানুষের উঠার সুবিধার জন্য পাথর দিয়ে সিঁড়ি তৈরি করে দেয়া হয়েছে ফলে পথ খুঁজে পেতে অসুবিধা হচ্ছিলনা। নুর পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আবার একটু নেমে গেলেই পাওয়া যাবে হিরা গুহা। হিরা গুহার কাছেই রয়েছে একটি দোকান, ঠাণ্ডা পানীয় ও স্যুভেনিয়র বিক্রি হয় এখানে। পাকিস্তানী পাঠান কিংবা ভারতীয় কাশ্মীরি মুসলিমরা চালাচ্ছে এই দোকান। জানতে পারলাম স্থানীয় উপমহাদেশের স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে তৈরি করা হয়েছে পাহাড় বেয়ে উঠার সরু রাস্তা।

উঠতে গিয়ে মনে হচ্ছিল এইট এই পথ দিয়েই হয়ত মহানবী পাহাড় বেয়ে উঠতেন। হয়তো ওই পাথরটাতে বসে কখনো জিরিয়ে নিতেন। কিছুদূর উঠার পর আমার বেশ শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল কিন্তু মুনিরাকে বেশ সতেজ মনে হল। প্রচুর পানি খাচ্ছিলাম আর ঘন ঘন জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। একটু পরেই হিরা গুহা ফেরত একজন হাজ্জী জানালেন পানির বোতল সাবধানে রাখতে কারণ বেবুনের দল পানির বোতল ছিনিয়ে নিতে পারে। শুনে মুনিরা ভয় পেয়ে গেল। যাই হোক পানির বোতলগুলি প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে ভাল করে মুড়িয়ে নিলাম । অবশেষে প্রায় ৪০ মিনিটের মধ্যে পাহাড়ের চূড়ায় চলে এলাম। দেখলাম বেশ বড় সড় টিনের ছাউনি ও পাথরের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি একটি দোকান। চাও বিক্রি হচ্ছে। অনেকে বেঞ্চে বসে জিরিয়ে নিচ্ছে আবার কেউবা চা কিংবা পেপসি খাচ্ছে। নুর পাহাড় শৃঙ্গের উচ্চতা প্রায় ২,৫০০ ফুট। হিরা গুহার অবস্থান নূর পাহাড়ের ঠিক চূড়াতে নয়। তাই আর দেরী না করে আমরা পাহাড়ের চূড়া বেয়ে হিরা গুহার দিকে নামতে থাকলাম। নামার পথ খুবই খাঁড়া।

একটু পরেই চলে আসলাম হিরা গুহার কাছে। তবে ঢোকার মুখেই রয়েছে একটি বিশার পাথর ফলে এপাশ থেকে বোঝার উপায় নেই যে ওপাশে রয়েছে হিরা গুহা। পাথরটির দু’পাশে রয়েছে খুবই সরু দু’টো পথ যা বেশ অন্ধকার ও ভয়ংকর মনে হল। ওই সরু পথ দিয়ে বের হলেই চোখে পড়ল হিরা গুহা। তখন গুহার মুখে বেশ ভিড়। চারিদিক তাকিয়ে দেখে অবাক হলাম। দূরে দেখা যাচ্ছিল ধুয়োর আচ্ছাদনে ঢাকা মক্কা শহরের স্কাই লাইন ও মসজিদুল হারামের পাশের সেই বিশাল টাওয়ার। হিরা গুহার অবস্থান এমন যে ভেতরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে কেবলা-মুখী হয়ে নামাজ পড়া যায়। গুহাটি বেশ ছোট, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে যথাক্রমে ৬ ও ১২ ফুট হবে আর উচ্চতায় একজন মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াবার মত জায়গা নেই। ভাবছিলাম ১৪০০ বছর আগে এটা ছিল জন- মানবহীন একটি দুর্গম পাহাড়। সৃষ্টিকর্তাকে জানার অদম্য আগ্রহ নিয়ে এই পাহাড় বেয়ে নিয়মিত উঠে রাতের গহীন অন্ধকারে হিরা গুহার নির্জনতায় বসে ধ্যান করা একজন মানুষের পক্ষে কি করে সম্ভব তা ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। রাসুল (সাঃ) একজন অসাধারণ মানুষ বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। মনে হল এত বই পুস্তক পড়ার পরও হিরার গুহায় নিজে না গেলে এই সত্য অনুধাবন করা কখনোই সম্ভবপর ছিলনা।



নুর পাহাড় ও হিরা গুহা, কর্তৃপক্ষের চোখের আড়ালে বড্ড অবহেলায় পড়ে আছে । পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে বিভিন্ন ভাষায় লিখা বিশাল এক সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে যদিও পাহাড়ে আরোহণের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহর নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে কিন্তু ঐতিহাসিক সূত্রমতে জানা যায় রাসুল নিজেও পরবর্তীকালে সাহাবীদের সাথে নিয়ে নুর পাহাড়ে এসেছেন। শুনেছি হিরা গুহা ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করেছিল সৌদি কর্তৃপক্ষ। সাইনবোর্ডের লিখা দেখেই বোঝা যায় কর্তৃপক্ষ চায়না মানুষ এখানে আসুক। মানুষ যাতে ইসলাম বিরোধী কাজ করতে না পারে সে জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য কয়েকটি পুলিশ কিংবা সিকিউরিটি গার্ড দিলেই কাজ হয়ে যেতো। মানুষ ধর্ম বিরোধী কাজ করতে পারে সেই ভয়ে সব কিছু ভেঙ্গে ফেলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে এটা কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। প্রতিটি জাতির বিশেষ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাদের অতীত ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতীতের ফেলে আসা নিদর্শন ও ইতিহাস থেকে একটি জাতি সামনে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা ও দিক নির্দেশনা খুঁজে পায়। যে জাতির অতীত নেই তার ভবিষ্যৎ থাকবে কি করে? দুঃখজনক হলেও সত্য সৌদি কর্তৃপক্ষ ধর্ম রক্ষার নামে ইতিহাস মুছে ফেলে নিজেদের সাথে সমগ্র বিশ্বের মুসলিমদের সামনে চলার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে।

সত্যি বলতে কি সৌদি সরকারের অনেক পদক্ষেপ স্ববিরোধী। মসজিদুল হারামের চতুর্দিকের গেইটগুলোর ঐতিহাসিক নাম বদলে দেয়া হচ্ছে। মসজিদুল হারামে প্রবেশের সবচেয়ে বড় গেইটের নামকরণ করা হয়েছে সৌদি বাদশাহের নামে যেটা ইসলামের অন্যতম খলিফা হযরত উমরের নামে যে গেইট রয়েছে তার প্রায় ১০ গুন বড়। শিরিকের আশংকায় ইসলামিক ইতিহাসের চিহ্ন মুছে ফেলা হচ্ছে অথচ সৌদি বাদশাহের বিশাল প্রতিকৃতি ঝুলিয়ে রাখতে কোন বাধা নেই। কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি হাজ্জীদের আচরণ দেখেও হতাশা ও ক্ষোভে ভরে গেল মন। হাজ্জীদের ছুড়ে ফেলা বোতল ও ক্যানে সমস্ত পাহাড় যেন একটা খোলা গার্বেজ বিনে পরিণত হয়েছে। পুণ্য করতে আসা মানুষের এই আচরণ সত্যিই বেদনাদায়ক। আবর্জনা ফেলার জন্য কিছু গার্বেজ বিন দেয়া যেতো। কিন্তু সমস্যা হল এই বিন নিয়মিতভাবে পরিষ্কার করবে কারা? সওর ও নুর পাহাড়ের সবকিছুই চলছে কিছু স্বেচ্ছাসেবকদের প্রচেষ্টাতে। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোন মাথাব্যথা আছে বলে বলে মনে হলোনা।

ইতিহাসের প্রতি আমার সীমাহীন আকর্ষণ ছোট বেলা থেকেই। ছেলে বেলায় দেখা বগুড়ার মহাস্থান গড়, নাটোরের রাজবাড়ী, চাটগার ওয়ার সিমেট্রি কিংবা কুমিল্লার কোট বাড়ীর ঐতিহাসিক নিদর্শন এখনও আমাকে টানে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে মাত্র ১০০ বছরের পুরনো নিদর্শন ধরে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের যে প্রচেষ্টা দেখেছি মক্কার হাজারো বছরের ঐতিহ্যকে রক্ষা করার জন্য সরকারের তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়লোনা। যা আমাকে হতাশ করেছে।



মসজিদুল হারাম নিয়েই শুরু করা যাক। মসজিদুল হারামের মাত্র ১০০ মিটারের মধ্যে গড়ে উঠেছে আকাশচুম্বী অট্টালিকা, বহু তারকা খচিত হোটেল, ও বাদশার প্রাসাদ। ১নং গেইটের ঠিক উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে “আবরাজ আল-বাইত” টাওয়ার যা মনে হয়েছে বিশাল দানবের মত গ্রাস করছে কা’বাকে। মসজিদুল হারামের অভ্যন্তরে বসে কা’বার দিকে তাকালে চোখ কেড়ে নেয় এই টাওয়ার, হিল্টন, ইন্টার কন্টিনেন্টাল সহ আরো অনেক স্কাইস্ক্রেপার। মসজিদুল হারামের তুলনায় আবরাজ টাওয়ার এতই বিশাল যে মানুষ কা’বা ঘর বাদ দিয়ে ওই স্কাইস্ক্রেপারের ছবি তুলতে ব্যস্ত। মসজিদুল হারামের ভিতর প্রবেশ না করলে দূর থেকে এখন বুঝার উপায় নেই যে কা’বার কাছে এসেছি।

হাজ্জীদের থাকার জন্য হোটেল, ও এপার্টমেন্টের প্রয়োজন আছে কিন্তু তা ইতিহাসকে ধ্বংস করে নয়, কা’বার আধ্যাত্মিক আত্মাকে গ্রাস করে নয়। মসজিদুল হারামকে ঘিরে এক কিলোমিটারের মধ্যে আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা যাতে না ওঠে সেদিকে খেয়াল রেখে উচ্চতারে ব্যাপারে বিধি নিষেধ আরোপ করে অনায়াসেই বিল্ডিং নির্মাণ করা যেতো। আমার মনে হয়েছে কিভাবে মুনাফা করা যায় সেটাই হল কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য। পরিবেশ, ইতিহাস ও পুরানো স্থাপত্য কোন বিবেচনায় নেই। কা’বার কাছে ধারের জায়গাগুলি হল রিয়েল এস্টেটের মানদণ্ডে সবচেয়ে মূল্যবান তাই ঐতিহাসিক মনুমেন্ট উপড়ে ফেলে কা’বার পাশেই বিগ ব্রাদারের মত গড়ে তোলা হয়েছে এই সব দালান বাড়ী।

সম্প্রতি মসজিদুল হারাম সম্প্রসারণের জন্য ২০ বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্টের কাজ চলছে। এই প্রজেক্টের আওতায় মসজিদুল হারামের গা ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ তলার হোটেল ও এপার্টমেন্ট । আল্লাহর নির্দেশে তৈরি কা’বার চতুর্পাশ পরিণত হচ্ছে ইট পাথরের তৈরি পার্কিং লট যাতে চাকচিক্য থাকবে অনেক কিন্তু থাকবেনা শুধু মহান সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি। মাত্র তিন বছর আগেও জমজম কূপের কাছে যাওয়া যেতো। এখন কংক্রিটের আস্তরে ঢেকে দেয়া হয়েছে পুরো এলাকা। সাফা পাহাড়ের কাছেই ছিল ছোট্ট একটি ঘর যেখানে রাসুল (সাঃ) ইসলামের দাওয়াত দিতেন এবং এইখানেই হযরত ওমর ইসলাম গ্রহণ করেন। চিহ্ন সরূপ এই যায়গায় ছিল দারে-আরকাম নামে একটি গেইট। অনেক খুঁজেও তা পেলামনা।

যতদূর জানা যায়, রাসুলল্লাহর সময়কার মাত্র ২০টির মত ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ এখনো টিকে আছে তবে এগুলি যে কোন সময়ে বুলডোজারের ঘায়ে হারিয়ে যেতে পারে। মহানবীর মাতা বিবি আমিনা’র কবর বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। রাসুলল্লাহর জন্মস্থানে এখন যে লাইব্রেরীটা রয়েছে সেটা ভেঙ্গে ফেলে গাড়ীর পার্কিং তৈরি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। রাসুলুল্লাহর জন্মস্থানের পাশেই তৈরি হয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং। এখানেই ছিল আবু তালিবের উপত্যকা যেখানে ইসলাম প্রচারের প্রথম যুগে রাসুল (সাঃ), তাঁর পরিবার ও অনুসারীদের সমাজ থেকে আলাদা করে দিয়ে অনেকটা নির্বাসনে রাখা হয়েছিল। এছাড়া বিবি খাদিজার বাড়ী ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, হযরত আবু বকরের বাড়ীর ভেঙ্গে তৈরি হয়েছে হিল্টন হোটেল।

সাফা পাহাড়ের কাছেই হল জবলে কুবাইস যা ভেঙ্গে মসজিদুল হারামের ১৫০ মিটারের মধ্য তৈরি হয়েছে সৌদি রাজার প্রাসাদ। এই পাহাড়ে দাঁড়িয়ে রাসুল (সাঃ) প্রথম খোলামেলা ভাবে কুরাইশদের ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। সেই ঘটনার কথা অনেকরেই জানা। তাছাড়া এই পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে রাসুলের চন্দ্র দু’ভাগ করার ঘটনা মানুষ দেখেছিল। জবলে কুবাইসেই ছিল বিলাল মসজিদ কিন্তু সেটাও রাজ প্রাসাদের নিরাপত্তার কারণে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। আগামী ক’বছরের মধ্যে হয়ত আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা। ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষার আবেদন জানিয়ে সৌদি পত্র পত্রিকায় সেই দেশের অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানীদের লিখা আমি পড়েছি। কিন্তু তাঁদের আকুতি সৌদি কর্তৃপক্ষের কানে গিয়েছে কিনা জানিনা। উমরা করার পর মনে হয়েছে এ বছর যা দেখলাম আগামী বছর তার হয়ত অনেক কিছুই থাকবেনা। নিজেকে ধিক্কার দিলাম আরো আগে না আসার জন্য।

মক্কা শহরে কাটালাম মাত্র চারদিন। এতো স্বল্প সময়ের মধ্যে কা’বার শহর মক্কা হৃদয়ের গভীরে এতোটা জায়গা করে নেবে ভাবিনি। বিদায়ের ঘণ্টা শুনতে পাচ্ছি। দু’দিন পরেই ফিরে যাচ্ছি দোহার নিশ্চিত গন্তব্যে। কিন্তু মনে হল, কা’বার পথে আমাদের যাত্রার এযে কেবল শুরু......(চলবে)




আগের পর্ব পরের পর্ব




আব্দুল্লাহ আল-মামুন, কাতার থেকে




Share on Facebook               Home Page             Published on: 9-Feb-2018

Coming Events: