 কাতারের সুখ দুঃখ - ১১ আব্দুল্লাহ আল-মামুন
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
কা’বার পথে – ৪: মসজিদুল হারামের অভ্যন্তরে - আছর থেকে ইশা নামাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি পুরো মসজিদুল হারাম ঘুরে ঘুরে দেখলাম, মসজিদের ছাদেও গেলাম। মসজিদের ভেতরে কিছুদূর পর পর রয়েছে টেপ লাগানো জমজম পানির ট্যাংক। যতদিন মক্কায় ছিলাম পানি কিনে খেতে হয়নি। ছোট বড় বোতল এমনকি বড় কন্টেইনারেও জমজমের পানি ভরে নিচ্ছে সবাই। পানির ট্যাংক খালি হলেই সাথে সাথে বদলে দিচ্ছে সেবকের দল। মসজিদুল হারাম পরিষ্কার করা ও পানি সরবরাহ ইত্যাদি করার জন্য রয়েছে একঝাক সবুজ পেষাক পরিহিত সেবকের দল। এদের অধিকাংশই হলেন বাঙ্গালী। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বিরতি হীনভাবে এরা কাজ করে চলেছে। এক মুহূর্তর জন্যও তাদের শিথিল হতে দেখলাম না। হয়ত আল্লাহর ঘর বলে এ ধরণের আন্তরিকতা যদিও এদের বেতন হল খুবই অল্প। সত্যি বলতে কি এই ক্লিনারদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই কাবার পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। প্রতি ওয়াক্তের নামাজের সময় দিনে পাঁচবার কাবাঘরের দরজার ঠিক নীচের উন্মুক্ত দেয়াল, কালো পাথর ইত্যাদি পরিষ্কার করা হচ্ছে । কাবার ব্যবস্থাপনাকে ধন্যবাদ জানাতেই হয় এজন্য।
এছাড়া মসজিদের সব জায়গাতেই শেল্ফ জুড়ে থরে থরে সাজানো রয়েছে পবিত্র কুরআন। হাজীদের অনেকেই কুরআন কিনে এখানে রেখে যান সওয়াবের জন্য। এছাড়া বিভিন্ন তলায় উঠার জন্য রয়েছে লিফট ও চলমান সিঁড়ি। ওমরা ও হজ্জ্বের সময় বিবিধ কারণে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। তাই প্রতি ওয়াক্তের নামাজের পর পরই নিয়মিত জানাজার নামাজ পড়ানো হয়। অনেক লাশ মক্কা ছাড়া অন্যান্য এলাকা থেকেও আসছে কাবায় জানাজা পড়ানোর জন্য। হজ্জ্ব করার সময় যদি কারো মৃত্যু হয় তাহলে ইচ্ছে করলে তাকে মক্কায় কবর দেয়া যায়।
কাবা ও মসজিদুল হারাম এলাকা জুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সত্যিই প্রশংসনীয়। দুই ধরণের নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। খাকি পোশাক পরিহিত পুলিশ ও মেটে রংয়ের আলখেল্লা ও মাথায় সৌদি স্কার্ফ পরিহিত ধর্মীয় পুলিশ বা মুত্তাওয়া। মুত্তাওয়ার কাজ হল ওয়াহাবী মতবাদ ভিত্তিক ধর্মীয় অনুশাসন পালিত হচ্ছে কিনা তার খবরদারী করা । সৌদিতে মুত্তাওয়াদের রয়েছে প্রচুর ক্ষমতা। যদিও মসজিদে সাধারনতঃ পুরুষ ও মহিলাদের জন্য থাকে আলাদা যায়গা কিন্তু কাবাই হল একমাত্র ব্যতিক্রম যেখানে মহিলা ও পুরুষ একসাথে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতে পারেন। সাধারণ মসজিদের সাথে একে গুলিয়ে ফেললে চলবেনা। কিন্তু প্রতি ওয়াক্তের নামাজের সময় মহিলাদের যে রকম নির্মমভাবে সরিয়ে দেয়া হয় তা আমার কাছে সঠিক মনে হয়নি।
কাবার চতুর্দিকে তাওয়াফ করার জন্য যে বৃত্তাকার খোলা চত্বর তাকে বলা হয় মাতা’ফ। তবে এই মাতা’ফে মহিলাদের জন্য যে পরিমাণ যায়গা দেয়া হয়েছে তা পুরো এলাকা অর্থাৎ পুরুষদের জন্য দেয়া জায়গার তুলনায় খুবই নগণ্য। এছাড়া মসজিদুল হারামের ভিতরে মহিলাদের জন্য নির্ধারিত যায়গা উঁচু গ্রিল দিয়ে ঘেরাও করা যা দেখতে অনেকটা খাঁচার মত ফলে নামাজের জায়গায় বসে কাবা ঘর কিংবা ইমামকে দেখা যায়না। অথচ দু’দশক আগেও মহিলাদের নামাজ পড়ার জায়গা মাটিতে শুধু একটি সীমারেখা টেনে নির্ধারিত করা ছিল। আল্লাহর ঘরে এসেও এ ধরনের বিভাজন আমি মেনে নিতে পারছিলামনা। মদিনায় মসজিদে নববীতে এখন মহিলাদের আর রাসুলের রওজার কাছে ধারে যেতে দেয়া হয় না। শুনলাম মতা’ফের ছোট্ট এলাকা থেকেও মহিলাদের সরানোর প্রস্তাব দিয়েছে কাবা এফেয়র্স রিভিউ প্যানেল। ইসলামের ইতিহাসে, রাসুলের সময়ও মহিলাদের কাবার কাছে বসে প্রার্থনা করার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়নি। কিন্তু এখন এ কি ঘটছে? মহিলাদের মাতা’ফ এলাকা থেকে সরানোর জন্য রিভিউ প্যানেলের যুক্তি হলঃ ভিড় কমানো, মহিলাদের নিরাপত্তা, তওয়াফের সময় মানুষ চলাচল ও টিভি সম্প্রসারণের সুবিধা করে দেয়া। তার মানে কাবার চারপাশ কেবল থাকবে পুরুষদের দখলে, এই কথা কোথায় লেখা আছে রিভিউ প্যানেল কি বলতে পারবেন? কাবার তোয়াফ এলাকায় (মাতা’ফ) দিন রাত্রি থাকে ভিড়। কিন্তু নিরাপত্তার নামে মহিলাদের সরিয়ে দিতে হবে এ কেমন কথা? তার মানে পুরুষদের উপস্থিতির জন্য যে ভিড় হচ্ছে, নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে সেটা গণ্য করার কি দরকার নেই? মনে রাখতে হবে কাবায় মহিলারা পুরুষদের মন ভোলাতে যাননা। অন্যান্য সবার মত জীবনের সঞ্চয় ব্যয় করে খোদার সান্নিধ্যে কিছুটা সময় কাটাতেই কাবা শরীফে যান। আর রিভিউ প্যানেলের কাছে কাবার টিভি সম্প্রচার মহিলা হাজ্জীদের ইবাদতের চেয়ে কেন বড় মনে হল ভেবে পাইনা।
মাতা’ফ থেকে মহিলাদের সরানোর কাজ করে থাকেন মুত্তাওয়ার দল। ওয়াক্তের নামাজের সময় হতেই দেখা যাচ্ছে কোন মহিলা হাজ্জী তখনো তোয়াফ শেষ করেননি অথচ মুত্তাওয়া তাদের পেছনে পাঠিয়ে দিচ্ছে। নামাজের জন্য মাতা’ফে ইতিমধ্যে অনেকেই বসে গেছেন এই অবস্থায় পেছনে যাওয়া অনেকটা অসম্ভব আর তখন মসজিদের ভেতরে ও বাইরে মহিলাদের জন্য নির্ধারিত এলাকাও পরিপূর্ণ, কোথাও ঠাঁই পাবার যো নেই। মুত্তাওয়াদের অনেক সময় মহিলাদের গায়ে হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে দেখলাম। মহিলাদের সরানোর জন্য দিনে পাঁচবার মুত্তাওয়ার দল যে সময় ও শক্তি ব্যয় করছে তা আমার কাছে অপচয় বলে মনে হয়েছে। ওই সময়টা যদি তারা অন্য কাজে ব্যয় করতেন তাহলে হাজ্জীদের অনেক উপকার হত। আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা মহিলা পুলিশও দেখলাম টহল দিতে। আরো রয়েছে মহিলা ক্লিনার। ডিজিটাল ও ভিডিও ক্যামেরা দেখলে পুলিশ সাথে সাথে কেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেও মানুষ ছবি তুলছে, ভিডিও করছে। যেমন আমি ছবি তুলেছি। মোবাইল ফোনে ছবি তোলা সবচেয়ে সহজতর মনে হল। একবার আমার ডিজিটাল ক্যামেরা কেড়ে নেয় পুলিশ, তবে সিম কার্ড বের করতে ব্যর্থ হলে আবার ফেরত দিয়ে দেয়। উল্লেখ্য মসজিদুল হারামের ছাদে বসানো হয়েছে চারটি টিভি ক্যামেরা যা দিয়ে প্রতি ওয়াক্তের নামাজ সরাসরি সৌদি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়ে থাকে। মদিনার মসজিদে নববী থেকেও তাই করা হয়।
১০ই এপ্রিল, শুক্রবার। আজ মক্কায় আমাদের দ্বিতীয় দিন। ফজরের নামাজ পড়ে আবারো উমরা পালন করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আমার মেয়ে মুনিরা খুবই ক্লান্ত তাই ওকে এবার সাথে নিলামনা। মক্কার অনতিদূরেই রয়েছে হযরত আয়েশার (রাঃ) স্মৃতি বিজড়িত বিশাল মসজিদ আল-তানিম, যাকে আয়েশা মসজিদও বলা হয়। হযরত আয়েশা (রাঃ) হজ্জ্বের পর পর উমরা করতে চাইলে রাসুল (সাঃ) তাঁকে আল-তানিমে গিয়ে ইহরাম বাধার নির্দেশ দেন। এই ঘটনাটি ঘটে রাসুল (সাঃ) এর বিদায় হজ্জ্বের সময়। সেই থেকে মক্কার অধিবাসী ও যারা মক্কায় হজ্জ কিংবা উমরা করার জন্য আসছেন তাদের জন্য ইহরাম বাধার মিকা’ত হল এই মসজিদ এলাকা। ট্যাক্সি নিয়ে উমরা মসজিদে গেলাম ভাড়া মাত্র ১০ রিয়াল। তখনো ভোর হয়নি। আকাশের জানালা দিয়ে ভোরের সূর্য কেবল উঁকি দিতে শুরু করেছে দুরের দিগন্তে। গোছল সেরে দু’রাকাত নামাজ পড়ে মাইক্রোবাসে চড়ে মসজিদুল হারামে চলে আসলাম। কাবা তোয়াফের সময় পায়ে আবারও বড্ড ব্যথা পাচ্ছিলাম। আর সা’ঈ করার সময় আমি রীতিমত খোঁড়াচ্ছিলাম। এভাবে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পুনরায় উমরা শেষ করলাম।
মক্কায় প্রতি নামাজের ওয়াক্তের সময় দোকান-পাট সব বন্ধ করে সবাই মসজিদে নামাজ পড়তে চলে যান। অবাক করা কথা হল, কেউ তাদের দোকানের পণ্য সামগ্রী এক টুকরো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন কেউবা আবার সম্পূর্ণ খোলা রেখেই নিশ্চিন্তে নামাজ পড়তে চলে যান। দোকান জুড়ে খোলা পড়ে থাকে যাবতীয় সামগ্রী। বিংশ শতাব্দীতে এমন ঘটনা মক্কায় আসার আগে কখনো কোথাও চোখে পড়েনি। এমনটা বিশ্বের কোথাও সম্ভব কিনা জানিনা … (চলবে)
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
 আব্দুল্লাহ আল-মামুন, কাতার থেকে
|