 কাতারের সুখ দুঃখ - ১০ আব্দুল্লাহ আল-মামুন
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
কা’বার পথে – ৩: আমরা তিন জনই এই দৃশ্য দেখে অজানা এক আকর্ষণে সম্মোহিত হয়ে গেলাম। এতদিন শুধু ছবির পাতায় যে কাবার ছবি দেখেছি সেই কাবার সামনে দাঁড়িয়ে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলায় কেঁপে উঠল হৃদয় মন। এই কি সেই হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাইলের তৈরি কাবা যার দিকে নুয়ে পড়ে বিশ্বের লক্ষকোটি মুসলিম সমর্পণ করছে নিজের স্বত্বাকে সৃষ্টিকর্তার দরবারে প্রতিদিন? এই কি সেই কাবা যার সুরক্ষার ভার নিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা নিজেই আর পরম ক্ষমতাধর আবরাহার বাহিনী যাকে করতে পারেনি স্পর্শ? এই কি সেই কাবা যার পাদদেশ থেকে স্ফুরিত জমজমের অফুরন্ত জলধারা মেটাচ্ছে বিশ্বের তাবৎ মুসলিমের শারীরিক ও আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা? ইহরামের কাপড় পড়ে মসজিদুল হারামের মধ্যে পা রাখার পর এতদিনের আমির সাথে আজকের আমির একটা পার্থক্য অনুভব করলাম। শেষ বিচারের দিন যেমন দুই টুকরো কাপড় পড়ে সবাই হাজির হবে মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে ঠিক তেমনি একই পোশাকে নিজের পাপে ভরা এই দেহ মন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আজ খোদার ঘর কাবার সামনে। নিজেকে অসহায় ও খুবই নগণ্য মনে হচ্ছিল।
ধীরে ধীরে আমরা সাদা মার্বেল পাথরে বোনা কাবার মূল চত্বরে নেমে পড়লাম আর তওয়াফ-রত হাজারো মানুষের ভিড়ে একাত্ম হয়ে গেলাম। প্রথমে চেষ্টা করলাম কাবার কাছ ঘিরে তওয়াফ করতে কিন্তু কাছেই ঘেষতে পারছিলাম না। তাই ঠিক করলাম আগে তাওয়াফ সেরে নেই পরে কাবা ঘরের কাছে যাবো। তাওয়াফকারীদের মধ্যে মহিলার সংখ্যা প্রায় পুরুষের সম পরিমাণ। গাইড সহ হাজ্জীদের বিরাট সংঘবদ্ধ দলও দেখলাম। সাধারনতঃ ইরান ও তুর্কি থেকেই হাজীরা এমন বড় আকারের দলে এসে থাকেন। কিছু ইন্দোনেশিয়ান হাজ্জীর দলও রয়েছে। দলের সহযাত্রীরা খুবই শৃংখলাবদ্ধভাবে দলের নেতাকে অনুসরণ করছে যা সত্যিই অনুকরণীয়। ইরানী গ্রুপের অধিকাংশই মহিলা। প্রতিটি গ্রুপের সদস্যদের পরিধেয় কাপড়ের পেছনে রয়েছে এক ধরনের সংকেত যাতে কেউ গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়। গেইট ৪৫ দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়ে মাকামে ইব্রাহীম তাই সেখান থেকেই আমরা তাওয়াফ শুরু করলাম।
হজরে-আসওয়াদ বা কালো পাথরের কর্নারে আসতেই প্রচণ্ড রকমের চাপ অনুভূত হল কারণ সবাই কালো পাথরের কাছে যেতে চাচ্ছিল। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। কালো পাথরের কাছে আসতেই উচ্চকিত কণ্ঠস্বরে আল্লাহু আকবার ধনিতে প্রকম্পিত হচ্ছিল আকাশ বাতাস। কাবার দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি শুধু হাত আর হাত। হাতের আঙ্গুল দিয়ে দরজার চৌকাঠ ছাড়িয়ে উঁচুতে আরো উঁচুতে ছুঁতে সবার কি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা! এবার চেষ্টা করে দেখলাম কালো পাথরের কাছে যেতে কিন্তু একজন বিশাল দেহের হাজ্জী মারদাঙ্গা মুডে যেভাবে সবাইকে ঠেলে হজরে আসওয়াদের দিক থেকে বেরিয়ে আসল তাতে জনতার চাপে মুনিরার স্যান্ডউইচ হয়ে যাবার দশা। আপাততঃ হাল ছেড়ে দিলাম। যাই হোক যথারীতি তাওয়াফ শেষ করে মাকামে ইব্রাহীমের পেছনে দাঁড়িয়ে দুই রাকাআত নামাজ শেষ করলাম। মাকামে ইব্রাহীম আগে কাবার সংলগ্ন ছিল কিন্তু হজ্জ/উমরার অংশ হিসাবে দুই রাকআত নামাজ পড়ার সময় তাওয়াফের বিঘœ ঘটে বলে হযরত উমর একে কাবা ঘর থেকে একটু দুরে সরিয়ে আনেন। নামাজ শেষ করে স’াঈ করতে রওয়ানা দিলাম। সাফা মারওয়ার মধ্যে স’াঈ করার সময় পায়ের গোড়ালিতে ও পাতায় ব্যথা অনুভব করছিলাম। আমার স্ত্রী ও কন্যারও দেখি একই অবস্থা। ভেবে দেখলাম খালি পায়ে মার্বেল পাথরের উপর হাঁটার জন্যই হয়ত এই ব্যথা। স’াই শেষ করে সবাই হোটেলে ফিরলাম। প্রায় দু’ঘণ্টার মত লাগল প্রথম উমরা শেষ করতে। আমি হোটেলের কাছেই একটি সেলুনে গেলাম চুল কাটতে। যাবার পথে দুপুরের খাবার কিনে নিয়ে গেলাম। বাসে ঘুম হয়নি তাই সবাই খুবই ক্লান্ত। হোটেলে ফিরে খাওয়া দাওয়া শেষ করেই ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই।
ঘুম থেকে উঠেই মসজিদুল হারামে ফিরে গেলাম। আসরের নামাজের পর পর মনে হল কাবার আশেপাশে ভিড় একটু কমে এসেছে। তাই তওয়াফ-রত মানুষের সাথে কাবা ঘরের কাছে চলে আসলাম। কাবা ঘরের পশ্চিম দেয়ালে এসে সবাই গিলাফ ধরে দোয়া করলাম। গিলাফ ধরার সাথে সাথে নিজেকে মহান সৃষ্টিকর্তার খুবই কাছাকাছি মনে হল। ভাবছিলাম, এই কি সে ঘর যেথায় থাকেন জগতের অধীশ্বর, খোদা? খোদা তুমি থাক কোথায়? কোথায় তোমার বসবাস? কোথায় পাবো তোমার দেখা? এরপর আবার চেষ্টা করলাম কালো পাথরের কাছে যেতে। কাবার পূব দেয়ালে দরজার দিক থেকে দেখলাম মেয়েদের একটা লাইন তৈরি হয়েছে। আমার স্ত্রীকে বললাম চেষ্টা করে দেখতে। কিন্তু সবাইকে ঠেলে অনেকটা যুদ্ধ করে হজরে আসওয়াদের দিকে যেতে হবে বলে কেন জানিনা আমি উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। মনে হল আমি পাথর হয়ত স্পর্শ করতে পারবো কিন্তু এই অনুভূতি আমার হৃদয় স্পর্শ করতে পারবেনা। তাই পাশ কেটে কাবার দরজায় হাত রাখলাম।
সমস্যা হল কেউ একবার কাবার দরজার কাছে গেলে আর সরে আসতে চাননা। আমি এবার বেশ সহজে জায়গা পেলাম। আমার পাশে কেউ হাত তুলে কেউবা আবার কাবার দরজা আঁকড়ে ধরে জানাচ্ছে তাদের মিনতি। কান্নার সাইমুম ঝড়ে ভেসে যাচ্ছে অনেকে, কেঁপে কেপে উঠছে তাদের শরীর। আমি কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেললাম। বাইরে যদিও তখন কড়া রৌদ্দুর কিন্তু আমার বুকের উঠোনে মনে হল যেন টুপ টাপ বৃষ্টি পড়ছে। সেলির সাথে দেখা হতেই ওর চোখে মুখে দেখলাম প্রাপ্তির দ্যুতি। সেলি হজরে আসওয়াদ ছুতে পেরেছে। এর পর সবাই কাবার উত্তরে অর্ধবৃত্তাকার এলাকায় (আলÑহিজর) নামাজ পড়লাম। এই আল-হাজরাতেই ছিল বিবি হাজরার ছোট্ট কুঁড়ে ঘর। জানা যায় হযরত ইব্রাহীম (আঃ), বিবি হাজরা ও শিশু ইসমাইলকে এই যায়গাতেই নির্বাসনে রেখে চলে যান। আল-হিজরের সবটুকুই (বিবি হাজরার ঘর) আগে কাবা ঘরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু আজকের যে কাবাঘর আমরা দেখছি তাতে কেবল আল-হিজরার টুকরো অংশ সন্নিবেশিত হয়েছে। অন্য এক সূত্রমতে এই আল-হিজরাতেই বিবি হাজরা ও ইসমাইল (আঃ) কে সমাহিত করা হয়েছে। তবে এর সত্যতা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে।
বাঙালি পাড়ায় - যোহরের নামাজের সময় এসেছি কাবায়। ইশার নামাজ শেষ করার পর দারুণ খিদেয় সবার পেট চো চো করছিল। আমাদের হোটেলের আশেপাশের এলাকায় খাবারের দোকানের স্বল্পতা দেখে খুবই অবাক হলাম। হজ্জ্বের সময় এত মানুষের খাবার আসবে কোত্থেকে? শুনেছি কাবার অদূরে মিসফালা এলাকায় রয়েছে বহু বাংলাদেশি খাবারের দোকান। তাই আর দেরী না করে দেশিয় ডাল-ভাতের খোঁজে বেরুলাম। মক্কা ও মদিনার হোটেল, দোকান পাট থেকে শুরু করে বলতে গেলে সব যায়গায় পাওয়া যাবে বাঙালি যাদের অধিকাংশই হলেন চট্টগ্র্রামের অধিবাসী। আমাদের হোটেলের ম্যানেজার থেকে শুরু করে বয় বেয়ারা পর্যন্ত বাঙালি। জানতে পারলাম কাবার দক্ষিণের আব্দুল আজিজ গেট (নং ১) পার হয়ে সোজা গেলেই পড়বে মিসফালা আর সেটাই হল বাঙালী পাড়া।
১ নং গেটের কাছে হিল্টন হোটেলের পাশ দিয়ে নেমে গেছে মিসফালার রাস্তা। মিসফালার দিকে হেঁটে চললাম। রাস্তায় মানুষের ঢল। ইশার নামাজ শেষ করে সবাই সেদিনের মত যার যার গন্তব্যে ফিরে যাচ্ছেন। অবাক করা ভিড়। রেসকোর্সে মিটিং শেষ হলে রাস্তায় যেমন মানুষের ঢল নামে ঠিক তেমন। রাস্তার দু’পাশে ফেরিওয়ালাদের ভিড়। বোরকা, টুপি, জায়নামাজ, ছাতা, ঘড়ি থেকে শুরু করে সবই বিক্রি হচ্ছে। দামও সাধারণ দোকানের চেয়ে ৫/১০ রিয়াল কম। কিছু কেনা কাটাও করা হল। কাউন্সিলের গাড়ী আসছে খবর পেয়েই দেখি ফেরিওয়ালার দল ঝটপট সব গুটিয়ে নিয়ে যেদিক পারে দে দৌড়। সবুজ সংকেত পেয়ে আবার আসছে ফিরে। ফেরিওয়ালা দোকানদারদের প্রায় সবাই হলেন আফ্রিকান মহিলা। আরও দেখলাম রাস্তার মাঝখানে বসে/শুয়ে থাকা কিছু ফকির। ছোট ছোট শিশু ও বোরকা পরা মহিলাও ভিক্ষা করছে। এদের দেখে আফ্রিকার কোন দেশের বলে মনে হল। তবে টাকা দিতে গেলেই লেগে যায় ভিক্ষুকদের মধ্যে রীতিমত চুলোচুলি। পেশাদার ভিক্ষুকই বটে!
সামনেই দেখলাম সারি সারি অলঙ্কারের দোকান। আর কিছুদূর এগুলেই চোখে পড়ল ঢাকা, চট্টগ্রাম ও এশিয়া রেস্টুরেন্ট। চট্টগ্রাম রেস্টুরেন্টে বসে চাটগা স্টাইলের আলু ভর্তা, ডাল, মাছ দিয়ে তৃপ্তি ভরে খেলাম সবাই। আমাদের হোটেলে কোনো খাবারের দোকান না থাকায় খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেখলাম ইবাদতের ব্যাঘাত ঘটছিল। তাই পাশের দোকান থেকে দু’টো ছোট ডেকচি কিনে নিলাম ও বাংলা দোকান থেকে কয়েক বেলার খাবারও কিনে পার্সেল করে নিলাম। পরে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে চুলোয় গরম করে খেতাম। এইভাবে একটা বড় ধরণের ঝামেলা মুক্ত হলাম। পরে বাসের সহযাত্রীদের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম তাদের অনেকেই ফ্রোজেন করে পুরো সপ্তাহের খাবার ও চালও নিয়ে এসেছেন । এই ব্যাপারটা আমাদের জানা ছিলনা। আরো জানতে পারলাম আল ফাতাহ্ গেট, যেটা দিয়ে আমরা সাধারনতঃ প্রবেশ করি, তার ঠিক বাইরে ছিল অনেক বাঙ্গালী খাবারের দোকান। কিন্তু কিছুদিন আগে ওই সব দোকানপাট তুলে দেয়া হয়েছে। মক্কা বিশেষ করে মসজিদুল হারামের চারিপাশ দ্রুত বদলাচ্ছে প্রতিদিন। (চলবে..)
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
 আব্দুল্লাহ আল-মামুন, কাতার থেকে
|