 কাতারের সুখ দুঃখ - ৮ আব্দুল্লাহ আল-মামুন
       পরের অংশ 
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
কাবার পথে – ১: শুরু হয়েছে হজ্জ্বের মওসুম। কাতারের বহু প্রবাসী বাংলাদেশী ইতিমধ্যে দেশে চলে গেছেন হজ্জ্বের কাফেলায় শরীক হতে। কাতারে হজ্জ্ব পালনের জন্য সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহের ছুটি দেয়া হয়। যা অস্ট্রেলিয়ায় বসে কখনো ভাবাই যায়না। হজ্জ্বের কোটা অনুসারে কাতার থেকে মাত্র ১২০০ জন হজ্জ্বে যেতে পারেন। এর মধ্যে ৯০০ জন হলেন স্থানীয় কাতারী আর কাতারে বসবাসরত বাকী প্রায় ২০ লক্ষ প্রবাসীদের মধ্যে মাত্র ৩০০জন। এনিয়ে সরকার লটারি করে থাকেন। তবে এবার অবরোধের কারণে কাতারী হজ্জ্ব যাত্রীদের উপর নতুন বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। নতুন আরোপিত নিয়মানুসারে কাতারের হজ্জ্বযাত্রীদের দোহা বিমান বন্দর ব্যবহার করতে হবে এবং সৌদি আরবের কেবল জিদ্দা ও মদিনার বিমান বন্দর দিয়ে ওই দেশে ঢুকতে হবে। এছাড়া রিয়াদের অনুমোদন ছাড়া অন্য যেকোনো বিমানে চড়ে হজ্জ্বে যাওয়া যাবেনা এবং সৌদি আরবে অবতরণ করার পর বিমানবন্দরে ভিসা নিতে হবে। হজ্জ নিয়ে সৌদি আরব রাজনীতি করছে এই অভিযোগে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে ইতিমধ্যে নালিশ করেছে কাতার।
প্রতিটি মুসলিমের মনের গভীরে সুদূর মক্কা পাড়ি দেয়ার একটা লালিত স্বপ্ন থাকে । আমিও এর ব্যতিক্রম নই। বাধ্যগত ধর্মীয় অনুশাসন পালন করা ছাড়া যে বিষয়টির প্রতি ছিল আমার দুর্নিবার আকর্ষণ তা হল ইসলামের আদি-ভূমি আরব দেশে গিয়ে সময়ের চোরাপথে হারিয়ে যাওয়া ঘটনাবলী ইতিহাসের পথ ধরে খুঁজে দেখা, আর মক্কা/ মদিনার ধূলি-কণার পরতে পরতে ও রুক্ষ নীলিমায় আধ্যাত্মিকতার যে রেশ ছড়িয়ে আছে তা অনুভব করার চেষ্টা করা।
২০০৮ সালের জুনে কাতারের দোহা শহরে আসার পরই মক্কায় যাবার কথা ভাবছিলাম। আমার পরিবার সিডনী থেকে দোহায় আসার পরই ঠিক করলাম সবাই মিলে উমরায় যাবো। মার্চে উমরা ভিসা দেয়া শুরু হয় । তাই ২০০৯ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ যাবার জন্য সঠিক মনে হল। কয়েকটা ট্রাভেল এজেন্সিতে গিয়ে বিমানে যাবার ও থাকা/খাওয়ার খরচের একটা মোটামুটি হিসাব নিলাম। কাতার ও মধ্যপ্রাচ্যের আশে পাশের দেশ থেকে অনেকেই নিজের গাড়ী নিয়ে মক্কায় যান। ভাবলাম মক্কার এত কাছাকাছি রয়েছি তাই বিমানে না গিয়ে বাসে গেলে কেমন হয় ? বাসে করে গেলে যাবার পথে সৌদি মরু প্রান্তরের কিছুটা হলেও দেখা যাবে আর মাটি ছুঁয়ে যাবার ভিন্ন এক অনুভূতিরও সন্ধান মিলবে।
বাসার কাছেই রয়েছে হজ্জ্ব/উমরায় অভিজ্ঞ ট্রাভেল এজেন্ট দোহা গ্রুপ ট্রান্সপোর্ট। ওদের সাথেই যোগাযোগ করলাম। দোহা গ্রুপের ব্যবস্থাপনায় দেখলাম রয়েছে পাকিস্তানীরা। শুনে প্রথমে একটু দমে গেলেও খোঁজ নিয়ে জানলাম ওদের ব্যবস্থাপনা ততটা মন্দ নয়। আর যে উদ্দেশ্যে যাচ্ছি বাড়তি কষ্ট হলেও তার জন্য আমরা মানসিকভাবেও প্রস্তুত ছিলাম।
টিকেটের সাথে উমরা ভিসা, মক্কা ও মদিনায় থাকার ব্যবস্থাও থাকবে। শুধু খাবার আমাদের কিনে খেতে হবে। পুরো ডিলটা ভালই মনে হল। সাথে সাথেই দোহা গ্রুপের কাছে পাসপোর্ট জমা দিয়ে দিয়ে দিলাম। যাবার দিনও ঠিক হল। বাস ছাড়বে এপ্রিলের ৮ তারিখ, ভোর সাতটায়। এপ্রিলের ৫ তারিখের মধ্যেই উমরা ভিসা হয়ে গেল। যতই দিন ঘনিয়ে আসছিল ততই মনের মধ্যে অন্য এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করছিলাম। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল আসলেই আমি মক্কার যাত্রী। অবশেষে যাবার দিন চলে এলো। শেষ মুহূর্তে কেনাকাটা যেমন ইহরামের কাপড়, মুনিরার জন্য বোরকা, বাম্প ব্যাগ, সেলাইবিহীন স্যান্ডেল কেনা শেষ করে ফেললাম। বই পুস্তক ঘেঁটে বাংলা ও ইংরেজিতে উমরা পালনের নিয়মাবলী ও দোয়ার দুটো ভার্সন তৈরি করলাম। এগুলি থেকে আমার কন্যা মুনিরা Palm Card তৈরি করে নিল উমরার সময় যাতে Palm Card দেখে দোয়া পড়া যায়।
এপ্রিলের ৮ তারিখ, বুধবার ভোর সাড়ে ছ’টায় ঘর থেকে বেরুলাম। বাসষ্ট্যান্ড আমার বাসার খুবই কাছে, ৫ মিনিট হাঁটার পথ। পুরো বাসে রয়েছে ৫৫ জন যাত্রী। অনেকের সাথে আছে ৮মাসের শিশুও। যাত্রীদের মধ্যে রয়েছে ৫টি বাঙ্গালী পরিবার তার মধ্যে আবার দু’জন চট্টগ্রামের অধিবাসী। অন্যান্য যাত্রীদের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানী, ইন্দোনেশীয় ও ভারতীয়। ড্রাইভার হল পাকিস্তানী পাঠান, উর্দু ও পস্তুন ছাড়া অন্য ভাষা বলতে পারেনা। আরবি চালিয়ে নিতে জানে। গাড়ীতে আমাদের আসন ছিল একবারে সামনের সারিতে। উঠেই দেখলাম ময়লা যাতে সঠিক যায়গায় ফেলা হয় সেই সংক্রান্ত একটি নোটিশ। নোটিশে Waste বানান লক্ষণীয় যা দেখে আমার মেয়ে মুনিরা হেসেই খুন। দুঃখজনক হলেও সত্য এই নোটিশ যাত্রীদের মধ্যে কোন প্রভাবই ফেলতে পারেনি। গাড়ীতে মেঝেতে খালি পানির বোতল, চিপস ও প্লাস্টিক ব্যাগের ছড়াছড়ি দেখেতে পেলাম।
আমার পাশের সিটে যে ভদ্রলোক বসলেন তিনিও বাংলাদেশী। নাম আব্দুল মান্নান। গাড়ীতে পাশাপাশি দু’টো করে সিট হওয়াতে আমাকে আলাদা বসতে হল। মান্নান সাহেব আমাদের চেয়ে বেশ সিনিয়র। প্রায় ২০ বছর ধরে কাতারে আছেন। তিনি প্রতি দু’বছর অন্তর পরিবার নিয়ে সৌদি যান। তাঁর কাছ থেকে সফরের অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ে জানতে পারলাম। তিনি বললেন যদি সৌদি চেকপোস্টে খুব দেরী না হয় পাক্কা একদিন লাগবে মক্কা পৌছতে। আর চেকপোস্টে দেরী হলে কি হবে তা সহজেই আন্দাজ করতে পারলাম। একথা শুনে সেলী ও মুনিরার চোখ দুটো ছানাবড়া! আমরা কখনোই বাসে এত দীর্ঘক্ষণ ভ্রমণ করিনি। সিডনী থেকে ১০০০/১২০০ কিলোমিটার দুরে অন্যান্য স্টেটে বাসে /ট্রেনে চড়ে কিংবা নিজের গাড়ী ড্রাইভ করেও গিয়েছি । ভিসার জটিলতা না থাকলে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টার বেশী লাগাবার কথা নয়। যাই হোক সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যখন বের হয়েছি তখন পথে যতই দেরী হোকনা কেন এ নিয়ে কোন রকম দুর্ভাবনা করার দরকার নেই। যা হবার হবে।
সকাল সোয়া সাতটায় সময়মতই বাস ছাড়ল। সৌদি সীমান্ত প্রায় ৯০ কিলোমিটার দুরে। ভোরে ট্রাফিকের ভিড় ঠেলে দেড় ঘণ্টার মধ্যেই কাতার কাস্টম চেক পোষ্টে পৌঁছে গেলাম। আমাদের সবার পাসপোর্ট ড্রাইভার তার ব্যাগে ভরে কাস্টম অফিসে নিয়ে গেল। চেকপোস্টটা বেশ সাজানো গোছানো। সাথে রয়েছে একটি কফি সপ ও আধুনিক টয়লেট। আমরা কফি সপে চা খেলাম। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পাসপোর্টে এক্সিট সিল দিয়ে ফিরে আসল ড্রাইভার। গাড়ীতে গিয়ে বসার পর আমাদের সবার হাতে পাসপোর্ট দেয়া হল। কাতারী কাস্টম অফিসার এসে সবার পাসপোর্ট ও চেহারা মিলিয়ে দেখার পর আবার যাত্রা শুরু হল।
১৫ মিনিটের মধ্যেই সৌদি সীমান্তে “সালওয়া” চেকপোস্টে এসে পৌঁছলাম। সময় তখন সকাল সোয়া দশটা। সৌদি চেকপোস্টটাই দেরী হবার মূল কারণ বললেন পাশের ভদ্রলোক। একবার গাড়ীর ভিড় থাকাতে সৌদি চেকপোস্টে নাকি সারারাতই কেটে যায়। শুনে ভড়কে গেলাম। ভাবলাম পৌছতে পারবতো? সৌদি চেকপোস্টের বাহ্যিক অবস্থা দেখে হতাশ হলাম। কাতার চেকপোস্ট থেকে সৌদি চেকপোস্টে ঢুকে সবকিছু ভীষণ দৃষ্টিকটু মনে হল। কংক্রিটের ছাউনি দেয়া চেকপোস্ট দেখে কমলাপুর রেল ষ্টেশনের কথা মনে পড়ে গেল। দেখতে অনেকটা সে রকম। বাস ও মোটরগাড়ির জন্য রয়েছে আলাদা লেন। মোটরগাড়িতে যারা যাচ্ছেন তাদের অনেকেই হলেন সৌদি কিংবা কাতারী ফলে কাস্টম অফিসাররা তাদের নিয়েই অনেক সময় ব্যস্ত থাকেন। ফলে বাস যাত্রীদের দীর্ঘ অপেক্ষার দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
সৌদি চেকপোস্টে যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য ওয়েটিং রুম কিংবা কোন কফি সপ নেই। ছাউনির নীচে বসার জন্য রয়েছে কিছু ভাঙ্গা বেঞ্চ। বেশ গরম পড়ছে বলতেই বাঙ্গালী ভদ্রলোক বললেন এখন অনেক ভালো সময়, জুন জুলাইয়ের প্রচণ্ড গরমে ছোট বাচ্চা ও পরিবার সহ যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই খোলা প্লাটফর্মেই কাটাতে হয়। ভাবতেই কষ্ট হল। ভাগ্য ভালো আমাদের সামনে রয়েছে মাত্র একটি বাস ফলে দেরী হবার সম্ভাবনা কম। খোদাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। সব লাগেজ প্লাটফর্মে নামানো হল। কাস্টম সিকিউরিটি অফিসার কুকুর দিয়ে গাড়ীর ভেতর/বাহির ও ইঞ্জিন ঘরও খুলে পরীক্ষা করলেন। বোরকা পরার কারণে শুধু মেয়েদের বডি-সার্চ করা হল যাতে বোরকার আড়ালে কিছু পাচার করা না যায়। আবার কিছু মহিলা যাদের মুখও ঢাকা কিংবা শুধু চোখ দেখা যায় তাদের আলাদা করে নিয়ে যেয়ে পাসপোর্টের সাথে চেহারা মিলিয়ে দেখা হল। সবকিছু শেষ করে গাড়ী যখন ছাড়ল সময় তখন দুপুর ১২:৩০মিনিট। যোহরের আযান হয়ে গেছে। সবাই নামায পড়ার জন্য উসখুস করছে। কিন্তু ড্রাইভার বললেন ১৫০ কিলোমিটার দুরে হফুফে গিয়েই নামায ও দুপুরের খাবার খাওয়া হবে।
রাস্তার সাইনবোর্ড থেকে হিসাব করে দেখলাম দোহা ও মক্কার দূরত্ব প্রায় ১৪০০ কিলোমিটার। সাথে ছিল ডরশরসধঢ়রধ থেকে প্রিন্ট করা একটা রুট-ম্যাপ । সৌদি হাইওয়ে ৮৫ ধরে বাস যাচ্ছিল। কাতার সীমান্ত থেকে ১৫০ কিলোমিটার দুরেই রয়েছে সৌদি শহর হফুফ। হফুফ থেকে রিয়াদ হয়ে হাইওয়ে ৪০ ধরে অবশেষে আমরা মক্কা যাব। বাসে যাবার কথা শুনে আমাদের আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন, নিরাপত্তার কথা ভেবে। সৌদি রাস্তা সম্পর্কে সবার যা ধারণা তা শুনে আমি নিজেও দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। কিন্তু রাস্তায় নেমে দেখি যতটা শুনেছি ততটা নয়। হাইওয়েগুলি ভীষণ প্রশস্ত, নিখুঁত, দুই দিকে ৩টি করে ছয়টি লেন। কিছুক্ষণ পরপর রয়েছে আরবি ও ইংরেজিতে বড় বড় রোড সাইন যাতে রয়েছে শহরের নাম, দূরত্ব ইত্যাদি। রাস্তা হারাবার ভয় নেই। যে যার মত ধীরে কিংবা স্পীডে গাড়ী চালিয়ে ছুটছে নিজস্ব গন্তব্যের দিকে।
বাসের ভিতর চোখ বুলিয়ে দেখি অনেকই নিদ্রাচ্ছন্ন। কন্যা মুনিরা ও স্ত্রী সেলিও চোখ বুজে আছে। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে আমি বাইরে চোখ রাখলাম। চারিদিক ধূ ধূ রৌদ্দুর আর মরুভূমি। দুরে মরীচিকার মতো দেখা যাচ্ছিল কিছু আবার হঠাৎ করেই শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছিল । মরূদ্যানের নির্জনতা ভেঙ্গে ছুটে চলেছে বাস সমুখের দিকে। কিন্তু কেন জানিনা বুকের মধ্যে আমার ভাবনাগুলো স্মৃতির হাইওয়ে ধরে ছুটে যাচ্ছিল উল্টোদিকে। কখনো ভাবিনি দীর্ঘ দু’দশকেরও বেশী অস্ট্রেলিয়ায় কাটানোর পর আবার অন্য কোথাও যাবো চাকরী নিয়ে। সত্যি বলতেকি মধ্যপ্রাচ্য ছিল আমার পছন্দের তালিকারও বাইরে। অথচ সেই আমি এখন দোহার বাসে চড়ে যাচ্ছি মক্কায়। দেখলাম জীবনের অনেক কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। শত চেষ্টাতেও ইচ্ছের শেকল দিয়ে ওদের বাঁধা যায়না। জীবনে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে যা খালি চোখে অসম্ভব বলে মনে হয়। এটাকেই হয়ত সবাই বলে নিয়তি, যা হচ্ছে অন্য একজন শক্তিধরের নিয়ন্ত্রণে। হঠাৎ করে এক ঝাঁক উটের সারি দেখে সম্বিত ফিরে পেলাম। কিছু দূর পর বেশ কিছু উটের খামার দেখতে পেলাম। কিন্তু যেদিকে চোখ যাচ্ছে দেখছি কিছুটা মেটে রংয়ের সারি সারি বালির ডিবি আর হাই-ভোল্টেজ পাওয়ার লাইন। বালির ডিবির মাথায় রয়েছে ধূসর রংয়ের কিছু টুকরো লতাপাতা। এছাড়া সবুজ বলতে গেলে কিছুই চোখে পড়লনা। দিগন্ত জুড়ে তেমন কোন পাহাড়ও দেখছিলামনা। ম্যাপে চোখ বুলিয়ে দেখলাম হফুফ থেকে রিয়াদের চারিপাশ মোটামুটি সমতল, মক্কার কাছাকাছি এলাকা হল উঁচু ভূমি।        পরের অংশ 
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
|