 কাতারের সুখ দুঃখ - ৭ আব্দুল্লাহ আল-মামুন
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
জল, স্থল, অন্তরীক্ষে এখন অবরুদ্ধ কাতার। এই অবরোধ আরোপ করেছে আর কেউ নয়, কাতারেরই প্রতিবেশী দেশ - সৌদি আরব, বাহরাইন, আরব আমিরাত ও মিসর। মুখের ভাষা, পোশাক, সংস্কৃতি, পারিবারিক ও গোত্রীয় সূত্রে এরা সবাই এক অন্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। স্বভাবতই: বেশ কিছুদিন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ফোন পাচ্ছিলাম। সবার উদ্বিগ্ন প্রশ্ন, কেমন আছে কাতার? কেমন আছি আমরা? ক’দিন আগে সিডনী ঘুরে এসেছি। ওখানেও সবার মুখে ছিল একই জিজ্ঞাসা। তাই ভাবলাম এই পর্বে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন না করে কাতারে এখন কি ঘটছে সে কথাই বলি।
ট্রাম্পের আশীর্বাদ নিয়ে সৌদি জোট ভেবেছিলো অবরুদ্ধ করার ক’দিনের মধ্যে ভেঙ্গে পড়বে পুচকো দেশ কাতার আর আমীরের প্রাসাদে ঘটবে ক্ষমতার পট পরিবর্তন। এও শুনেছি কাতার প্রবেশের উদ্দেশ্যে সীমান্তে প্রস্তুত ছিল সৌদি বাহিনী। কিন্তু বিধাতার দয়ায় তেমনটা হয়নি। কাতারে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত সৌদি জোটের আশার গুড়ে বালি ঢেলে দেয়। দেশের চরম দুঃসময়ে অবিচল থেকে বয়স এবং রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত নবীন আমীর শেখ তামিম যেভাবে সঙ্কটের মোকাবেলা করেছেন তা বিশ্বে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
এখন দেশপ্রেমের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে কাতারে। সৌদি পণ্য বর্জন করে সবাই কিনছেন কাতারী পণ্য-সামগ্রী। বড় বড় দালান, গাড়ীর জানালায় আমীরের পোস্টারে ছেয়ে গেছে রাজধানী দোহা শহর। প্রবাসী এবং কাতারের স্থানীয় জনতা একাত্ম হয়ে প্রকাশ করছেন কাতারের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে বাসানো হয়েছে বিশাল বিলবোর্ড যাতে কাতারের স্থানীয় এবং প্রবাসী জনগণ দলবেঁধে কাতারের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা লিখছেন।

অবরোধ আরোপ করা হয়েছে প্রায় দু’মাস হতে চললো। তবে এক কথায় বলা যায় আমরা সবাই এখন ভালোই আছি। অবরোধের প্রথম দিকে কাতারে এক ধরনের আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার ঝড় বয়ে যায়। দু’সপ্তাহের মধ্যে কাতারী নাগরিকদের সৌদি আরব, আমিরাত ও বাহরাইন ছাড়তে বাধ্য করা হয়। দেশ ছাড়ার আগে অনেকে নিজ পরিবারের সাথে মিলিত হবারও সুযোগ পাননি। অন্যদিকে ওমরা পালনরত কাতারীদের পবিত্র হারাম শরীফ থেকে বহিষ্কার করার মত মর্মান্তিক ঘটনার কথাও শোনা যায়। সীমান্তের ওপারে সৌদি আরবের খামারে পালিত কাতারের নিরীহ পশু উট-ভেড়াও রক্ষা পায়নি এই নির্মমতা থেকে। খামার থেকে বিতাড়িত হয়ে পানি ও খাদ্যাভাবে প্রাণ হারিয়েছে হাজারো পশু। কাতারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ইমামদেরও ব্যবহার করা হয়েছে। সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি শেখ অব্দুল আজিজ এই অবরোধ বৈধ বলে ফতোয়া দিয়েছেন। একটি মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে পবিত্র রমজান মাসে দেয়া অবরোধের বৈধতার স্বপক্ষে কুরআন ও হাদিসের দলিল দেয়ার জন্য কাতারের গ্র্যান্ড মুফতি সৌদির শেখ আব্দুল আজিজকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন মুসলিম দেশকে আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি এবং হজ্জ্ব কোটা কমিয়ে দেবার ভয় দেখিয়েও কাতারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও সৌদি জোট সফল হতে পারেনি। স্থলপথে কাতারে প্রবেশের একমাত্র রাস্তা হচ্ছে দক্ষিণের সৌদি সীমান্ত । সেই পথ বন্ধ করে দেয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য-বাহী শত শত ট্রাক কাতারে প্রবেশ করতে পারেনি। ফলে খাদ্য সঙ্কটে হতে পারে সেই দুশ্চিন্তায় খাবার মজুদ করে রাখার জন্য অবরোধের শুরুতে অনেকেই সুপার মার্কেটে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন। আমেরিকান ডলার কেনারও হিড়িক পড়ে গিয়েছিলো কিছুদিন। তড়িৎ গড়িতে খাদ্য সরবরাহের জন্য বিকল্প উৎস খুঁজে বের করে, স্টক মার্কেট ও ব্যাংকিং খাতে অর্থ ঢেলে পরিস্থিতি এখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হয়েছে কাতার সরকার।
কাতারের দক্ষিণে সীমান্ত বন্ধ হয়ে গেলেও এই অঞ্চলের দুই পরা শক্তি তুরস্ক ও ইরান দুঃসময়ের বন্ধুর মত কাতারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কার্গো বিমানে করে এবং ইরানের শিরাজী বন্দর থেকে জাহাজে করে আসছে খাদ্য পণ্যের চালান। সুপার মার্কেটের সেলফে দেখলাম অস্ট্রেলিয়ার আলু ও কমলা সহ কোস্টারিকা, পেরু, দক্ষিণ আফ্রিকা সহ বিভিন্ন দেশের খাদ্য-পণ্য, যা আগে কখনো দেখিনি। দুবাই এবং সারজা বন্দর ব্যবহার করতে না দেয়ায় কাতার-মুখী যাবতীয় পণ্য এখন ওমানের বন্দর ঘুরে আসছে। ফলে কিছু কিছু খাদ্র সামগ্রীর দাম বেড়ে গেছে। এজন্য মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন আয়ের বাংলাদেশি নির্মাণ শ্রমিকরা কিছুটা সঙ্কটে রয়েছেন। দুবাই ও সৌদি আরব থেকে গার্মেন্টস, স্পেয়ার পার্টসের মতো আমদানি নির্ভর বাংলাদেশী পণ্য ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বিপাকে। তাদের অনেকেই এখন বিকল্প ব্যবসায়ের কথা ভাবছেন। সৌদি আরব, আমিরাত, বাহরাইন ও মিসরের আকাশপথ বন্ধ হওয়ায় কাতার এয়ারওয়েজের অনেক ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেছে আবার বহু ফ্লাইটকে নতুন রুট খুঁজে নিতে হচ্ছে। এজন্য বেশ কিছু গন্তব্যে যাবার সময় অনেক বেড়ে গেছে। এবার সিডনী যাবার পথে তাই দেখলাম।
এতো কিছুর পরও কাতার উদারতা ও মানবতার পথ থেকে সরে আসেনি। সৌদি জোটের কোনো নাগরিককে নিজ দেশে ফিরে যেতে বাধ্য করেনি কাতার। তারা সবাই কাতারে আগের মতোই আছে। কাতারে সৌদি আরব কিংবা আমিরাতের কোনো মিডিয়া চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করা হয়নি। কাতারে সরবরাহকৃত সব ধরনের বাণিজ্যিক চালান বন্ধ করে দেয়া হলেও কাতার সৌদি জোটের কোনো দেশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়নি। এজন্য আরব সহ সমগ্র বিশ্বের সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছে কাতার। সম্প্রতি সিডনী সফরের সময় যাদের সাথে কথা হয়েছে তাদের প্রায় সবাই সৌদি জোটের প্রতি তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

ধীরে ধীরে যতই দিন যাচ্ছে, সৌদি জোটের এই অবরোধের মূল উদ্দেশ্য খোলাসা হয়ে আসছে। কাতারের গ্যাস সম্পদের উপর কর্তৃত্ব নেয়া এবং আরব দেশগুলোর মোড়ল হবার স্বপ্নই মনে হচ্ছে জোটের হেভিওয়েট সদস্য সৌদি আরবকে এই হিংসাত্মক পথে নিয়ে এসেছে। কাতারের উত্তরে পারস্য উপসাগরের নীচে রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক গ্যাস ভাণ্ডার। যার এক তৃতীয়াংশের মালিক হচ্ছে ইরান। তাই ইরানের সাথে কাতার বরাবরই সুসম্পর্ক রাখতে আগ্রহী। ইয়েমেনের যুদ্ধ, বাজারে তেলের অবমূল্যায়নের কারণে সৌদি আরব এখন মরিয়া হয়ে বিকল্প আয়ের উৎস খুঁজছে। সৌদি আরব চায় কাতার ইরানের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ুক যাতে কাতারের গ্যাস সম্পদের দখল নিতে পারে। বেশ কিছুদিন ধরে সিরিয়ার মধ্য দিয়ে গ্যাস পাইপলাইন (উপরের ছবি দেখুন) টেনে ইউরোপের বাজারে গ্যাস সরবরাহ করার পরিকল্পনা করছে কাতার। গ্যাস পাইপলাইন যাতে সৌদি ভূখণ্ড দিয়ে যায় সেটা নিশ্চিত করতে চায় সৌদি আরব যাতে কাতারের গ্যাস সরবরাহের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে।
আজকের এই অবরোধ কাতারের জন্য মুখোশের অন্তরালে আশীর্বাদ বয়ে আনবে বলে আমার ধারনা। প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে স্বনির্ভর হবার জন্য কাতার এখন আটঘাট বেধে নেমেছে। দুগ্ধ উৎপাদনের জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে চার হাজার গরু উড়িয়ে আনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কাতারের নিজস্ব খামারের দুধ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। কৃষিকাজ করার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার হেক্টর জমি ক্রয় করেছে কাতার। এছাড়া আমেরিকা, ইউক্রেন ও ইউরোপের কৃষিখাতেও কাতার বিনিয়োগের কথা ভাবছে। সরকার কৃষিখাতে সহায়তা দেয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন। এটা বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা হলেন মধ্যপ্রাচ্যের মরুতে শাক-সবজী উৎপাদনের পথিকৃৎ। ইতিমধ্যে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাতারের কৃষিখাতে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
তবে গত ১৬ই জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কাতারের আমীরের ভুয়া বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে বলে একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হবার পর থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে। রিপোর্টে আরব আমিরাত এই হ্যাকিংয়ের আয়োজন করেছিলো বলে দাবী করা হয়। ফলে যে অজুহাতে কাতারের উপর অন্যায় অবরোধ চাপানো হয়েছিল তার বৈধতা তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়েছে। যা পরিণতিতে সৌদি জোট ১৩টি শর্ত থেকে সরে এসে কেবল ছয়টি মূলমন্ত্র মেনে চলার জন্য কাতারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তাদের এই সরে আসা এবং মূলমন্ত্র মেনে চলার জন্য কাতারের প্রতি রীতিমত আকুতির মধ্য দিয়ে কাতারেরই কূটনৈতিক এবং দৃঢ়তারই বিজয় হয়েছে।
মনে হচ্ছে কাতার সঙ্কটের অবসান হওয়াটা এখন কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। সৌদি জোট এখন সম্মানজনক ভাবে নিজের তৈরি ফাঁদ থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসতে পারে সেই পথই যেন খুঁজছে। তবে মনে রাখা দরকার, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। কাতার থেকে রপ্তানি করা গ্যাস সরবরাহ দিয়েই সচল রয়েছে সৌদি আরব, আমিরাত এবং মিসরের বিদ্যুৎ এবং জ্বালানী কেন্দ্রগুলো। মিসরের গ্যাস চাহিদার ৬০ শতাংশ আসে কাতার থেকে। কাতারের সাথে আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও বাহরাইনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ষাট বিলিয়ন ডলার। তাই অবরোধ দীর্ঘ সময় ধরে চললে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবাই (চলবে..)
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
 আব্দুল্লাহ আল-মামুন, কাতার থেকে
|