 কাতারের সুখ দুঃখ - ৩ আব্দুল্লাহ আল-মামুন
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
কাতারে বলতে গেলে রয়েছে কেবল দু’টো ঋতু - গ্রীষ্ম এবং শীত কাল। এপ্রিলের শুরু থেকেই প্রকৃতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। আর জুন/জুলাই মাসে তা ভয়ংকর আকার ধারণ করে। ওই সময় দিনের তাপমাত্রা ৪৫ থেকে ৫৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে উঠা-নামা করতে থাকে। অথচ সিডনীতে তখন ঠিক তার উল্টো অর্থাৎ মাঘের শীত। এ সময়ে কাতারীরা গরম থেকে বাঁচতে ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে যেমন বেড়াতে যান, তেমনি প্রবাসীদের অনেকেই তাদের পরিবারকে কয়েক মাসের জন্য দেশে পাঠিয়ে দেন।
নভেম্বর/ডিসেম্বর মাসে সিডনীর তাপমাত্রাও কম যায়না। যা কখনো ৪৫ ডিগ্রীও পার হতে দেখেছি। মনে পড়ে আশির দশকের শেষের দিকে সিডনী সিটিরেলের বেশ কিছু লাইনে চলতো লাল রংয়ের প্রথম জেনারেশনের ট্রেন। এসব ট্রেনে ছিলনা কোনো শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। সবার কাছে এগুলো রেড র্যাটলার্স নামে পরিচিত ছিল। গ্রীষ্মের খরতাপে এই ট্রেনে চড়ে সিডনী শহরে চলতে গিয়ে মনে হতো গরমে যেন সেদ্ধ হয়ে গেলাম। অবশ্য ১৯৯৩ সালের দিকে এই ট্রেনগুলো উঠে যায়। তবে অস্ট্রেলিয়ার সাথে কাতারের পার্থক্য হচ্ছে, সিডনী শহরে গ্রীষ্মকালে দিনের তাপমাত্রা কখনো ৪০ ডিগ্রী ছাড়িয়ে গেলেও সন্ধ্যায় তা ২০-২৫ ডিগ্রীতে নেমে আসে। কিন্তু কাতারের তাপমাত্রা, দিন বলুন কি রাত, প্রায় সমান থাকে। ফলে রাতের বেলাতেও তাপদাহ থেকে নিস্তার পায়না কেউ।
কাতারে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে প্রকৃতিতে নেমে আসে প্রশান্তি। তাপমাত্রা ক্রমশঃ কমে গিয়ে নভেম্বর/ডিসেম্বরে ১০-১৫ ডিগ্রিতে নেমে আসে। সিডনীর বন্ধুদের বলে রাখি, এই সময়টা হল কাতার ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময়। তবে কাতারে যে কদাচিৎ বৃষ্টিপাত হয় তা এই সময়টাতেই হয়ে থাকে। বৃষ্টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কারণ নেই। কাতারে সারা বছরে মাত্র নয় থেকে দশদিন বৃষ্টি হয়ে থাকে। আর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বছরে গড়ে মাত্র ৮০ মিলিমিটার যা সিডনীর তুলনায় নস্যিই বলা চলে।
কাতারে গ্রীষ্মকাল হল খেজুরের মৌসুম। এই সময় রাস্তার লাগানো সারিবদ্ধ খেজুর গাছে দেখা যায় থোকা থোকা খেজুরের সমাহার। লাল রংয়ের পাকা খেজুর দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। এ ধরণের স্থানীয় খেজুর একটু পরিপক্ক হলেই বাজারে বিক্রি হয়। রাস্তায় চলার সময় হাত বাড়ালেই খেজুরের নাগাল পাওয়া যায়। ইচ্ছে করলে হাত দিয়ে পেড়ে খেতে বাধা নেই।
 সিডনী থেকে আমার কাতারে আগমন হল সবচেয়ে কঠিন সময়ে অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের গ্রীষ্মকালে। যা অনেকটা সিডনীর জুন মাসের হিমাগার থেকে তপ্ত উনুনে আগুনে ঝাপ দেয়ার মত। তেমনি এক আগুন ঝরা দিনে আমাকে সরকারী মন্ত্রণালয়ের অফিসে মিটিং-এ যেতে হল। আমার অফিস থেকে মন্ত্রণালয়ের দূরত্ব খুব একটা বেশী নয়। কিন্তু বিধি বাম। সরকারী অফিসের কাছাকাছি আসতেই একটা বিকট আওয়াজ শুনে টের পেলাম আমার গাড়ীর টায়ারে হাওয়া নেই। পাংচার! তাড়াতাড়ি রাস্তার পাশে গাড়ী থামালাম। বাইরের তাপমাত্রা তখন ৫০ ডিগ্রীর উপরে। এখানে সিডনীর মত রোড সার্ভিস নেই যে সাহায্যের জন্য ডাকবো। আমার গলায় টাই ও গায়ে কোট, হাতে ল্যাপটপ আর দুটি বিশাল আকৃতির অফিস ফোল্ডার। সবকিছু হাতে নিয়ে অবশেষে হাঁটতে শুরু করলাম। সমস্যা হল অফিসটার সঠিক স্থানও ঠিক মত জানা ছিলনা। ভেবেছিলাম গাড়ী নিয়ে খুঁজে নেবো। কিন্তু এখন তা পায়ে হেটে করতে হবে ভেবে রীতিমত শঙ্কিত হলাম।
রাস্তায় পথচারীরাও ঠিকানা বলতে পারছিলনা। এভাবে বহুক্ষণ হাঁটার পর মনে হল বোধহয় আমি জ্ঞান হারাবো। উপায়ন্তর না দেখে তাড়াতাড়ি রাস্তার ধারে এক গাড়ীর ডিলারের দোকানে ঢুকে পড়লাম আর ওদের কাছে পানি চাইলাম। আমার অবস্থা দেখে ওরা পানি দিয়ে বসার জায়গা দিল। পানি খেয়ে ওদের দিক নির্দেশনা নিয়ে আবার রওয়ানা দিলাম। আরো ২০ মিনিট হেঁটে অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছলাম। কাতারে এটাই ছিল অফিসের বাইরে আমার প্রথম মিটিং। কিন্তু সেটাও মিস করলাম। নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা পরে পৌঁছে দেখি ওরা মিটিং বাতিল করে দিয়েছে। তবে আমার রক্তাভ চেহারা দেখে ও পুরো ব্যাপারটা জানার পর আমার জন্য কিছুটা সহানুভূতিও প্রকাশ করল।
কাতারে আসার পরপরই বেশ কিছু কাগজপত্র যোগাড় করতে হয়। তার মধ্যে প্রথম হলো রেসিডেন্ট ভিসা। ভিসা পেলেই তার স্বীকৃতি স্বরূপ ফটো আইডি কার্ড দেয়া হয়, যাকে রেসিডেন্ট পারমিটও বলা হয়। আইডি কার্ড ছাড়া এখানে কোনো কিছু করা অসম্ভব। কাতারের আইডি কার্ডে বেশ কিছু তথ্য থাকে, যেমনঃ কোন দেশের নাগরিক, ভিসার ধরন, ও পেশা ইত্যাদি। তাই প্রথমেই ছুটতে হলো রেসিডেন্ট ভিসার জন্য।
আমার অফিসের "মান্দুপ" হচ্ছে নওশাদ, কেরালার ভারতীয় নাগরিক, খুবই ব্যস্ত মানুষ। প্রতি অফিসে রয়েছেন একজন "মান্দুপ" যার মানে হল যিনি বাহিরের কাজ করেন। মান্দুপ অফিসের কর্মচারীদের ভিসা, এক্সিট পারমিট সহ যাবতীয় কাজে সাহায্য করে থাকেন। এদের পাবলিক রিলেশন্স অফিসারও বলা যায়। আমার ভিসার জন্য যা করণীয় তার ব্যবস্থা করে দিচ্ছিলো। অফিসের গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন সরকারি অফিসে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিলো নওশাদ। ফলে বিশেষ কোনো অসুবিধা হচ্ছিলো না। সহকর্মীদের থেকে জানতে পেলাম নওশাদের আসল পরিচয়। কাতারে নওশাদের রয়েছে পাঁচটিরও বেশী ব্যবসা। কেরালায় নওশাদ তৈরি করেছে প্রসাদ-তুল্য বাড়ি। নওশাদের চলাফেরা খুবই সাদামাটা। একটা হাফশার্ট ও জিনসের প্যান্ট পড়ে থাকে। যা দেখে বোঝাই মুশকিল যে সে একজন মিলিওনিয়ার।
আইডি কার্ড করার আগে বেশ কিছু ধাপ পেরুতে হয়। প্রথম ধাপ হচ্ছে NOC (No Objection Certificate). আমার অফিসই এটার ব্যবস্থা করে দিল। তবে কাতারে ঢোকার আগে NOC-এর ব্যবস্থা করা না হলে কাতারে এসে প্রথম দেশ থেকে বের হয়ে গিয়ে আবার এন্ট্রি করতে হয়, যাকে কিনা বলে Visa Run. তবেই NOC-এর স্ট্যাম্প পড়বে পাসপোর্টে।
দ্বিতীয় ধাপ হলো মেডিকেল টেস্ট। এর মধ্যে রয়েছে রক্ত পরীক্ষা ও এক্সরে করানো। উল্লেখ্য, কাতারে প্রতিটি কাজেই কমপক্ষে দুটো করে পাসপোর্ট সাইজের ছবি আর সাথে আরবিতে টাইপ করা দরখাস্তের প্রয়োজন হয়। তাই সবসময় হাতের কাছে বেশ কিছু পাসপোর্ট সাইজের ছবি থাকা দরকার। সরকারি অফিসগুলোর সাথেই রয়েছে টাইপরাইটার নিয়ে বসে থাকা টাইপিস্টের দল যা বাংলাদেশের আদালতের প্রাঙ্গণে সচরাচর দেখা যায়। অল্প টকার বিনিময়ে তারা নির্ধারিত ফর্মে সবকিছু টাইপ করে দেয়। কী করতে হবে এ সবই তাদের জানা।
ব্লাড গ্রুপ পরীক্ষা করে রীতিমতো ধাক্কা খেলাম। কারণ ওরা বললো আমার রক্তের গ্রুপ O+, অথচ এতদিন ধরে আমি জানতাম O-. তাই কোনটা সঠিক ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ভাবলাম পরে আবার পরীক্ষা করে যাচাই করে নিতে হবে আমার রক্তের গ্রুপটা আসলেই কি? এক্সরে রুমের অভিজ্ঞতা ছিলো অভাবনীয়। এক্সরে রুমের ঠিক ঢোকার মুখে রয়েছে আরেকটি ঘর যাতে সবাইকে শার্ট, গেঞ্জি খুলে রেখে লাইনে দাঁড়াতে হয়। তারপর একে একে এক্সরে রুমে ঢুকতে হয়। খালি গায়ে লাইনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিলো যেন সার্বিয়ার কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি খাবারের অপেক্ষায়। কারণ আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেরই পাঁজরের হাড় দেখা যাচ্ছিলো।
সবখানেই প্রচুর মানুষের ভিড়। অধিকাংশই বিভিন্ন কোম্পানি থেকে আসা শ্রমিক। তবে পেশাদারদের ক্ষেত্রে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট অর্থাৎ অগ্রাধিকার দেয়া হয়। ফলে অনেকক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো না। ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ হবার পর শেষ ধাপ হলো ফিঙ্গার প্রিন্ট। ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে দুই হাতের তালু ও আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হলো। এরপর সপ্তাহ-খানেকের মধ্যেই নওশাদ হাতে দিয়ে গেলো সেই কাঙ্ক্ষিত আইডি কার্ড; কাতারে বৈধভাবে থাকার লাইসেন্স ......... (চলবে)
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
 আব্দুল্লাহ আল-মামুন, কাতার থেকে, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
|