bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন





কাতারের সুখ দুঃখ - ১
আব্দুল্লাহ আল-মামুন



পরের পর্ব


কনকনে শীত। কোয়েকার্স হিলের আকাশ থেকে সূর্য ডুবি ডুবি করছে। আমার বাড়ীতে কাছের মানুষদের আনাগোনা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। দোতালায় যাবার সিঁড়ির মুখেই সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে আমার লটবহর। দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ী। আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমিরাত উড়োজাহাজের ৪১৩ নম্বর ফ্লাইটে চড়ে পাড়ি দিতে হবে সুদূর কাতার। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে টুকটাক শব্দ। গিন্নী আমার পছন্দের বেশ কিছু পদের রান্নায় শেষ স্পর্শ দিচ্ছেন। আমার বড় মেয়ের মুখে গোধূলি বেলার বিমর্ষ আভা স্পষ্ট দৃশ্যমান। দিনটা ছিলো মঙ্গলবার, ২৯শে জুন, ২০০৮ সাল।

ফ্যামিলি রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম বাড়ীর পশ্চাৎভাগের উঠোনের দিকে। চলনশীল দরজা দিয়ে বাইরে পা দিলেই পারগোলা। পারগোলার এক কোণে বিশাল বাগান-বিলাসের ঝাড়, আচ্ছাদন ছেয়ে ফেলেছে। অদূরে গার্ডেন শেডের পাশ ঘেঁসে উঠেছে দেশীয় সিম গাছের ঘন ঝাড়; বাড়ীর সীমানা ডিঙ্গিয়ে তা অনধিকার প্রবেশ করেছে প্রতিবেশীর আঙ্গিনায়। এর পাশেই মাত্র ক’দিন আগে লাগানো পুঁই শাক ও শশা গাছের চারা দেখলাম লকলকিয়ে বেশ বেড়ে উঠছে। একটু পরেই সিডনীর দীর্ঘ দু’ই দশক ধরে সময়ের সুতো দিয়ে গাঁথা জীবনকে পিছনে ফেলে পাড়ি দেবো অজানা গন্তব্যে। আত্মীয়, পরিবার, বন্ধু-বান্ধবের পাশাপাশি এসব লতা-পাতার সাথে এতটা সখ্যতা গড়ে উঠবে ভাবিনি কখনো। আমি হয়তো থাকবোনা, কিন্তু এই তরু-লতা-গুল্মের ভাঁজে ভাঁজে রেখে যাচ্ছি আমার স্পর্শ। আমি থাকবোনা তাতে কি? আমার হয়ে কেউ ছুঁয়ে দিলেই ওরা বড় হবে। বড় হতে হতে একদিন আকাশ ছোঁবে। মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম এসব কথা।

রাত ন’টায় ফ্লাইট। ভাইপো বললো, এখনই রওয়ানা দিতে হবে, নাহলে সময় মতো বিমান বন্দরে পৌছাতে পারবোনা। অবশেষে আমিরাতের বিমানে চড়ে কাতারের রাজধানী দোহা শহরের বিমান বন্দরে পা রাখলাম পরদিন বুধবার সকাল ন‘টায়। Maunsell Consultancy-তে চাকুরী নিয়ে যাচ্ছি। পরবর্তীতে ওটা অন্যান্য বহু কোম্পানির সাথে একত্রিত হয়ে AECOM-এ পরিণত হয়। এয়ারপোর্টে স্বাগত জানানোর জন্য অফিস থেকে লোক পাঠানো হয়েছে। ওদের হাতে ধরা বোর্ডে আমার নাম দেখেই বুঝলাম সঠিক জায়গায় পদার্পণ করেছি। যাইহোক ওই দিন বিকেলেই অফিসে রিপোর্টিং করার কথা। কিন্তু আমি এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি অফিসে গিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পেপার ওয়ার্কস সেরে ফেলি। পুরো রাতের দীর্ঘ ফ্লাইট। এতো ক্লান্ত ছিলাম যে হোটেলে গিয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।

তবে খুব বেশীক্ষণ ঘুমাতে পারিনি। হোটেলর পাশেই বড় মসজিদ থেকে ভেসে আসা আযানের ধ্বনিতে জেগে উঠলাম। সিডনী শহরে মাইকে আযান??? এতো অসম্ভব। হঠাৎ করে মনে হল এ তাহলে অস্ট্রেলিয়া নয়, ভিন্ন কোনো দেশ, জনপদ। চাকরির অফার, প্রস্তুতি, ভিসা সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হয়েছে যে আমার তখনো ঘোরই কাটেনি। বুঝতেই পারিনি যে দু দু’টো মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমি এখন মরু-জগতের এক ভিন্ দেশে এসে বসতি গেড়েছি।

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার বাইরে চোখ রাখতেই চমকে উঠলাম। নিজেকে চিমটি কাটলাম ক’বার। চোখ দু’টোকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। এযে আমার পরিচিত শহর নয়! এক ধরনের শীতল অনুভূতি শিরদাঁড়া বেয়ে ছড়িয়ে পড়লো দেহে। বাইরে তখন দুরন্ত গ্রীষ্মকাল। মধ্যপ্রাচ্যের তপ্ত বিকেল। চারিদিক যেন পোড়া উনুনের গরম চুয়ে চুয়ে পড়ছে। যে দিকে তাকাচ্ছি, দৃষ্টি জুড়ে কেবল ধূসর দিগন্ত - চোখে পড়ছিল ধুলো মাখা দালানের সারি, মসজিদের মিনার ইত্যাদি। নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম - কি করছি আমি এই হোটেল কক্ষে? কি কাজ আমার? আমার সুটকেস, অন্যান্য ব্যাগ তখনো খোলা হয়নি, রুমের মাঝখানে ছড়িয়ে আছে। কেন জানিনা নিজের অজান্তে চোখ দুটো ভিজে আসছিল।

বাইরে যদিও কড়া রোদ্দুর, আমার বুকের মধ্যে তখন শুরু হয়ে গেছে তুমুল ঝড়। বছরের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। এক অজানা আবেগের সুনামিতে ভেসে যাচ্ছিলাম আমি। মনে হচ্ছিল, প্রসপেক্ট জলাধারের জমানো সব জল যেনো আমার চোখ দুটো দিয়ে শুধু বেরুবার চেষ্টা করছে। ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই ছুটে যাই সিডনীতে আমার প্রিয় মানুষগুলোর কাছে। তবে অনেকটা সাথে সাথেই অনুভব করলাম এযে অসম্ভব। আমার পরিচিত পৃথিবী ছেড়ে আমি এখন অনেক অনেক দুরে। নিজেকে টাইম জোনে আটকে পড়া এলিয়েনের মত অসহায় মনে হচ্ছিল বার বার। পরিবার পরিজন ছেড়ে প্রবাসে যাওয়াটা আমার এই প্রথম নয়। উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশ ছেড়েছি সেই ১৯৮৩ সালে। তারপর অস্ট্রেলিয়া। শুধু তাই নয় চাকুরী নিয়ে আমি অস্ট্রেলিয়ার প্রত্যন্ত কান্ট্রি এলাকায় একা থেকেছি দীর্ঘদিন। কিন্তু একাকীত্বের বেদনায় ক্লেশ-বিদ্ধ হয়ে নিজেকে এমন পরাস্ত মনে হয়নি কখনো।

হঠাৎ করে বিছানার পাশে রাখা টেলিফোনে চোখে পড়লো। সাথে সাথে সিডনীতে বাসায় ডায়াল করে বসলাম। আমার বড় মেয়ে মুনিরা টেলিফোন ধরলো। এর পরের টুকু ঠিক মনে নেই, ঝাপসা হয়ে আছে স্মৃতিতে। কন্যা মুনিরার কণ্ঠ শুনে, নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি, শিশুর মত কাঁদতে শুরু করলাম। কোন কথা বলা সম্ভব হয়নি। কেনো এমন করেছি তা ঠিক বলতে পারবোনা। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি পুরুষদের নাকি কাঁদতে নেই। চোখের জল পুরুষদের জন্য নয়; কোনো অবস্থাতেই বাড়ীর কর্তার ভেঙ্গে পড়া চলবেনা। মনে পড়ে একাত্তরের কথা। আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাই নিখোঁজ হবার পর মাকে দেখতাম প্রায় বিলাপ করে কাঁদতে। মা যখন কাঁদতেন বাবা তখন ঘন ঘন পায়চারী করতেন বারান্দায় কিংবা বিবর্ণ মুখ নিয়ে চেয়ারে বসে আকাশের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকতেন। বাবার চোখ দেখলে মনে হোতো যেনো মরা ইলিশের নিথর দু’টো চোখ দেখছি। বাবাকে কাঁদতে দেখিনি কখনো। তবে দোহা শহরের অচেনা হোটেলের নির্জন কক্ষে সেদিন মনে হলো হোক সে পুরুষ বা নারী, বেদনার রং সবার কাছেই এক এবং অভিন্ন।

টেলিফোনের অপর প্রান্তে আমাকে ভয়ানক ভেঙ্গে পড়তে দেখে আমার অতটুকুন মেয়ে অনেকটা মায়ের মত উল্টো আমাকে সান্তনা দিয়ে বললো - “বাবা তুমি যদি কাঁদো, তাহলে আমারও যে কান্না পাবে। তুমি আমাদের ছেড়ে গিয়েছো একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। তুমি হলে আমার আইডল, অমি জানি তুমি সফল হবে।” আমার স্ত্রী সেলী টেলিফোন ধরার পরও আমার চোখের বন্যা থামেনি। সেলী রীতিমত বিচলিত হয়ে বললো, তোমার আর কাতারে থাকার দরকার নেই। রিটার্ন টিকিটতো কাটাই আছে, আর এখানে তোমার চাকরীও আছে। এখনি সিডনী ফিরে এসো।

এরপরের ঘটনাগুলি এখন ইতিহাস। আমি এখনো কাতারের দোহা শহরেই আছি। দোহায় বসেই অন্তর্জালে বাংলা-সিডনি সহ সিডনীর অন্যান্য ডিজিটাল সংবাদ মাধ্যমে নিয়মিত চোখ রাখছি।

............(চলবে)




পরের পর্ব




আব্দুল্লাহ আল-মামুন, কাতার থেকে




Share on Facebook               Home Page             Published on: 29-Sep-2016

Coming Events: