এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ - আব্দুল্লাহ আল মামুন
সিডনী থেকে বন্ধু সামদানি ভাইবারে জানালো, "আব্দুল হক ভাই আর নেই"। খবর শুনে চমকে উঠলাম। এইতো গত ঈদুল ফিতরের ক’দিন আগের কথা। কাতার থেকে সিডনী এসেছি সপ্তাহ দু’য়েক হল। সিডনী ছেড়েছি সেই ২০০৮ সালে। এর মধ্যে বেশ ক’বার সিডনী আসলেও ব্যস্ততার জন্য হক ভাইয়ের সাথে দেখা করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কেনো জানিনা এবার ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক হক ভাইয়ের সাথে দেখা করেই তবে ফিরবো। এখন মনে হচ্ছে, হক ভাই না ফেরার দেশে চলে যাবেন বলেই কি শেষ দেখার সুযোগ করে দিলেন সৃষ্টিকর্তা? তবে একথা নিশ্চিত, সেদিন হক ভাইয়ের সাথে দেখা না হলে নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারতাম না।
হক ভাইকে টেলিফোন করে জানতে চাইলাম কখন তার সাথে দেখা হবে। ইথারে আমার কণ্ঠ শুনেই তিনি উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। এক নাগাড়ে একে একে অনেক প্রশ্ন করে গেলেন - কোথায় আছি, কেনো যোগাযোগ রাখিনি ইত্যাদি। বললেন, "কোয়েকার্স মসজিদে চলে আসুন, তারাবীহ নামাজের পরই কথা হবে।" তাঁর কণ্ঠে আমার জন্য যে ভালোবাসা ও আন্তরিকতার কোমল ছোঁয়া পেলাম তাতে মনটা ভরে গেলো। দুরে চলে গেলেও তাঁর এক সময়কার সহযোদ্ধাকে ভোলেননি হক ভাই। নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল।
রাত ৯টা পেরিয়ে গেছে । কোয়েকার্স হিল মসজিদে পা রাখলাম। তখনও তারাবীর নামাজ চলছে। সেন্ট ম্যারিস মসজিদে তারাবী পড়ে ফেলেছি তাই মূল মসজিদ ভবনের পাশে নির্মিত তাবুতে যেয়ে বসলাম। অপেক্ষা করছি কখন নামাজ শেষে হক ভাইয়ের সাথে দেখা হবে। কোয়েকার্স হিল মসজিদ চালু হবার পর আমার এই প্রথম আসা। তাবুর নির্জনতায় মনটা হচ্ছিল এলোমেলো। হাতড়ে বেড়াচ্ছিল ফেলে আসা ধূসর স্মৃতির ডায়রির পাতাগুলো। ............ ............
৯০ দশকের প্রথম দিকের কথা। সিডনী শহরের সেফটন এ বাংলাদেশ কম্যুনিটির প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মসজিদ। হক ভাই বললেন, "ব্ল্যাকটাউন-হিলস এলাকায় যে হারে বাংলাদেশীদের জনসংখ্যা বাড়ছে, তাতে এই এলাকায় একটা মসজিদের প্রজেক্ট আমাদের হাতে নেয়া উচিত।" তবে তার মতে সেটা কেবল মসজিদ নয়, হবে একটা বহুমুখী সেন্টার। যেখানে থাকবে কম্যুনিটি হল, লাইব্রেরী, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদি। আমাকে বললেন, "আপনি এ নিয়ে একটা লেখা তৈরি করুন যা জনমত তৈরিতে সাহায্য করবে"। "ব্ল্যাকটাউন হিলস ইসলামিক সেন্টার" নামে একটি লেখা তৈরি করলাম। উত্তর আমেরিকার একটি বহুমুখী ইসলামিক সেন্টারের আদলে ব্ল্যাকটান এলাকায় ইসলামিক সেন্টার নির্মাণের রূপরেখা দেয়া হলো ওই লেখাতে। আমার লেখাটি হক ভাই যে অসাধারণ দক্ষতার সাথে সম্পাদনা করলেন তাতে লেখাটা তাঁর নামেই গেলেই হয়তো সঙ্গত হত। এর সাথে তহবিল সংগ্রহের জন্য নীতিমালা তৈরি করে হক ভাই মাঠে নেমে পড়লেন। এর পরেরটুকু আমাদের সবারই জানা। কোয়েকার্স মসজিদ এখন আর ড্রিম প্রজেক্ট নয়, একটি বাস্তব সত্য।
এই ব্ল্যাকটাউনেই শুরু হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার ক্যান্সার কাউন্সিলের জন্য তহবিল সংগ্রহের কর্মসূচী Good Morning Bangladesh. হক ভাই বললেন, "অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত হবার জন্য আমাদের কিছু কর্মসূচী হাতে নিতে হবে।" সেই ভাবনা থেকেই Good Morning Bangladesh কর্মসূচীর শুরু। যা এখন সিডনীর অন্যান্য সাবার্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। হক ভাইয়ের জনকল্যাণে মূলক প্রজেক্টের তালিকা অনেক দীর্ঘ। যে দুটো উদ্যোগের সাথে আমার সম্পৃক্ত হবার সৌভাগ্য হয়েছিলে কেবল তারই উল্লেখ করলাম। সমাজের জন্য, অন্যের কল্যাণের জন্য, একজন মানুষ নিজেকে কিভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে তা হক ভাইকে কাছ থেকে না দেখলে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
আমার মাঝে মাঝে মনে হতো, একি করছেন হক ভাই? তিনি এতো কিছু সামলাতে পারবেন তো? প্রতিবন্ধকতার কথা ভেবে অনেক কর্মকাণ্ড থেকে কখনো গুটিয়ে নিতাম নিজেকে, ঢুকে গড়তাম নিজস্ব খোলসে। কিন্তু হক ভাই ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। কোনো প্রজেক্ট হাতে নিলে তাঁর লক্ষ্য থাকতো স্থির এবং অবিচল। মনে হতো তিনি যেন ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন। আমার অস্থিরতা দেখে তিনি বলতেন, "ধৈর্য ধরুন, আমরা সফল হবোই ইনশাল্লাহ"। চরম প্রতিকূলতাকে হক ভাই জয় করেছেন হাসি মুখে। এই বিরল গুণই তাঁকে নিয়ে গেছে এক অসাধারণ উচ্চতায়।
............ ............ নামাজ শেষে মুসল্লিদের কোলাহলে সম্বিত ফিরে পেলাম। মসজিদে ঢুকেই দেখতে পেলাম হক ভাইকে। আমাকে দেখেই বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় ছিলাম এতদিন। কোলাকুলি শেষে মসজিদের ইমামকে তার একজন পুরনো সহযোদ্ধা হিসাবে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মসজিদ থেকে বের হয়েই ইফতার মাহফিলের জন্য বাইরে বিছানো মাদুর গুটিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। এই ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় হক ভাই।
চির বিদায় নেয়াটা অপ্রত্যাশিত নয়। এটা অমোঘ সত্য। তবে আমাদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন যারা নিজের কর্ম ও ভালোবাসা দিয়ে মানুষের হৃদয়কে এমন করে ছুঁয়ে যান যে, তাদের চলে যাওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। মনে হয়, আহা! যদি আরো কিছুটা দিন উনি বেঁচে থাকতেন আমাদের মাঝে? হক ভাই হলেন তেমনই একজন মানুষ যার মৃত্যু হলেও কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি সবার মাঝে বেঁচে থাকবেন চিরদিন। তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বার বার মনে পড়ছে কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লার লেখা আমার খুব প্রিয় ক’টি পংক্তিমালাঃ চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয় - বিচ্ছেদ নয় - চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না-থাকা জুড়ে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন, কাতার |