আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্বের সীমাবদ্ধতা প্রমাণ করেছিলেন যে বাঙালি বিজ্ঞানী ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন
অমল কুমার রায়চৌধুরী। আপেক্ষিকতাভিত্তিক বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সমীকরণের স্রষ্টা, যা “রায়চৌধুরী সমীকরণ” নামে সুপরিচিত। তাঁর কাজের ওপর ভিত্তি করে স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজ প্রমাণ করেছেন সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু। এটা সৃষ্টিতত্ব গবেষণায় যে কত বড় সাফল্য তা লিখে প্রকাশ করা যাবেনা।
রায়চৌধুরীর জন্ম ১৯২৩ সালে বাংলাদেশের বরিশালে। শৈশবেই পরিবার সাথে তিনি কোলকাতা পাড়ি দেন এবং ওখানেই থিতু হন। তাঁর পিতা ছিলেন কলকাতার একটি স্কুলের গণিতের শিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান ও গণিতের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল ঝোঁক। স্কুলজীবন শেষে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএসসি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি শেষ করে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সে (আইএসিএস) রিসার্চ অফিসার হিসাবে যোগ দেন।
কিন্তু গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে তাঁর মনোমালিন্য হয়। উনি চাচ্ছিলেন আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ব নিয়ে তাত্বিক গবেষণা করতে আর কর্তৃপক্ষ চাচ্ছিল পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের উপর কাজ করতে। এ বিষয়ে পরামর্শ নিতে দু’জন কিংবদন্তী বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বসুর সাথেও তিনি কথা বলেন। বিশ্বের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরাও তখন আইনস্টাইনের তত্ব ও সমীকরণ বুঝতে পারতোনা। তাই তাঁরাও তরুণ বিজ্ঞানী রায়চৌধুরীকে এ নিয়ে গবেষণা করতে নিরুৎসাহিত করলেন। কিন্তু দমে যাননি তিনি। প্রতিকূলতার মধ্যেও রায়চৌধুরী মৌলিক গবেষণা চালিয়ে যান। ফলশ্রুতিতে ১৯৫৫ সালে আমেরিকার বিখ্যাত ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত হয় সিঙ্গুলারিটি বা পরমবিন্দু বিষয়ক তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ Relativistic cosmology (I) এই প্রবন্ধে তিনি উত্থাপন করেন বিখ্যাত ‘রায়চৌধুরী সমীকরণ’।
সিঙ্গুলারিটি হচ্ছে মহাকর্ষের এমন একটি অবস্থা যেখানে প্রচলিত বিজ্ঞানের সব সূত্র ভেঙ্গে পড়ে, এমনকি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বও কাজ করেনা। অমল রায়চৌধুরীর সমীকরণ থেকে প্রথম ধারণা পাওয়া যায় যে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ব প্রয়োগ করে একটি পরম বিন্দু থেকে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল (বিগ-ব্যাং) আর এই সিংগুলারিটি এড়িয়ে যাওয়া আমাদের জন্য সম্ভব নয়। প্রতিটি ব্ল্যাকহোলোর কেন্দ্রে রয়েছে এমন একটি সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু। তবে সিঙ্গুলারিটি বিহীন মহাবিশ্বের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি প্রফেসর রায়। তিনি মনে করেন আপেক্ষিক ততের সাথে কোয়ান্টাম অভিকর্ষ ততের প্রয়োগ করে এই সমস্যার সমাধাb করা যেতে পারে। সৃষ্টিতত্ব নিয়ে তাঁর এই মৌলিক কাজ আলোড়ন তোলে পশ্চিমা বিশ্বে।
রায়চৌধুরী ১৯৬০ সালে ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর ডক্টরেট থিসিস মূল্যায়নের জন্য মনোনীত করা হয় আরেক বিখ্যাত মার্কিন বিজ্ঞানী জন হুইলার। জন হুইলার এমন এক বিজ্ঞানী, যাঁর নামে কণাবাদী সৃষ্টিতত্ত্বে একটি সমীকরণও রয়েছে। বুঝে দেখুন ওই সময়কার ডক্টরেট ডিগ্রীর মান কতটা উঁচু ছিল। ডক্টরেট শেষ করে রায়চৌধুরী ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়েরে এক কনফারেন্সে গিয়েছিলেন রায়চৌধুরী। সেখানে তাঁর সঙ্গে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের প্রথম পরিচয় হয়। আর দেখা হয় কিংবদন্তি বিজ্ঞানী জয়ন্ত নরলিকার ও স্যার ফ্রেড হয়েলের সাথে। সৃষ্টিতত্ব নিয়ে এ দু’জন বিজ্ঞানীর রয়েছে Hoyle–Narlikar theory. রায়চৌধুরীকে দেখে ফ্রেড হোয়েল, একটি মন্তব্য করেছিলেন - He is so young? তিনি ভাবতেই পারেননি রায়চৌধুীর মত একজন অল্প বয়স্ক বিজ্ঞানীর কাছ থেকে এমন একটি জটিল সমীকরণ আসতে পারে।
রায়চৌধুরী অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। তাঁর স্ত্রীর ভাষায়, পোশাক-আশাকে তিনি ছিলেন খুবই আনস্মার্ট একজন মানুষ। জীবনে একবারই স্যুট পড়েছিলেন, তাও আবার যখন আমেরিকায় কনফারেন্সে গিয়েছিলেন তখন। সাধারণ একটি পাঞ্জাবী ও ধূতি পড়ে ট্রামে চড়ে নিয়মিত প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করতে যেতেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের গেইটের মুখেই এক চানাচুরওয়ালা চানাচুর বিক্রি করতো। ট্রাম থেকে নেমে কলেজে ঢোকার আগে তিনি প্রতিদিন এক ঠোঙা চানাচুর কিনে চিবুতে চিবুতে ক্লাসে যেতেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ও অন্যান্য শিক্ষকরা ভাবতেন এই চানাচুরে হয়তো রয়েছে এমন কিছু গুণ যা রায়চৌধুরীকে এতো বড় বিজ্ঞানীতে পরিণত করেছে। এরপর ওই চানাচুরওয়ালার ভাগ্য খুলে খুলে যায়। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকরা ওই চানাচুরওয়ালা কাছ থেকে নিয়মিত এক ঠোঙা করে চানাচুর কিনে খেতেন।
আজ মহাবিশ্ব সৃষ্টিতত্বের কথা বললেই উঠে আসে পেনরোজ, হকিং, ফ্রিম্যান ডাইসন, ফ্রেড হোয়েল কিংবা রিচার্ড ফাইনম্যান এর মত বিজ্ঞানীদের নাম। কিন্তু রায়চৌধুরীর কথা আমরা কতটুকু জানি? রায়চৌধুরী বিদেশে যাননি, বিশ্বখ্যাত কোনো ল্যাবেও কাজ করেননি। যা করেছেন দেশে বসেই করেছেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের সাদামাটা একটি ছোট্ট কক্ষে বসে তাঁর ভাবনার দিগন্ত ছুঁয়েছিল মহাবিশ্ব শুরুর সেই আদি মুহূর্ত, আবিষ্কার করেছিলেন যুগান্তকারী সমীকরণ।
২০০৫ সালের ১৮ই জুন পরলোক গমন করেন বিজ্ঞানী রায়চৌধুরী। আজকাল একজন মধ্যমানের ইউটিউব প্রভাবীর যে পরিচিতি সেই তুলনায় রায়চৌধুরীর মত বিজ্ঞানীদের চেনে কয়জন? কতটুকু সম্মান তাঁকে দিতে পেরেছি আমরা? আমি নিজেও তাঁর সম্পর্কে জানতে পেরেছি মাত্র কিছুদিন আগে। সত্যি বলতে কি রায়চৌধুরীর কাজ প্রথমে পশ্চিমা বিশ্বে স্বীকৃতি পাওয়ার পরই ভারতে মাতামাতি শুরু হয়। এই প্রসঙ্গে তাঁর স্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ’আমাদের সমাজের এটাই নিয়ম, বিদেশীরা প্রশংসা না করলে আমরা আমাদের মেধাগুলোর দাম দেইনা।
 ড. আব্দুল্লাহ আল-মামুন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|