bangla-sydney













সোলসের সুবর্ণজয়ন্তী ও আমার স্মৃতিকথা
ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন


সত্তর দশকের শেষের দিকের কথা। পঞ্চপাণ্ডব বলে পরিচিত আজম খান, ফেরদৗস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর ও পিলু মমতাজ তখন বাংলা ও ফোক গানগুলো ইলেকট্রিক গীটার, ড্রাম, কী-বোর্ডের মত পাশ্চাত্য যন্ত্রানুসঙ্গে গেয়ে দেশ মাতাচ্ছিলেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে লাকী আখন্দের কণ্ঠে “এই নীল মণিহার” গানটি আমার মতো অগণিত তরুণ ও যুব সমাজের হৃদয়ে রীতিমত ঝড় তুলল। পুরো দেশ যখন লাকী ভাই ও পঞ্চপাণ্ডবের গানের সুরে বুদ হয়ে আছে তখন চট্টগ্রামে সোলস নামের একটি অখ্যাত ব্যান্ডের হাত ধরে গানের ভুবনে ঘটছিল নীরব বিপ্লব। তখন কেউ কি জানতো, সোলস-এর গান আধুনিক ও ব্যান্ড সঙ্গীতের মোড় ঘুরিয়ে দেবে? সোলসই হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘায়ু ব্যান্ড?

সাজেদ উল আলম ও মমতাজুল হক লুলুর হাতে ধরে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত “সুরেলা” নামের অর্কেস্ট্রা দল হিসাবে যাত্রা শুরু করলেও ১৯৭৩ সালে নাম বদলে গঠিত হয় “সোলস” ব্যান্ড। তখন চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ পাড়ার অনুষ্ঠানে আধুনিক বাংলা, লালন, ভাওয়াইয়া, প্রচলিত ফোক ও হিন্দি গান পরিবেশন করে প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করে সোলস। তবে হোটেল বা ক্লাবে অনুষ্ঠান করার সময় ইংরেজি গানও পরিবেশন করত সোলস।

প্রতিষ্ঠালগ্নে সোলসের লাইনআপ ছিল এরকম - সাজেদ-উল-আলম: রিদম গিটার, একোর্ডিয়ান; সুব্রত বড়ুয়া রনি - ড্রাম, মমতাজুল হক লুলু - লিড গিটার/বেনজু, তপন চৌধুরী - বাংলা গায়ক, রুডি - বেস গিটার ও ইংরেজি গায়ক, লরেঞ্জো - রিদম ও ইংরেজি গায়ক। পরবর্তীতে যোগ দেন নকীব খান, নাসিম আলী খান, আহমেদ নেওয়াজ, আইয়ুব বাচ্চু, পিলু খান ও, মোহাম্মদ আলী সহ আরো অনেকে। যতদূর জানি, তপন চৌধুরী, রুডি, লরেঞ্জা ও আইয়ুব বাচ্চুর মত শিল্পীদের সুব্রত বড়ুয়া রনিই সোলসে টেনে আনেন। রনি দা একজন উচ্ছল ও প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন। মনে পড়ে, ২০১৬ সালে চট্টগ্রামে আমার অডিও অ্যালবাম প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালে অসুস্থতা নিয়েও তিনি ছুটে আসেন। সাথে নিয়ে আসেন বন্ধু মো: আলী ও নেওয়াজ ভাইকে।

সত্যি বলতে কি, তপন চৌধুরী ছিল সোলসের প্রাণ-ভ্রোমরা। তপনকে বাদ দিয়ে সোলসের কথাই ভাবা যায়না। তপন চৌধুরীর গাওয়া গানগুলো সব ধরণের স্রোতাদের হৃদয়ে খুব সহজেই জায়গা করে নিয়েছিল। বন্ধু তপনের ভিন্ন মাত্রার গায়কী ও কণ্ঠের যাদু পরবর্তীতে সোলসের সাফল্যের অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি।

১৯৭৪ সালে কী-বোর্ডিষ্ট হিসাবে নকীব খান যোগ দেয়ার পর সোলস-এর গতিপথ বদলে যায়। নকীব খানের সুরে সোলস নিজস্ব মৌলিক গান তৈরি করতে শুরু করে। আর “সোলস” ব্যান্ড হিসাবে আত্মপরিচিতি খুঁজে পায়। নকীব খানের সুর ছিল ওই সময়ে অন্যদের চেয়ে অনেকটা আলাদা। গানের কথা ও মেলোডিকে গুরুত্ব দিয়ে হামিংয়ের ব্যবহার করে ব্যতিক্রমী সুর করতেন নকীব খান। যা “সোলস”-এর গানে দিয়েছে বৈচিত্র্য, স্রোতারা পেয়েছে নতুনত্বের স্বাদ। ফলে জয় করেছে সবার মন। গানের গুরুত্বপূর্ণ অংশে হামিং-এর ব্যবহারে নকীবের সমকক্ষ আজও কেউ আছে বলে আমার জানা নেই

ব্যান্ড দলগুলোর একটি প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েই জাতীয় পর্যায়ে প্রথম খ্যাতির স্বাদ পায় “সোলস”। ১৯৭৭ সালে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট শাহীন স্কুলের অডিটোরিয়ামে Mod Friendship Link এবং Youth Organisation এর যৌথ উদ্যোগে একটি ব্যান্ড প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এতে ঋষিজ, স্পন্দন সহ তৎকালীন বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যান্ডগুলো অংশগ্রহণ করে। প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন সত্য সাহা, দেবু ভট্টাচার্য ও গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মত কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ ও গীতিকার। প্রতিযোগিতায় সেরা কি-বোর্ড বাদক হিসাবে নকীব খান এবং তাজুল ইমাম সেরা কণ্ঠ শিল্পীর পুরস্কার পান। সর্বোপরি সোলস সেরা ব্যান্ড দলের শিরোপা অর্জন করে। এভাবে সোলস ঢাকায় একটি শীর্ষ ব্যান্ড হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়।

গীতিকার, সুরকার এবং কণ্ঠশিল্পী, এই তিন জনের সৃজনশীল কাজের জন্যই একটি গান সফল বা জনপ্রিয় হয়। এখানে কারো অবদান ছোটো করে দেখার মত নয়। অথচ একটা গান যখন হিট হয় তখন আমার কেবল কণ্ঠশিল্পীর নামই মনে রাখি। গানের যারা মূল কারিগর অর্থাৎ সুরকার ও গীতিকার পর্দার অন্তরালেই থেকে যান। তাই সত্তর ও আশি দশকে সোলস-এর উত্থানের জন্য অবদান রেখেছেন এমন কয়েকজন গীতিকার ও সুরকারের কথা এখন লিখব। এটা অনস্বীকার্য, অনেকের সম্মিলিত অবদান ও প্রচেষ্টার জন্যই সোলস আজকের এই অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, গানের ভুবনে এখনো নক্ষত্র হয়ে জ্বল জ্বল করছে। আমার লেখায়, যাদের সাথে আমার নিবিড় যোগাযোগ ছিল শুধু তাঁদের কথাই উঠে এসেছে। তাই অনেকের নাম হয়তো বাদ পড়ে গেছে। তবে এটা স্বেচ্ছাকৃত বা কাউকে খাটো করার জন্য নয়।

তাজুল ইমাম সোলস-এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৮১ সাথে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর আগ পর্যন্ত কণ্ঠ শিল্পী হিসাবে সোলস-এর সাথে গান পরিবেশন করেন। তিনি সোলসে-এর বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের সুরকার ও রচয়িতা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে – খুঁজিস যাহারে, এই কীর্তিনাশার তীরে, ফুটবল, কান্দিস কেনে মন পাগলারে ও শিমুল ফুটেছে, পলাশ ফুটেছে। শিমুল ফুটেছে গানটি মূলত সোলস-এর জন্য করা হলেও পরে তপন চৌধুরীর প্রথম সলো অ্যালবামে স্থান পায় ও তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাজুল ইমামের “পঞ্চ গায়েন” নামের একটি বাউল দল ছিল। তিনি বাউল কালা শাহ থেকে “রসিক আমার মন বান্ধিয়া”র মত বেশ কিছু বাউল গান সংগ্রহ করে সোলস-এর গানের সংগ্রহকে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ করেছেন।

নকীব খানের বড় ভাই জিলু খান চট্টগ্রাম বেতারের একজন প্রখ্যাত সুরকার ও গায়ক ছিলেন। বালার্ক নামে তাঁর একটি ব্যান্ড ছিল যার সদস্য ছিল নকীব খান ও পিলু খান। জিলু ভাইয়ের সুর করা সোলস-এর বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে - মন শুধু মন ছুঁয়েছে, মনে কর এখন অনেক রাত, সুখ পাখী আইলো উড়িয়া ইত্যাদি। কিন্তু দীর্ঘদিন গানের জগত থেকে দূরে সরে থাকায় জিলু ভাইয়ের কথা অনেকেরই অজানা। জিলু ভাইয়ের বন্ধু কবি হেনা ইসলাম সোলস-এর জন্য “কলেজের করিডোরে একদিন”, ফরেস্ট হিলে এক দুপুরে, মনে কর এখন অনেক রাত, সুখ পাকী আইলো উড়িয়ার মত কিছু দুরন্ত গান রচনা করেছেন।

এছাড়া সোলস-এর জন্য গান লিখেছেন স্বনামধন্য গীতি-কবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গি। যিনি প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্ত, ভালোবাসি সবুজ মেলা, চায়ের কাপে পরিচয় ও বাচ্চুর সুরে “একদিন ঘুম ভাঙ্গা শহরে“-এর মত বেশ কিছু জনপ্রিয় গান লিখেছেন। “একদিন ঘুম ভাঙ্গা শহরে” গানটি সোলস-এর হয়ে বিটিভিতে পারফর্ম করেছিল বাচ্চু। কিন্তু সোলস ছেড়ে যাবার সময় সবার অনুমতি নিয়ে গানটি বাচ্চু নিজের রক ব্যান্ড ‘এলআরবি’র জন্য নিয়ে যায়। এটি ছিল এলআরবি ব্যান্ডের প্রথম গান যা পরবর্তীতে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।

১৯৭৯ সালে লিড গিটারিস্ট সাজেদ বিদেশে চলে গেলে সোলসে-এ গিটারিস্ট হিসাবে আসে আইয়ুব বাচ্চু। আইয়ুব বাচ্চু ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সোলসের সাথে ছিলেন। লিড গীটার বাজানোর পাশাপাশি সোলস-এর জন্য কলেজের করিডোরে, ফরেস্ট হিলের মত অনেক গানের তিনি তিনি সুর করেন। এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে পার্থ বড়ুয়া সোলস-এ যোগ দেয়। নকীব খান ও আইয়ুব বাচ্চুর মত কিংবদন্তি সুরকারদের যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে একের পর এক জন-নন্দিত গান তৈরি করে সোলস-এর জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছে পার্থ বড়ুয়া। সোলসে এখনো আছে আমাদের সময়কার নাসিম আলী খান। যিনি এখনো পরম মমতায় নতুন সদস্যদের নিয়ে সোলসকে আগলে রেখেছেন। সোলস-এর বর্তমান লাইনআপ হচ্ছে- নাসীম আলী খান: কণ্ঠ, পার্থ বড়ুয়া: গীটার ও কণ্ঠ, আহাসানুর রহমান আশিক: ড্রামস, মীর মাসুম: কি-বোর্ড ও মারুফ হাসান: বেজ গীটার।

সোলস-এর প্রায় সব সদস্যদের সাথে সখ্য থাকলেও শৈশবের বন্ধু হবার সুবাদে নকীব খানের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল একটু বেশী। নকীব খানের বাবা শ্রদ্ধেয় আইয়ুব খান চট্টগ্রাম কাজেম আলী হাই স্কুলের আমৃত্যু প্রধান শিক্ষক ছিলেন। স্কুলের সাথেই ছিল নকীবের বাসা। ওর বাড়ীতেও আমার নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল।

৭৬/৭৭ সালের কথা। স্কুলে পাঠ শেষ করে ভর্তি হলাম চট্টগ্রাম কলেজে। নকীবও আসলো একই কলেজে, জায়গা পেলাম একই সেকশনে। সোলসের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নকীবের বাড়ীতে রিহার্সাল হত। সেই সুবাদে প্রায় ওর বাসায় ব্যান্ডের অন্য সদস্যদের সাথে গানের আড্ডা জমতো। কলেজের প্রায় ২০০ মিটার দূরেই ছিল নকীবের বাড়ী। দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে প্রায় ওর বাসায় গিয়ে আড্ডা দিতাম। নতুন কোনো গান সুর করলেই নকীব আমাকে গেয়ে শোনাতো।

আমার পরিবারে লেখালেখি, সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক চর্চার একটা আবহ ছিল। সেই পারিবারিক ঐতিহ্যকে লালন করেই ছোটবেলা থেকে কবিতা ও সঙ্গীত চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়ি। ওই যুগে ছিলনা ফেসবুক কিংবা ম্যাসেঞ্জার চ্যাট গ্রুপ। কবিতা ও শিল্প চর্চা কিংবা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে ও খেলাধুলো করেই সময় কাটতো। কিন্তু আমি যে ব্যান্ডের জন্য গান লিখবো সে কথা কখনো ভাবনি।

ক্লাসে দুষ্টুমি ও খুনসুটি করার যাতে সুযোগ হয় সেজন্য বসতাম গ্যালারীর সবচেয়ে পেছনের সারিতে। একবার চট্টগ্রাম কলেজের সায়েন্স গ্যালারীর শেষ মাথায় বসে আছি দু’জন। ক্লাসের একজন বান্ধবীকে ক্লাস-রুমের সামনের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখেই “তোরে পুতুলের মতো সাজিয়ে” গানটির ভাবনা মাথায় আসে। গানটি নিয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু শব্দমালা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। একটি চিরকুটে লিখে ফেললাম গানের প্রথম অন্তরা। চিরকুটটি নিয়ে বাড়ী গিয়েই গানের সুর করে ফেলে নকীব। প্রথমে গানটির প্রথম লাইনে “হৃদয়ের সো-কেসে রাখবো” লিখা হয়। কিন্তু পরে বন্ধু তপন চৌধুরীর সো-কেসপরামর্শে সো-কেস এর পরিবর্তে একটু সহজতর “কোঠরে” শব্দটি ব্যবহার করা হয়। তোরে পুতুলের করে সাজিয়ে ছিল আমার লেখা প্রথম কোনো গান। এরপর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ফেলে আসা শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে “মুখরিত জীবন” ও কৈশোরের একটি

বিয়োগান্তক ঘটনা নিয়ে লিখি “ভুলে গেছো তুমি” সহ আরো বেশ কিছু গান।

সোলসের চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিলনা। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় সোলসের প্রথম অডিও ক্যাসেট অ্যালবাম ‘সুপার সোলস’। তবে এই অ্যালবামটি বের করতে সোলসকে অনেক কাট-খড় পোড়াতে হয়েছে। ঢাকায় অনেকের দুয়ারে ধর্না দিয়েও প্রথমে অ্যালবামটি কিনতে কেউ আগ্রহ দেখায়নি। অবশেষে দেবু ভট্টাচার্য অ্যালবামটি প্রযোজনা করতে রাজী হন। কাকরাইলের মোড়ে ইপসা স্টুডিওতে অ্যালবামের রেকর্ডিং হয়। স্টুডিওর মালিক এবং রেকর্ডিষ্ট ছিলেন জিংগা শিল্পী গোষ্ঠীর শাফায়াত আলী। অ্যালবাম করতে খচর হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা তবে প্রযোজক সোলস-কে ১৭ হাজার টাকা দিতে সম্মত হয়। ক্যাসেটটি বের হবার পর দেশজুড়ে রীতিমত শোরগোল পড়ে যায়। এটি ছিল দেশের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে অন্যতম সফল ও জনপ্রিয় অ্যালবাম। এরপর সোলসকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

সোলসের এই যুগান্তকারী অ্যালবামে ছিল আমার লিখা তিনটি গান - তোরে পুতুলের মতো করে, মুখরিত জীবন ও ভুলে গেছো তুমি। তোরে পুতুলে মতো করে গানটি মূলত সোলস এর হলেও অ্যালবাম প্রকাশনার আগেই কুমার বিশ্বজিত বাংলাদেশ টেলিভিশনে পরিবশেন করে। যা রাতারাতি বাংলাদেশের একটি অন্যতম জনপ্রিয় গান হিসাবে খ্যাতি পায়। অন্যদিকে আমার লেখা “মুখরিত জীবন” গানটির জনপ্রিয়তায় এখনো যেন এক পরদ ধুলোও পড়েনি। হিট হবে, এজন্য কখনো গান লিখিনি। চট্টগ্রাম কলেজের সায়েন্স গ্যালারীতে বসে লেখা কিছু অসংলগ্ন পদ্য যে কালজয়ী গান হয়ে যাবে, পাঁচ দশক পর আজ একুশ শতকের প্রান্তে এসেও মানুষের মুখে মুখে ফিরবে তা কখনো ভাবিনি।

ইদানীং গান হিট হলো কিনা তা নির্ধারণ করা হয় গানটির ইউটিউবে ভিউয়ারের সংখ্যার উপর। এজন্য ব্যবহার করা হচ্ছে প্রযুক্তি। ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব ও টিকটকের মত বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে দেয়া হচ্ছে অ্যাড। পত্র-পত্রিকা ও অনলাইন মিডিয়ার জন্য তৈরা হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের কনটেন্ট। এগুলো সস্তায় আসেনা। এজন্য ব্যয় করতে হয় অনেক অর্থ। বহু গীতি-কবি ও কণ্ঠশিল্পীরা গানকে জনপ্রিয় করার জন্য এ পথেই এগুচ্ছেন।

তবে লক্ষ লক্ষ ভিউয়ার হলেই কি একটি গানকে হিট বলা যাবে? কক্ষনো নয়। একটি গানের সত্যিকারের জনপ্রিয়তার বিচার করতে হয় সময়ের মাপে, ভিউয়ারের সংখ্যা দিয়ে নয়। এজন্য অপেক্ষা করতে হবে হয়তো এক যুগ কিংবা তারও বেশী। এমন অনেক গানের কথা আমরা জানি যেগুলো এক সময় ঝড় তুললেও, সময়ের ঘূর্ণিপাকে কিছুদিনের মধ্যে স্রোতাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। তাই ২০/৩০ বছর পরও যদি একটি গান মানুষের মুখে মুখে তাহলেই বুঝতে হবে গানটি আসলেই হিট হয়েছে। সেই বিচারে সোলস তাদেও প্রায় প্রতিটি এলবামেই কিছু হিট গান উপহার দিয়েছে। পঞ্চাশ বছর পরও সোলস এর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। এটা যেকোনো ব্যান্ডের জন্যই এক অনন্য প্রাপ্তি। আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান যে সোলস-এর জন্য আমার লেখা গানগুলো সেই সত্তর দশক থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজন্মের স্রোতারা এখনো মনে রেখেছে। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?

সোলস এর জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। ঢাকা দেশের রাজধানী হলেও ব্যান্ড সঙ্গীতের সূতিকাগার হল চট্টগ্রাম। এলআরবি, রেনেসাঁ, জেমসের নগর বাউল, ফিলিংস ও স্পাইডারের মত ব্যান্ডের উত্থান এই চট্টগ্রাম থেকেই।

সত্তর দশকে ব্যান্ড সঙ্গীত নিয়ে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা ছিল। মানুষ ভাবতো ব্যান্ড সঙ্গীতের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজে অনুপ্রবেশ করছে। অথচ ব্যান্ড সঙ্গীত হলেও সোলস এর গান তরুণ, যুবক, এমনকি আমাদের আগের প্রজন্মের প্রবীণরাও শুনতেন এবং উপভোগ করতেন। এটাই হচ্ছে সোলসের কৃতিত্ব।

“এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে” - চলতে চলতে আমাদের তারুণ্যের ব্যান্ড সোলস এখন পঞ্চাশে পা দিলেও সোলস এখনো জিইয়ে রেখেছে নিজস্ব ব্রান্ডের সুরের ধারা। বিভিন্ন সময়ে কিংবদন্তি মিউজিশিয়ানরা ব্যান্ড ছেড়ে চলে গেলেও পার্থ বড়ুয়া ও নাসিম আলীর নেতৃত্বে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ধারণ করে সোলস এগিয়ে চলেছে আপন গতিতে। এদের পর হয়তো গিটার হাতে নিয়ে সোলস এর হাল ধরবে আরো এক ঝাঁক স্বপ্ন-বাজ তরুণ। ওদের হাত ধরে এভাবেই বেঁচে থাকবে সোলস যুগের পর যুগ।









Share on Facebook               Home Page             Published on: 17-Jul-2023

Coming Events: