গল্প অহনার অন্ধকার লাকী রহমান
বীরাঙ্গনা। এই সম্মানে অহনার জীবন ওলট পালট হতে পারতো। শেষ হয়ে যাবার মতো পরিবেশের তো অভাব ছিল না। ওর গল্পের যেন একটাই শুরু, 'অহনা এত সুন্দর, কিন্তু জীবনটা …'। পরে বুঝেছে ওর প্রতি মানুষের এই দুঃখবোধ আসলে ওকে নিয়ে গল্প শুরু করার একটি ধরণ। বোধহয় শিক্ষা আর সৌন্দর্যই কারো বউ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, আরও কিছু লাগে যা অহনার নেই। সরাসরি না বললেও প্রায় সবাই অহনাকে কী যেন একটা দোষ দিতে চায়।
পাশবিকতার সেই নয় মাস। কামার যেমন আগুনে পুড়িয়ে লোহাকে আয়ত্তে আনে অহনাকেও তেমনি নিজের মনকে আয়ত্তে আনতে হয়েছে। তখনই বুঝেছিল বাঁচতে হলে কিছু একটা করতে হবে। শুধু নিজের জন্য। শুরু হলো আর এক সংগ্রাম। অদ্ভুত সব চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে কখনো উপেক্ষা করে লেখাপড়া শেষ করেছিল। তারপর এই চাকরি।
পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসাবে নতুন নতুন এলাকায় বদলী ভালোই লাগে অহনার। এক জায়গায় বেশি দিন থাকলে জানাজানি হয়ে যায় অহনার অন্ধকার। একজন মানুষের অন্ধকার আলোচনার জন্য খুব লোভনীয় বিষয়। সে যাই হোক, এভাবে চলতে থাকে অহনার জীবন নিজস্ব নিঃসঙ্গতায়। রাতের নিঝুম একাকীত্বে মনে প্রশ্ন জাগে, 'বিয়েই কি জীবনের সবকিছু'? মনেহয় সব না হলেও অনেক কিছু। সেখানে সব আবেগ ভাগ করে নেবার একজন থাকে। থাকে নিজের অস্তিত্বে বেড়ে ওঠা সন্তান। থাকে ভালোবাসা। কল্পনার সংসার প্রায়ই রাতের স্বপ্ন হয়ে আসে। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর সেই সুন্দরের চেহারা অহনা মনে করতে পারে না।
বীরাঙ্গনা অহনা এখন পরিবার পরিকল্পনার সফল কর্মকর্তা অহনা শিকদার। যার অলসতা নেই। নেই কোনো পিছুটান। চারপাশে শুধু কাজ আর কাজ। স্যাটেলাইট ক্লিনিক পরিদর্শনে যে ধরণের এলাকায় যেতে হয় সেখানে প্রায় সবাই ভাগ্য-বঞ্চিতা নারী। নারী স্বাধীনতা বলতে তারা কিছুই বোঝে না। বছরে তিনটি শাড়ি আর তিন বেলা ভাত পেলেই তারা খুশি। অহনা ওদের বোঝার চেষ্টা করে। বোঝানোর চেষ্টা করে পরিবার ছোট রাখতে হবে কেন ও কীভাবে। ঘরের আশপাশে সবজি লাগিয়ে অপুষ্টি থেকে পরিবারকে রক্ষার কথা বোঝায়। অনেককে আর্থিক সাহায্যও করে। গভীর ভালোবাসায় ওদের সমস্যা বুঝতে চেষ্টা করে অহনা।
শিহাব রহমান মেডিকেল অফিসার। স্যাটেলাইট ক্লিনিকগুলোতে তাকেও যেতে হয়। শিহাব চেষ্টা করে যাওয়াটা যেন অহনার সাথে হয়। যেদিন দূরের ক্লিনিকে যেতে হয় সেদিন তার খুব ভালো লাগে। মন গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে ‘এই পথ যদি না শেষ না হয়’…। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। মনের সুর মুখে ওঠার সাহস পায় না।
অহনার সবকিছুই ভালো লাগে শিহাবের। যতোটা ভালো লাগলে ভালোবাসা হয় ততটা কিংবা তার চেয়েও বেশি। অহনার হাসি, কথা বলা, রুচি, গাম্ভীর্য সবই আকৃষ্ট করে শিহাবকে। অহনার শারীরিক সৌন্দর্যও টানে শিহাবকে। শরীরের ব্যাপারটা মাথায় এলেই সবকিছু ওলট পালট হয়ে যায়। শরীর ছাড়া কি ভালোবাসা হয় ভাবে শিহাব। অহনার মধ্যে কি প্রেম ভালবাসার অনুভূতি আছে? মানব মানবীর ভালোবাসা? বোঝে না শিহাব। ওর ভালোবাসার সবটা জুড়েই যেন কাজ। গত এক বছর একদিনও মনে হয়নি অহনা তাকে ভালোবাসে। তাই ভয় হয় ভালোবাসি বলতে গিয়ে বন্ধুত্বটাও না শেষ হয়। শিহাব ভাবে তারচেয়ে এভাবেই যাক আরও কিছু সময়।
ভরা বর্ষার দুধকুমার নদী। স্রোতস্বিনী, ভয়ংকর। বাতাস থাকলে তো কথাই নেই। আজ নৌকায় ওঠার সময় আকাশের অবস্থা এতোটা খারাপ ছিলো না। কিন্তু মাঝ নদীতে পৌঁছতেই শুরু হলো বৃষ্টি, গর্জন আর অপরিচিত বাতাসের দাপাদাপি। শিহাবের ভয় লাগে। শাড়ি পরা অহনাকে নিয়েই ভয়টা বেশি। কিন্তু অহনাকে চিন্তিত মনেহয় না। অহনা জিজ্ঞেস করে, তুমি সাঁতার জানো তো? নৌকা ভীষণ দুলছে। এক ঝটকায় শাড়ি খুলে ফেলে অহনা। হতভম্ব শিহাব শার্ট খুলে কোনোমতে পরিয়ে দেয় ওকে। অহনা যেন ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী কোনো নারী। জীবন বাজি রেখে শিহাবের দিকে সেদিন অহনাই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলো। তারপর দুজনার মধ্যে দূরত্ব কমেছে।
শার্টটি ফেরত দিতে গিয়েছিলো অহনা। সঙ্গে একটি নতুন শার্টও কিনেছিলো। শিহাবের খুব পছন্দ হলো নতুন শার্টটি। সাথে সাথে পরেও ফেললো। পুরনোটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো তুমিও পরবে নাকি সেদিনের মতো। ভেংচি কেটে অহনা বললো আর একটু হলে তো পটল তুলতে হে বাঙালী বীর। শিহাবকে বলতেই হলো… তা সত্যি, তুমি আসলেই স্মার্ট। অনন্যা। ঠাস করে বলে ফেলে অহনা অনন্যা, আমি অনন্যা কখনোই না। আমি তো বীরাঙ্গনা। তুমি জানো আমার জীবনে আছে নয় মাসের অন্ধকার?
স্তম্ভিত শিহাব অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলো। অহনার অনেক আচরণের ব্যাখ্যা স্পষ্ট হয়ে গেলো তার কাছে। চোখে চোখ রেখে শুধু বললো ‘একটা দেশ স্বাধীন করতে অনেক কিছুই হারাতে হয়’। তারপর খুব সাহস করে অহনার হাতটা ধরলো। গোপন ভালোবাসার, পরম নির্ভরতার সেই হাত। একটু কি কেঁপে উঠেছিলো অহনা।
সে রাতে বাড়ি ফিরে চায়ের মগ হাতে ছাদে উঠেছিলো অহনা। আজ চাঁদের আলোর বান ডেকেছে আকাশে। মনে হচ্ছে স্বর্গের দুয়ার খুলে গেছে। আর তারারা ফুটন্ত ফুল হয়ে সুগন্ধ বিলাচ্ছে। ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার অন্ধকার।
লাকী রহমান, রাজশাহী থেকে
|