গল্প নিঃস্ব লাকী রহমান
বনানীর এই দিকটা খুব ভালো লাগে পরমের। বাতাসে পরিচিত গন্ধ। কুজাকৃতি সেতুটা পার হয়ে বামে ঘুরলেই নীলাদের বাসা। আর বাসাটা দেখা গেলেই বুকের ভিতরের পাখিটা ডানা ঝাপটায়। কখনো সে কিছুক্ষণের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায় নয়তো দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে থাকে। এক ঘটনার একাধিক অনুভূতি কেন হয় কে জানে!
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সমাপ্তি শেষে আজও এই যে লম্বা সময়ের মুগ্ধতা পুরোটাই নীলাকে ঘিরে। পরম আর নীলা ছাড়া এত ছোটবেলার কোন বন্ধু নাই ওদের ডিপার্টমেন্ট এ। তাই কতবার যে খাওয়াতে হয়েছে বন্ধুদের। জীবনের এই যে শত শত ঘণ্টা খুব ভালোবাসায় মাখামাখি দেখে মনে হয়, বাসী হয়ে যাওয়ার পরও ভালো লাগার নামই ভালোবাসা। ঢাকা শহরের পিচ মেশানো পাথরগুলো জানে কতটা সুখতলা ক্ষয় হয়েছে দুজনের। বর্ষার বিরামহীন কান্না আর হাড় কাঁপানো শীতের উষ্ণতা সবাই বলেছে আমরা তো আছি।
অথচ সব বন্ধুরাই শেষ সময়ে যেখানে পারিবারিক বন্ধনের কথা ভাবছে তখনও পরম আর নীলা অনিশ্চয়তায়। একজন অভিজাত মুসলিম পরিবারের একমাত্র সন্তান, অন্যজন রক্ষণশীল সনাতন ব্রাহ্মণ। একদিন ধর্ম নিয়ে ভাবনায় নীলা চট করে বলেছিল ধর্ম সামনে এসে দাঁড়াবে যখন তখন তুই তোর মতো আর আমি আমার মতো। তুই মুসলিম আর আমি সনাতন। তুই রোজা রাখবি আর আমি আমার সময় মত উপোষ করব। আমাদের কত রকমের উপোষ আছে জানিস? এক উপোষ নিয়েই কত গবেষণা! : আচ্ছা বুঝলাম। তা বাচ্চারা কোন ধর্ম পালন করবে, মুসলিম না সনাতন? : দুই ধর্মের অনুভূতি থাকতে হবে। জানিনা পরম, শুধু জানি আমি তোকে ভালোবাসি। তুই যখন আমার পাশে থাকিস টবে শুকিয়ে থাকা গাছের গোড়ায় পানি দিলে গাছটা যেমন প্রাণ পায় আমিও তেমনি। তুই শুধু আমার পরম। : এভাবে ভাবলে শুধু তুই আর আমি ভালো থাকবো কিন্তু রক্ষণশীল দুই পরিবারের মাঝে আমাদের সন্তানরা কি ভালো থাকবে? আমরা আমাদের জীবন নিয়ে যা খুশি তা হয়তো করতে পারি কিন্তু সন্তানদের জীবন তো অন্য জীবন। সেখানে যা খুশি তা করা যাবে না। ওদের বেড়ে ওঠার জীবনকে সংকীর্ণ করব আমরা? আমাদের আসলে যে কোনো এক ধর্মের বিশ্বাসী হতে হবে তাহলে হয়তো একদিকের পারিবারিক এবং সামাজিক সহযোগিতা পাবো। আমাদের হাতে তো সময় আছে, ভাবতে হবে আরো। : খুব সময় নেই পরম। ভাবতে হতো সেদিন যেদিন আমরা দুজন এক হয়েছিলাম। আজ তো কিছু ভাববো না।
দৃঢ়তার সঙ্গে পরম বলে - আমি বলছি, বিশ্বাস রাখ। নীলা গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে পরমকে। খুব স্থির এবং সংযত ভাবে বলে, অনেক সময় খুব গভীর ভাবনা থেকে সমাধান বেরিয়ে আসে। সেজন্য বলছি। আমি জানি পরম, শেষ পর্যন্ত তুই এর সমস্যার সমাধান করবি। প্রায় তিন ঘণ্টার আলোচনা শেষে পরম সেই পরিচিত রাস্তায়। উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটি। রাতের গভীরে শুনশান নীরবতা। পরমের মনে হয়েছিল পৃথিবীর বাইরের কোন স্টেশনে চলে এসেছে। পরিচিত রাস্তাগুলো অপরিচিত লাগছে। লাইট পোস্টগুলো নিঃসঙ্গ ভাবে দাঁড়িয়ে আলো ছড়াচ্ছে। সে আলো এসে পড়ছে গাছের পাতায়। তাই রাস্তা জড়িয়ে আলোছায়ার এ্যাবসট্র্যাক্ট আর্ট যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হঠাৎ খেয়াল করে পরম, আসলে বড় রাস্তার দিকে না গিয়ে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে অনেক ভেতরের দিকে চলে এসেছে। ততক্ষণে রাস্তার আলো আধারিতে পথের নির্জনতায় কেমন যেন ভয় ভয় লাগে পরমের। বুকের ভিতরে কে যেন পানির কলটা খুলে দিয়েছে, টিপটিপ করে পানি পড়ছে সেখানে। আরো কিছুদূর যেতেই একটা প্রাইভেট কার থেকে দুজনকে নামতে দেখে পরম। এতক্ষণ ভয়ে যে বুকের মাঝে টিপটিপ করে পানি পড়ছিল তা বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষ দু'জনকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে দেখে ছোট চুলের বেশ ভদ্র বাহ্যিকতার দু’জন মানুষ। মনে মনে ভাবে রাস্তার পাশের মমোর দোকানটা খোলা থাকলে ভালো হতো। মমোর কথা মনে হতেই প্রচণ্ড ক্ষুধায় শরীর ছেড়ে দেয়। আর তখনই পিছনে ধাতব কিছুর ঘর্ষণের শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা পরমকে ঠেলে গাড়িতে ঢোকায়। পরম মাঝে, দুদিকে দু’জন। খুব গভীরভাবে বলল একদম চুপ থাকতে হবে, নিঃশ্বাসের শব্দ যেন ছোট হয়। তারপর ওর সব পকেট খালি করতে বেশি সময় নিল না তারা। যে মানুষদের দেখে কিছুক্ষণ আগে তার ভয় চলে গিয়েছিল সেই মানুষ দু’টোই বড় ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে মাঝামাঝি এক পিলারের কাছে পরমকে নামিয়ে দেয়ার সময় চোখেমুখে চেতনা-নাশক স্প্রে করেছিল। তারপর কিছু বলতে পারে না পরম। কারা তাকে হাসপাতালে নিয়েছে, কে বাবা-মাকে খবর দিয়েছে কিছুই জানে না পরম। আজ আবার শরীরটা বৈশাখের দুপুর বেলার উত্তপ্ত ভূমি বলে মনে হচ্ছে। হার্ট, লাংস সবকিছু সূর্যের তাপে গরম হচ্ছে যেন। মাথা গরম হতে হতে লাভার মত গরম কিছু গলে গলে কান দিয়ে পড়তে চাইছে। এত দুর্বল শরীরে করোনা পজিটিভ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। পরের পনের দিন সুস্থতা আর অসুস্থতা, তন্দ্রা আর ঘুমের টানাটানি। সেলফোনটা তো হাতছাড়া হয়েছে সে রাতেই।
মাস খানেক পর পরম বাড়ির বাইরে যাওয়ার মতো সুস্থ বোধ করছে। আজ মাকে বললো - মা আর ভালো লাগছে না, একটু হাটাহাটি করে আসি। মা রাজি হতেই পরম নীলাদের বাড়িতে যায়। বাড়িটা দেখে আগে যে ভালো লাগা কাজ করতো আজ তা করছে না। যত বাড়িটার কাছে যাচ্ছে পরম তত যেন দূরে সরে যাচ্ছে। শরীরের দুর্বলতা সব আনন্দকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। গেটের কাছে যেতেই দারোয়ান বললো দিদিরা কেউ নেই, সবাই চলে গেছে কলকাতায়। নিজের কানে শোনা শব্দগুলো নিজের কাছেই মিথ্যা মনে হচ্ছে। নীলা হয়তো অসংখ্যবার ফোন দিয়েছে। সেই সব শব্দ যেন কোথাও আটকে ছিল। এখন বাজছে কানের কাছে, অবিশ্বাস্য, অবিরাম। ভরা পূর্ণিমায় সমুদ্র যেমন কাঁদতে না পারা পুরুষের মতো শব্দ করে - পরমের বুকের ভিতর তেমনই হচ্ছে। নীলাদের বাগানের এক কোনায় বসে থাকতে থাকতে নিজেকে মানুষ নয় সমুদ্র মনে হয়। দ্রুত ছুটে আসা অসংখ্য সমুদ্রের ঢেউ যেন তার বুকে আছড়ে পড়ছে। বুকের খুব গভীরে যার বসতবাড়ি, সে বাড়ির দরজাটা খুলে দেয়া হলো না। বাড়িটা এখন একটা পোড়ো বাড়ি। চাবিটা সারা জীবনের জন্য হারাতে চায় পরম। আর কোনো স্বপ্নের বাড়ি দরকার নেই ওর।
শ্রাবণ মাসের মধ্যরাত। গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেছে চারপাশ। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে, সব কিছু আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে নিমেষেই। দোতলার বারান্দায় বসে পুকুরের পানির উপরে চারপাশের গাছপালার উপরে ঘন বৃষ্টির শব্দ শুনছিলো নীলা। কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে বাড়িটাকে স্টিমারের মতো লাগছে। চারপাশে শুধু পানি আর পানি। মধ্যরাতের জন-মানবহীন শূন্যতায় হঠাৎ মনে হলো নীলা যেন এ পৃথিবীর শেষ মানুষ যার কোথাও কেউ নেই। ডান হাত দিয়ে বাম হাতটা স্পর্শ করতেই বরফ শীতল অনুভূতি টের পায় নীলা। সেদিনও এমন শীতল ছিলো অভিজিতের শরীর। ভয়ে, কষ্টে, অপমানে শীতল হয়েছিল নীলাও। মৃত অভিজিতের পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাথার সিঁদুর মুছে দিয়েছিলো স্বজনরা। কয়েকজন মিলে সাদা শাড়ি পড়িয়েছিল নীলাকে।
লাকী রহমান, রাজশাহী থেকে
|