কল্প-কাহিনী করোনার সাথে বসবাস লাকী রহমান
মাত্র দশ মিনিট ট্রেডমিলে হেঁটে ক্লান্ত আরমান রহমান। অথচ একটা সময় ছিলো যখন তিন চার মাইল হেঁটেও হাঁটার আনন্দ থেকে যেত মনে। পদ্মার পাড়ের অক্সিজেন ভরা বাতাস আর পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ আজও মনের বাক্সে বন্দী। অবসরে সেই বাক্স খুললেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে বাতাসের দীর্ঘশ্বাস।
আজকে কি যে হয়েছিলো ঘুম ঘুম চোখে মাথায় বিলি কাটার মতো ঝোপঝাড় আর জঙ্গল দুহাতে সরিয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিলেন তিনি। এক সময় বুনো ভাটফুলের গাঢ় গন্ধ নাকে লাগতেই নাতি রবির ডাকাডাকিতে চোখ খুলে যায়। দাদা ২০২০ সালে করোনা আক্রান্ত হওয়ার আগে আমাদের দেশের অবস্থা কেমন ছিল, তার উপরে ডকুমেন্টারি দেখাচ্ছে। টিভিটা অন করতেই দেখা গেল ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুল ড্রেস পড়ে ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যাচ্ছে। কেউ কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে। শপিং মলগুলোতে বেশ ভিড়। কাঁচাবাজার এবং রাস্তায় পিঁপড়ার সারির মতো মানুষ। পার্কে হাতে হাত রেখে হাঁটছে কেউ কেউ, শিশুরা খেলছে। রেস্টুরেন্ট এবং রাস্তার মোড়ের চায়ের স্টলগুলোতে মানুষের আড্ডা। এ সব দেখে বুকের গভীর থেকে লম্বা নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসে নাতীর জন্য। ভাবেন স্কুলের বন্ধুদের সাথে তার হাজারো স্মৃতি থাকলেও রবির জীবনে কোন স্কুল ক্যাম্পাস নাই। মাঝ বয়সী পৃথিবীর অত্যাচারে কম বয়সী শিশুরাও আজ অস্থির।
এখন ২০৫০ সাল। করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি আজও। ভাইরাসটির প্রতিনিয়ত চরিত্র বদলানোর নেশা। করোনার জটিল চারিত্রিক গঠনের জন্য গবেষকরাও চিন্তিত। তাই মানুষেরা গৃহবন্দী আর ভাইরাসরা ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। এভাবেই প্রায় ৩০ বছরের লম্বা সময় চলে গেছে। স্পর্শের সুখের অনুভূতি ছাড়াই বেড়ে উঠছে শিশুরা। পৃথিবী তার গতিতেই ঘুরছে। পৃথিবীতে ছুটে বেড়ানো মানুষেরা তাদের গতি হারিয়েছে। আজ কি যে হয়েছে সবার! অ্যালবামের ভিতরে ছবিগুলোর স্মৃতিরা জীবন্ত হয়েছে যেন। রবি তার দাদার বিয়ের ছবি দেখে বলছে “অনেক মানুষ ,এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে, এ রকম খুবই বিপদজনক, এভাবে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো ঠিক না দাদা।” আরমান শুধু বলেছেন, “এমনই ছিল তখন, সে সময় স্পর্শ আন্তরিকতা বোঝাতো।” রবি চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর দাদার জন্য আর নিজের জন্য চা বানিয়ে আনে। বাড়িতেও নিরাপদ দূরত্বে বসে তারা চা খায়। আরমান রহমানের ইচ্ছে করে রবিকে কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখতে কিন্তু রবিরা স্পর্শ করা ভালো চোখে দেখে না।
ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস আদালত, কেনাকাটা, এমনকি কাঁচা বাজারও অনলাইনে করতে হয়। কিছু কিনলে জীবাণুমুক্ত হয়ে ম্যানেজারের কাছে আসে। সেখান থেকে পৌঁছে দেয়া হয় বিভিন্ন ফ্লাটে বিল্ডিং সিকিউরিটির মাধ্যমে। ২০৫০ সালে ইট সিমেন্টের সাথে মোটা পুরু কাচের ব্যবহারও বেড়েছে। রোদ, বৃষ্টি, আলো, অন্ধকার কাছে থেকে দেখতে অনেকেই এ সৌখিনতাটুকু করেন। এই রুমের তিন দিকের দেয়াল এবং ছাদে স্বচ্ছ কাচ ব্যবহার করা হয়েছে। সুইচ অন করলে দেয়ালে এবং ছাদে কালো ইলেকট্রনিক ব্লাইন্ড নেমে আসে। হয়ে যায় পুরোপুরি ডার্করুম। স্থপতি হিসাবে জাতীয় পর্যায়ে সম্মানীত আরমান রহমান মনে করেন এই ডার্করুম, নিজেকে দেয়া নিজের সেরা উপহার। রাজশাহী শহরের সবুজ আর সতেজতায় বেড়ে ওঠা যে জীবন। বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানো আর চা খাওয়ার যে জীবন, সে জীবন আজ ল্যাপটপের ফ্রেমে বন্দী। হাত বাড়ালেই যে বন্ধুদের জড়িয়ে ধরা যেত তারা সবাই ভিডিও কলে জীবন খোঁজে। পার্ক, খোলা প্রান্তর আর রেস্টুরেন্টগুলো আজও ফাঁকা। বিভিন্ন রকমের গরম চা মানুষের প্রয়োজনীয় পানীয়। করোনার হাত থেকে বাঁচতে মানুষ এখন ঘন ঘন গরম চা খায়। সবুজ গাছপালার দিকে তাকালে শান্তি লাগে। কাচের রুমের সামনের ফাঁকা জায়গায় তাই অনেক গাছ। ছোটখাটো একটা বাগানের মত গাছগুলোতে মাঝে মাঝে বুলবুলি পাখিরা বাসা বানায়, ডিম দেয়, আবার এক সময় বাচ্চাদের নিয়ে উড়েও যায়। এই প্রথম ঘুঘু দম্পতি বাসা বানাচ্ছে। ঘুঘুর মতো চালাক পাখিরা যেন তাকে কোন কারণে শত্রু না ভাবে তাই নিঃশব্দে চলাফেরা এদিকটায়। এ বাড়ির কারো কোনো আগ্রহ নেই এসব ঘুঘু, বুলবুলি আর সবুজ গাছপালায়। তাদের সব ভালোবাসা আর ভালোলাগা কেড়ে নিয়েছে ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস। আহারে জীবন, আহা জীবন, জলে ভাসা পদ্ম যেমন। বন্ধুদের আড্ডার সবাই মিলে গাইতো গানটা, আহা জীবন। বিভিন্ন কারণেই বর্তমান সময়কে পিছনে ঠেলে সামনে আসে আগের জীবন। কখনো আবার ২০২০ সালের আগের জীবন এবং এখনকার জীবন একসাথে দেখা যায় অনলাইন ইন্টারভিউয়ের মতো পাশাপাশি ফ্রেমে। খুব এলোমেলো এবং অস্থির লাগে তখন। পৃথিবী ঘুরে গেছে বলে সূর্য যেন লাটাইয়ে সুতা জড়ানোর মতো আলো গুছিয়ে নিচ্ছে। পাখিরা হয়তো তাদের কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই ঘরে ফিরছে। আর আরমান রহমান পদ্মার পাড়ে তাঁর প্রিয় জায়গাগুলোতে কল্পনায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন। হঠাৎ ঘুঘু পাখির বাসাটায় চোখ যেতেই দেখেন ঘুঘু পাখিটা চিকন চিকন ডাল দিয়ে তাদের বাড়ি বড় করছে।
একমাত্র মানুষ ছাড়া অন্য সব প্রাণীর জন্য বাসযোগ্য এই পৃথিবী। শখ করে দূরে কোথাও যাওয়া হয়না অনেকদিন। আবিদা বেঁচে থাকলে হয়তো লং ড্রাইভে বের হতেন আজকে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চা খেতেন, তুচ্ছ করে কোভিড-১৯ এর ভয়।
লাকী রহমান, রাজশাহী থেকে
|